কৃষি ঋণ নীতিমালা ২০২৩-২৪: উন্নয়নের নুতন দিগন্ত
২২ জানুয়ারি ২০২৪ ১৫:০০
কৃষি ঋণ নীতিমালার প্রাসঙ্গিকতা
কৃষি উৎপাদন বাড়াতে চলতি অর্থবছরে কৃষকদের ৩৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে সরকারি-বেসরকারি সব বাণিজ্যিক ব্যাংক। নীতিমালা অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্য যা গত অর্থবছরের চেয়ে ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরে কৃষি ঋণের লক্ষ্য ছিল ৩০ হাজার ৮১১ কোটি টাকা। এবার চাহিদা বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্র মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৩০ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২১ হাজার ৯২৩ কোটি টাকা, বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ব্যাংকগুলো মোট ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণ করেছে, যা অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১০৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ বেশি। টেকসই উন্নয়নের নির্ধারিত লক্ষ্যের প্রথম ও প্রধান তিনটি লক্ষ্য তথা দারিদ্র বিমোচন, ক্ষুধা মুক্তি এবং সুস্বাস্থ্য অর্জনের উদ্দেশ্যে কৃষি ঋণ সরবরাহের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ ঋণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে ঋণ গ্রহীতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ৩৩ লাখ ৪ হাজার ৮১১ জন কৃষি ও পল্লী ঋণ পেয়েছেন। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব নেটওয়ার্ক ও এমএফআই লিংকেজের মাধ্যমে ৩৬ লাখ ১৮ হাজার ৫৪৫ জন ঋণ পেয়েছেন। ১৮ লাখ ৮১ হাজার ৯৩৩ জন নারী ১২ হাজার ৭৫২ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ পেয়েছেন। এক্ষেত্রে ব্যাংকের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ৫০ শতাংশ হতে হবে। আগে তা ছিল ৩০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ও কর্মসূচিতে নতুন করে কয়েকটি বিষয় যুক্ত করা হয়। এর মধ্যে-নতুন কৃষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ বিতরণ করতে হবে।
খাত ওয়ারি ঋণের সীমারেখা
পল্লী অঞ্চলে আয়-উৎসারী কর্মকান্ডে ঋণের সর্বোচ্চ সীমা হবে ৫ লাখ টাকা। ছাদ কৃষিতে অর্থায়ন করতে পারবে ব্যাংক। অর্থাৎ বাড়ির ছাদে বাগান করতে ঋণ পাবেন গ্রাহক। এছাড়া চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়া চাষে ঋণ বিতরণ করতে পারবে। মৎস্য খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৩ শতাংশ এবং প্রাণি সম্পদ খাতে লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ১৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে হবে। নীতিমালায় বলা হয়েছে, পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বিবেচনা করে ব্যাংকগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ করতে হবে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লক্ষ্যমাত্রার বাইরে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড তাদের নিজস্ব অর্থায়নে যথাক্রমে ২৬ কোটি টাকা ও ১ হাজার ৪২৩ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য ব্যাংকগুলোকে নিজস্ব নেটওয়ার্ক (শাখা, উপশাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং, দলবদ্ধ ঋণ বিতরণ এবং ব্যাংক-এমএফআই লিংকেজ) ব্যবহার করতে পারবে। এবারে প্রথমবারের মতো বেশ কিছু কৃষি পণ্যের জন্য ঋণ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ছাদ কৃষি, ভেনামি চিংড়ি, কাঁকড়া ও কুচিয়া চাষ। শস্য ও ফল চাষের আওতায় কালো ধান, এ্যাভোকাডো ফল ও পাতি ঘাসের জন্যও ঋণ দেওয়া যাবে। নারীসহ চরাঞ্চল, হাওড় ও অনগ্রসর প্রত্যন্ত এলাকায় কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণে দেওয়া হবে অগ্রাধিকার।
কৃষি ঋণ নীতিমালা ও বৈশ্বিক পরিস্থিতি
কোভিড-১৯ অতিমারি পরবর্তী চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে বেড়েছে জ্বালানি তেল-গ্যাস সহ খাদ্যশস্য এবং নিত্যপণ্যের দাম। বিশ্বব্যাপী বিরাজমান মন্দাবস্থা। ২০২৩ সালে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাসহ খাদ্য সংকট দেখা দেওয়ার সতর্ক বার্তাও উচ্চারিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মহল থেকে। সেই আশঙ্কা আমলে নিয়ে বর্তমান সরকার সর্বাধিক গুরুত্বারোপ করেছে দেশেই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর। ধান-চাল-শাকসবজি-ফলমূল ও মাছ উৎপাদনে প্রায় স্বনির্ভর হলেও গম-ভোজ্যতেল-চিনি-ডালসহ কিছু নিত্যপণ্য আমদানি করতে হয় এখনো। সরকার পর্যায়ক্রমে এসব ঘাটতিও অন্তত কমিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার বার দেশবাসীর উদ্দেশে বলেছেন, এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখা যাবে না। ধান-চালের পাশাপাশি গম, তেলবীজ ও অন্যান্য সহযোগী ফসল উৎপাদনে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। কৃষি ও জনবান্ধব এই আবেদনের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, দেশে কৃষি ঋণ বিতরণে গতি বেড়েছে ইতোমধ্যেই। স্বল্প সুদে ঋণ বিতরণ পদ্ধতিও সহজ করা হয়েছে কৃষকের জন্য। এর পাশাপাশি সরকার গত বোরো মৌসুমে ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়ানোর জন্য প্রায় ১৭০ কোটি টাকা নগদ প্রণোদনা দিয়েছে ২৭ লাখ কৃষককে। এর আওতায় প্রত্যেক কৃষক বিঘাপ্রতি চাষের জন্য ৫ কেজি বীজ, ১০ কেজি ডিএপি ও ১০ কেজি এমওপি সার পেয়েছেন বিনামূল্যে। দেওয়া হয়েছে কৃষি যন্ত্রের সুবিধাও। সবাইকে সবসময় মনে রাখতে হবে যে, কৃষকরাই বাংলাদেশের অর্থনীতির জীবনীশক্তি এবং মূল চালক। করোনা অতিমারির ভয়ংকর দুর্বিপাকসহ বিভিন্ন জাতীয় অর্থনৈতিক সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, মন্দাবস্থা সর্বোপরি খাদ্যাভাব মোকাবিলায় দিন-রাত উদয়াস্ত পরিশ্রম করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তারা বাঁচিয়ে রেখেছেন দেশের মানুষকে। কৃষি ও কৃষকরাই নিরন্তর অবদান রেখে চলেছেন দেশের মানুষের কল্যাণে। দেশ বর্তমানে খাদ্য বিশেষ করে ধান-চাল উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। খাদ্য মজুতও সন্তোষজনক। ফলে, খাদ্য সংকটের সম্ভাবনা নেই দেশে। সংকট মোকাবিলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বাধিক জোর দিয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ওপর।
কৃষি ঋণ ও জাতীয় বাজেট
