যুদ্ধের ক্লান্তি এবং অর্থনৈতিক সমস্যায় ইউক্রেন
২৬ জানুয়ারি ২০২৪ ২১:৩৯
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সেনা অভিযানের ঘোষণা করেছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তারপর থেকে দুদেশের সেনাদের মধ্যে লাগাতার যুদ্ধ চলছে। কখনও যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে, কখনও কমেছে। তবে যুদ্ধ বন্ধ হওয়ার লক্ষণ নেই।
যুদ্ধের প্রথম বর্ষপূর্তিতে জেলেনস্কি কী বলেছিলেন মনে পড়ে? তিনি ভবিষৎবাণী করেছিলেন ‘‘২০২৩ সাল হবে আমাদের বিজয়ের বছর’। জেলেনস্কিও সেই আশা কি বাস্তবতার মুখ দেখেছে? অর্থাৎ ২০২৪ সাল নিয়ে যে তিনি কোনো পূর্বাভাস দেবেন না, তা অনুমেয়। বরং ২০২৪ সালে তার দুর্দশা বাড়বে, কমবে না। রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইউক্রেনকে সমর্থন জানিয়েছিল জো বাইডেনের সরকার। যুদ্ধের শুরুতে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্যও করেছিল। কিন্তু জার্মানির সঙ্গে জোট বেঁধে সেই আমেরিকাই নাকি এবার ইউক্রেনকে যুদ্ধ থেকে সরে আসার কথা বলছে। তেমনটাই উঠে এসেছে জার্মানির এক সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদনে। জার্মানির ঐ সংবাদ মাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘যুদ্ধের ক্লান্তি’ এবং অর্থনৈতিক সমস্যার কারণে কিয়েভকে সর্মথন করা ন্যাটো দেশগুলির পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে। আর সেই কারণেই আমেরিকা এবং জার্মানি জেলেনস্কি সরকারকে যুদ্ধ থেকে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
সিএনএনের সংবাদ মাধ্যম অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে অর্থাৎ জুলাই-সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৪ দশমিক ৯ শতাংশ, যদিও ধারণা করা হয়েছিল প্রবৃদ্ধি হবে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। বছরের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি আরও চাঙা ছিল, পরের দিকে এসে তা গতি হারিয়েছে। সুইডেনভিত্তিক ষ্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই) ২০২২ সালের বৈশ্বিক অস্ত্র উৎপাদন ও ব্যবসায় সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে আগের বছরের তুলনায় অস্ত্র বিক্রি কমেছে সাড়ে ৩ শতাংশ। এসআইপিআরআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিগত বছরগুলোর তুলনায় মার্কিন অস্ত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর লাভ তুলনামূলক কমে গেলেও বিশ্বের অস্ত্রের বাজারে তারাই এখনো প্রাধান্য ধরে রেখেছে। তবে আগের বছরের তুলনায় ২০২২ সালে মার্কিন অস্ত্র বিক্রি কমেছে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ।
প্রশ্ন হচ্ছে পুতিনের রাশিয়া কি অতিমাত্রায় ভালো আছে? তেমনও নয়। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা দুর্বলতা বাড়াচ্ছে মস্কোর। দীর্ঘমেয়াদি দ্বন্দ্ব, ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে একটু একটু করে। দেশত্যাগ ও যুদ্ধক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতি-এ দুই বিষয় ভোগাচ্ছে পুতিনকে। সংকট ইতিমধ্যে বেশ ঘনীভূত আকার ধারণ করেছে। তথ্য বলছে, ২০২২ সাল থেকে রাশিয়া ছেড়েছে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ মানুষ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, রাশিয়ার আসন্ন নির্বাচনে পুতিন বিজয়ী হবেন বটে, কিন্তু এসবের একটা নেতিবাচক প্রভাব রয়েই যাবে। শ্রমের ঘাটতির ফলে সৃষ্ট ক্রমবর্ধমান মুজুরি ও মূল্যস্ফীতির মতো বিষয় আটকানো কঠিন হবে পুতিনের জন্য। এটা ঠিক যে, পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা ভালোভাবে এড়িয়ে শিল্প উৎপাদনের চাকা সচল রাখার মাধ্যমে রাশিয়ার অর্থনীতি চাঙাভাব বজায় রেখে চলেছে। তবে বেশির ভাগ অর্থই ব্যয় হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে। যদিও অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের কথা অনুযায়ী, ‘দীর্ঘমেয়াদে আমরা সবাই মৃত’।