এখন প্রশ্ন উঠেছে অর্থনীতিতে খাতওয়ারী এত বিনিয়োগ হওয়া সত্বেও এই ঋনের বিনিয়োগ এত কম কেন এবং জাতীয় বাজেটের আলোকে এই খাতের বরাদ্দ অগ্রাধিকার তালিকায় আসে না কেন? সম্প্রতিক এক তথ্য থেকে জানা যায় যে দেশের ৬১টি ব্যাংকের প্রায় ১০ হাজার শাখার অর্ধেকেরই বেশি গ্রামঞ্চলে যাদের কৃষকদের সহজ শর্তে ঋন দিতে অনিহা রয়েছে। সরকারি এক হিসাবে দেখা যায় গ্রামে ঋন গ্রহনকারী কৃষক পরিবারের শতকরা ৭৫ ভাগই চড়া সুদে ২০ থেকে ৩০ শতকরা হারে ঋন নিয়েছে এনজিওদের কাছ থেকে। ব্যাংকগুলো কাগজে কলমে গ্রামীণ শাখা খূললেও প্রকৃত পক্ষে সেগুলো শহরের মত গ্রামীন মানুষের বানিজ্য, শিল্প ও ভোক্তা ঋন বিতরন করছে। সরকারি এক হিসাবে বলা হয়েছে দেশে প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ কৃষক পরিবার রয়েছে যাদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক ঋন পেয়েছে মাত্র ২৫ শতাংশ যা সংখ্যায় ৬৫ লাখ মাত্র যাদের মধ্যে ৫০ লাখ ঋন নিয়েছে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এনজিও থেকে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এর মতে দেশের ৪১ লাখ গ্রামের পরিবার ঋনের জন্য ব্যাংকে আবেদন করলেও সফল হতে পারেনি এবং এর কারন হিসাবে ব্যাংকের অনীহা ও প্রচারের অভাবকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। এর পরও ঋন প্রক্রিযায় জটিলতা, পদ্ধতিতে ক্রুটি ও অলিখিত লেনদেন খরচ ক্রমাগত: ভাবে বেড়ে যাওয়ায় কৃষক আর এই কৃষ্টির সাথে নিজেদেরকে মেলাতে পারছে না অথচ কৃষকদের ঋন সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের দুটি বিশেষায়িত ব্যাংক যেমন বিকেবি ও রাকাব রয়েছে। তাছাড়াও অন্য ব্যাংকগুলোর জন্য মোট ঋনের কমপক্ষে ৫ শতাংশ কৃষিখাতে দেয়ার বাধ্য বাধকতা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কৃষি সংশ্লিষ্ট শিল্পকে দেয়া ঋন কৃষি ঋন হিসাবে অন্তর্ভক্ত করে এ নিয়ম পরিচালনা হয়েছে বলে দেখায়। বর্তমানে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের উপরে সুদ হার নির্ধারন করে দিয়েছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিন্তু ব্যাংকগুলো একে লাভজনক বলে মনে করেনা বিধায় ব্যাংকগুলো এজেন্সি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এনজিওদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে ঋন কার্য্যক্রম পরিচালনা করায় কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর ব্যাংকগুলো লাভবান হয়।
ঋন সংক্রান্ত মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা যায় যে কৃষি ঋন অকৃষিখাতে ব্যবহৃত হওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে যেখানে প্রকৃত কৃষকেরা ঋন প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত যা তদারকীর মাধ্যমে বন্ধ করার দাবি উঠছে। মাইক্রো ক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ) এর এক প্রবিবেদনে বলা হয়েছে এনজিওগুলো থেকে যে কৃষি ঋন বিতরন হচ্ছে তার বেশিরভাগ কৃষি কাজে ব্যয়িত না হয়ে অন্য খাতে ব্যবহৃত হচ্ছে। আবার বিবিএস এর তথ্য মতে মাত্র ১১ শতাংশ কৃষক তাদের ঋনের অর্থ কৃষিকাজে ব্যবহার করছে। আবার গৃহস্থলির অন্যান্য কাজে ঋনের অর্থ ব্যয় করছে প্রায় ৩৮ শতাংশ কৃষক পরিবার। এই তো গেল সনাতণী কায়দায় কৃষি ঋন নীতিমালা বাস্তবায়ন ঋন বিতরন সংক্রান্ত রোজনামচা। এর একটি সংস্কার এখন সময়ের দাবি। কারন ঋনের যে গ্রতিপ্রবাহ যা কর্মসুচি ভিত্তি ঋনের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হচ্ছে তা দিয়ে পরিবারতান্ত্রীক কৃষির ব্যবস্থার হয়ত কিছুটা উপকার আসবে কিন্তু কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে কিংবা কৃষির আধুনিকায়নে তেমন কোন অবদান রাখার সুযোগ নেই বলেই প্রতিয়মান হয়। একদিকে জমির স্বল্পতা অপরদিকে জনসংখ্যার চাপে প্রতিবছর এক শতাংশ হারে কৃষি জমি কমে যাওযার কারনে আধুনিক পদ্ধতিতে নীবিড় চাষ ছাড়া কোনভাবে কৃষিজাত পন্যের বর্ধিত উৎপাদন ধরে রাখা সম্ভব নয়। তাই কৃষি নীতিমালায় কর্মসুচিভিত্তিক কৃষি ঋনের পাশাপাশি প্রকল্পভিত্তিক কৃষি উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসুচির প্রতি নজর দেয়া বাঞ্চনীয়। এই পর্যায়ে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে শস্য কিংবা শাক সবজী চাষের পদ্ধতিতে যে পরিবর্তন প্রয়োজন দেখা দিয়েছে তা মোকাবেলায় পরিবারভিত্তিক খামার বিন্যাসের পরিবর্তে ব্যবসায়িক ভিত্তিক আধুনিক খামার কিংবা শস্য পর্যায়ের দিকে এগোতে হবে। এখন এই আধুনিক খামার যা হবে গ্রীনহাউজভিত্তিক প্রযুক্তি নির্ভরতার জন্য উদ্যোক্তা সৃষ্টি হতে হবে যার বড় কারখানা হলো দেশের সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে প্রতিষ্ঠিত প্রায় ১৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিধারী বিবিএ/এমবিএ ব্যাক্তিবর্গ যাদের কোর্স কারিকুলামে উদ্যোক্তা উন্নয়ন বিষয়টি গঠিত হয় তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিকভাবে। কারন মজুরীভিত্তিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হওয়ায় স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থানের সুযোগ বিদ্যমান যাকে কাজে লাগিয়ে অনায়াশেই কৃষিপন্য উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র বিমোচন সম্পন্ন করা যায় অথচ কৃষি ঋন নীতিতে এসকল বিষয়গুলোর স্বল্পতা রয়েছে।
আগামী দিনের কৃষিতে ঋনের প্রভাব ও সুপারিশ
তাই আধুনিক কৃষক সৃষ্টির মাধ্যমে আগামী দিনের কৃষি উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে হবে যার মধ্যে প্রথম: প্রয়োজন হবে ঋনের পরিবর্তে বিনিয়োগ যাকে বলা হবে কৃষি বিনিয়োগ নীতি। এর আওতায় গ্রীনহাউজভিত্তিক শস্য ও শাকসবজী উৎপাদন স্কীম গ্রহন করতে হবে যা হবে সারা বছরভিত্তিক উৎপাদন কার্য্যক্রম অর্থ্যাৎ সারা বৎসর সব জাতের সবজী পাওয়া যায় যার জন্য সনাতনী কায়দায় মৌসুমভিত্তিক সবজী লোপ পাবে। এতে কৃষি পন্য, শস্য সবজী ব্যবসা জমজমাট হবে, পুষ্টি চাহিদা পূরন হবে, ফসল আমদানী কমবে, রফতানি বাড়বে ও দেশ সমৃদ্ধির দিকে যাবে। এই নতুন শষ্য ব্যবস্থাপনার কথা বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত কৃষি ঋন নীতিতে নেই অথচ যেগুলো থাকার প্রয়োজন। এই ব্যবস্থা পাবলিক প্রাইভেট অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নতুন নতুন কৃষি উদ্যোক্তা প্রকল্প তৈরি হতে পারে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
দ্বিতীয় প্রসংগটি হলো কৃষি ঋন নীতিতে শতকরা ১০ ভাগ বরাদ্দ রাখা হয়েছে মৎস্য ও পশুসম্পদ খাতে। এখানে উল্লেখ্য যে প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের তৃতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে যার পেছনে ইলিশ মাছের অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশের মোট জিডিপির ৩.৫৭ শতাংশ এবং কৃষি জিডিপির ২৫.৩ শতাংশ আসে মৎসখাত থেকে। দেশে নিরুপিত মাছের চাহিদা ৩৯.৯২ লাখ টনের বিপরীতে উৎপাদন হচ্ছে ৪১.৩৮ লাখ টন যাকে বলা হয় মাছে স্বয়ংসম্পুর্ন। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখে চলছে মৎস বিজ্ঞানীরা এবং বাংলাদেশ মৎস গবেষনা ইনষ্টিট্উিট থেকে ইতিমধ্যে মৎস চাষ ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক ৬০টি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এর মধ্য বিলুপ্তি প্রায় প্রজাতির ১৮টি মাছের পোনা উৎপাদন করছে বিজ্ঞানীরা। এই সকল উদ্ভাবিত প্রযুক্তি মৎস অধিদপ্তর ও বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারনের ফলে ২০১৬-২০১৭ অর্থ বছরে দেশের মাছ উৎপাদন দাড়িয়েছে ৪১.৩৪ লাখ মেট্রিক টন। দেশের মৎস চাষীরা বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত জাতগুলো সঠিকভাবে চাষ করে দেশের মৎস খাতকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্টিত করছে সত্যি কিন্তু মাছের খাবারের মূল্য ও পুকুর সেচসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে জ্বালানীর অর্থ যোগান করতে যে পরিমান বিনিয়োগ প্রয়োজন হয় তা শতকরা দশ ভাগ কৃষি ঋন দিয়ে পোষাচ্ছে না। এই বিষয়টিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষভাবে মনোযোগী হবেন বিশেষত: কৃষি ঋন নীতিমালা তৈরিতে।
তৃতীয়তঃ কৃষি উপখাত প্রানী সম্পদ একটি গুরুত্বপূর্ন খাত যেখানে শতকরা দশ ভাগ ঋন বরাদ্দ কোনভাবেই সমিচীন নয়। কারন আমাদের খাবারের আমিষ যোগান ও খাদ্য পুষ্টির মান নির্ণয়ে এই খাত অতিব গুরুত্বপুর্ণ। বর্তমানে প্রানী সম্পদের উপর নির্ভরশীল প্রতিটি কৃষক পরিবার যা কর্মসংস্থানের একটি বড় উপযোগ।দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে বানিজ্যিক মুরগীর খামার, গবাদী পশু মোটা তাজাকরন ও ডেইরি খামার গড়ে উঠা ইত্যাদি এই খাতের প্রতি কৃষক পরিবারগুলোর আগ্রহ বৃদ্ধির বড় প্রমাণ। তারপরও বাড়তি জনসংখ্যার চাপে এই খাতের উৎপাদন দেশের চাহিদা পুরনে সমর্থ হচ্ছে না এবং এখনও দেশের প্রায় অর্ধেক নর নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছে যাদের মধ্যে শিশু ও নারীর সংখ্যাই বেশি। একথা অনস্বীকার্য্য যে সবার জনই পুষ্টি নিশ্চিত করতে হলে প্রাণি সম্পদ উন্নযনের কোন বিকল্প নেই। জাতিসংঘের উন্নয়ন লক্ষমাত্রা (এসডিজি) এর প্রায় নয়টি লক্ষ্যমাত্রার সাথে এই খাত সম্পর্কযুক্ত বিধায় এই খাতকে গুরুত্ব দিলে এসডিজি এর দারিদ্র দুরীকরন ও সুস্বাস্থ্য সহ বিভিন্ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সহায়ক হবে বিশেষত: ২০৩০ সালের মধ্যে। আবার বর্তমান সরকারের ভিশন ২০২১ অর্জনে জনপ্রতি দিনে দুধ ১৫০ মিলি লিটার, মাংস ১৯০ গ্রাম এবং বছরে ১০৪ টি ডিমের চাহিদা পূরনের লক্ষ্য কাজ করছে সরকারের প্রানি সম্পদ অধিদপ্তর। দেশে কর্মশক্তির ২০ শতাংশ প্রানিজ সম্পদ খাতের আওতায় রয়েছে আর ৪৪ শতাংশ আমিষ আসছে এই খাত থেকে। দেশকে উন্নত আয়ের দেশে পরিবর্তন করতে হলে প্রথমে প্রয়োজন মেধা যার সঙ্গে প্রানিজ আমিষের সম্পর্ক রয়েছে। এই বিবেচনায় সরকার প্রথম এমডিজি এবং পরে এসডিজি এর প্রানি সম্পদ সেক্টর ৯টি অভিস্ট ও ২৮টি লক্ষ্য মাত্রার সংগে যুক্ত হয়েছে। এরি মধ্যে এই সব অভিষ্ট ও লক্ষ্য অর্জনে কর্ম পরিকল্পনা গ্রহন করা হয়েছে যেগুলোর বাস্তবায়নে প্রয়োজন আইন ও নীতিমালা সহায়ক, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ঋন সহায়তা বৃদ্ধি, গবাদি পশুর জাত উন্নয়ন, প্রানিসম্পদ বীমা ব্যবস্থার চালু ও বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি। সরকারের কৃষি ঋন নীতিতে এই বিষযগুলোকে সংযুক্ত করে একটি কৃষি/কৃষকবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে।
চতুর্থত: আর্থিক অন্তভু্র্িক্ত বর্তমান সময়ের একটি আলোচিত বিষয়গুলোর মধ্যে একটি যার প্রচার ও প্রসার উভয়টি হলেও কৃষি ঋন নীতিতে তার তেমন কোন উল্লেখ্য নেই। ফলে এই কার্যক্রমের স্থবিরতা লক্ষ্যনীয়। উদাহরনস্বরুপ বলা যায় দশ টাকা মূল্যের একাউন্টের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থিক খাত (ব্যাংকিং) অন্তর্ভুক্তির শুভসুচনা হওয়ায় প্রায় ৮০ লাখ কৃষক পরিবার এর আওতায় চলে আসে এবং শুধু ঋনই নয় সরকারপ্রদও ভুর্তুকীর সকল অনুদান এই একাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন শুরু হয়। পরিবর্তিতে বিভিন্ন জরীপে দেখা যায় বছরের নির্দ্দিষ্ট সময়ে এই হিসাবগুলো সচল থাকে সারা বছর সমভাবে নয় এবং পরিচালনকারি গ্রামীণ ব্যাংকের কৃষি শাখাগুলো এই সকল একাউন্টগুলোকে খুব উৎসাহব্যাঞ্চক দৃষ্টিতে দেখে না যার ফলশ্্রুতিতে যে উদ্দেশ্য এই কার্য্যক্রম শুরু করা হয়েছিল তা প্রত্যক্ষ কোন কাজে আসছে না এবং এই বিষয়গুলো কৃষি ঋন নীতিমালায় অত্যন্ত স্পষ্টভাবে উল্লেখিত হওয়া উচিত;
পঞ্চমত: কৃষি ঋন নীতিতে কেবল ঋন বিতরনের কথাই উল্লেখ থাকে আদায়ের তেমন তত্ত্ব উপাত্ত দেখা যায় না। গবেষনায় বলছে কৃষি ঋন বিতরন ও তার ব্যবস্থাপানায় বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি ব্যাংক এর ঋন সবচেয়ে বেশি অবস্থানগত কারনেই। তাদের অনাদাযী শ্রেনি বিন্যাসকৃত ঋনের পরিমান সার্বিক ঋনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলেও সেই দুটি ব্যাংক থেকে প্রকল্পভিত্তিক শিল্প যেমন মিশ্র খামার দেশের অনেক যায়গায় ব্যাংকের দৃষ্টি কেড়েছে এবং শুধু প্রয়োজন একটি স্বচ্ছ কাঠামো, ব্যাংকারদের দৃষ্টিভঙ্গি, সহায়ক পরিবেশ ও নীতিগত সহায়তা। দেশের সার্বিক ঋন ব্যবস্থাপনায় পরিমানের দিক থেকে কৃষি ও পল্লী ঋন একেবারেই নগন্য এবং সেই হিসাবে বৃহদাকার ঋনের ঝুকি তথা আদায় বা অনাদায়ী সংকট দেশের ঋন খেলাপীর বিরাট অংশ জোড়া রয়েছে। এই অবস্থায় আনুপাতিক হারে কৃষি/পল্লী ঋন সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে।
তাই আসুন কৃষি ঋন নীতিমালায় উল্লেখিত অধ্যায় বা ধারাগুলোকে সফল বাস্তবাযনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, আয় বৃদ্ধি তথা দারিদ্র বিমোচনে ব্যাংকগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কেন্দ্রিয় ব্যাংক এ ব্যাপারে তফসীল ব্যাংকগুলোকে নীতি সহায়তা দিয়ে যাবে এই প্রত্যাশা রহিল।
লেখক: কৃষি অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
কৃষি ঋণ নীতিমালা ২০২৩-২৪: উন্নয়নের নুতন দিগন্ত ড. মিহির কুমার রায় মত-দ্বিমত