এ বছর ইউক্রেন যুদ্ধের গতি প্রকৃতি নির্ধারণের আরেকটি দিক হবে অর্থনীতি। ইউক্রেনের অর্থনৈতিক অবস্থা যুদ্ধ চালিয়ে নেওয়ার মতো নয়। যুক্তরাষ্ট্রের জনশক্তিভিত্তিক কোম্পানি লাটার গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর ছয় লাখের মতো ইউক্রেনীয় রয়েছেন। যারা সেনাবাহিনীতে কাজ করতে সক্ষম। নববর্ষ ২০২৪ উদযাপন উপলক্ষ্যে দেওয়া ভাষণে তাদের উদ্দেশ্যে জেলেনস্কি বলেছেন ‘‘আপনাদের এই সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনারা শরনার্থী নাকি নাগরিক’’। এর পাশাপাশি ইউক্রেনের অর্থনীতি যুদ্ধ অর্থনীতিতে রূপান্তর করারও একটা প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। এই নীতিতে নাগরিকদের ওপর এবং ছোট ও মাঝারি ব্যবসার ওপর করের বাড়তি বোঝা চাপানো হয়েছে। এতে করে বড় অংশের ব্যয় করার ক্ষমতা ব্যাপকভাবে কমে যাবে। সামাজিক ন্যায্যতা, দুর্নীতি ও সামাজিক চুক্তির ক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় সমাজের অভিজাত ও গরীবদের মধ্যে বৈষম্যতা প্রকট হচ্ছে। ইউক্রেনের অভিজাতদের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে আস্থা এরই মধ্যে কমে এসেছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে। ফলে যত দিন গড়াচ্ছে, ইউক্রেন যুদ্ধ ততই দেশটির ‘‘গরীব মানুষের যুদ্ধ’’ বলে পরিগণিত হচ্ছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইউক্রেনে গরীব মানুষের সংখ্যা যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি। যুদ্ধ শুরুর পর সবচেয়ে দক্ষ ও অর্থনৈতিকভাবে সক্রিয় জনগোষ্ঠীর অভিবাসী হওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। জীবনযাত্রার মান ভয়াবহভাবে কমতে দেখে ইউক্রেনের গরীব মানুষেরা প্রধানত যুদ্ধ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
কিয়েভ-মস্কোর মধ্যে যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য প্রদানকারী দুটি প্রধান শক্তি ছিল আমেরিকা এবং জার্মানি। কিন্তু সেই অস্ত্র সরবরাহের হিসাব নাকি বদলেছে। ‘বিআইএলডি’ জানিয়েছে, দুই মহাশক্তিধরই এখন শুধুমাত্র ‘নির্দিষ্ট পরিমাণ’ অস্ত্র সরবরাহ করতে চায় ইউক্রেনকে। যাতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। পাশাপাশি রাশিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনার জন্য যাতে পর্যাপ্ত সুযোগ থাকে, সেই অবকাশ রাখতে ও ইউক্রেন সেনাবাহিনীর হাতে বেশি অস্ত্র তুলে দিতে রাজি নয় আমেরিকা এবং জার্মানি। প্রতিবেদনে উল্লেখ যে, জার্মানির ফেডারেল সরকার এখন ইউক্রেনকে আলোচনার জন্য কৌশলগত ভাবে ভাল অবস্থানে রাখার লক্ষ্য নিয়ে যাবতীয় সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। জার্মানির এক সংবাদ মাধ্যমের মতে, ইউক্রেনের উচিত সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখন্ডতা নিয়ে রাশিয়ার শাসক ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে আলোচনায় বসা। বার্লিন এবং ওয়াশিংটন মনে করছে, কিয়েভ এবং মস্কো যদি আলোচনায় বসতে রাজি না হয় তাহলে দুই দেশের মধ্যে সমস্যার কোন সমাধানের পথ বের হবে না। দুই সরকারের মধ্যে কোনও আনুষ্ঠানিক চুক্তিও হবে না।
জার্মানির ট্যাবলয়েড ‘বিআইএলডি’র প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। মার্চ মাসে রুজভেল্ট কক্ষে বৈঠকে বসেছিলেন-আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজ। সেই বৈঠকের সময় বাইডেন এবং ওলফে উভয়েই নাকি ইউক্রেনে অস্ত্র সরবরাহ সীমিত করার বিষয়ে সম্মতি জানিয়েছিলেন। পাশাপাশি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে শান্তি আলোচনায় বসার জন্যও নাকি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির উপর পরোক্ষভাবে চাপ দিতে সম্মত হয়েছিলেন তারা।
হার্ভার্ডের কেনেডি স্কুলের বেলফার সেন্টারের মতে, ক্রিমিয়া ছাড়াও ইউক্রেনের প্রায় ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ জমি এখন রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে। যা ২০১৪ সালে অধিগ্রহণ করেছিল পুতিন সরকার। রাশিয়ার দাবি সেই জমি তাদের দেশেরই অংশ। ইউক্রেন কি এই বিকল্প রাস্তাতে হাটঁবে? অবশ্যই না। কারণ রাশিয়া অধিকৃত জমি পুনরুদ্ধার করার দাবিতে বহু দিন ধরেই অনড় জেলেনস্কি সরকার।
প্রশ্ন হচ্ছে রাশিয়া এবং ইউক্রেনকে শান্তি আলোচনায় বসাতে ব্যর্থ হলে ‘কি পরিকল্পনা’? হ্যাঁ, ‘প্ল্যান বি’ ও রয়েছে আমেরিকা এবং জার্মানির হাতে। তা হলো দু’দেশের মধ্যে শান্তি আলোচনা সম্ভব না হলে বিকল্প হিসাবে কোনও চুক্তি ছাড়াই সংঘাত থামাতে চাইছে বার্লিন এবং ওয়াশিংটন। আর তা হলো শান্তি আলোচনা বাস্তবায়িত না হলেও ইউক্রেন এবং রাশিয়ার মধ্যে একটি নতুন সীমানা টানতে চাইছে আমেরিকা এবং জার্মানি।
আগামী দিনে যুদ্ধের ময়দান কেমন হতে পারে? ইউক্রেন অনেকটা প্রতিরক্ষামূলক ভঙ্গিতে অবস্থান করবে, জেলেনস্কি যুদ্ধবিরতি বা আলোচনার টেবিলে বসবেন বলে মনে হয় না। আর এর অর্থ হলো ক্ষতটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য খোলা রেখে যাওয়া। মার্কিন ওয়েব পত্রিকা পলিটিকোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভবিষ্যতে কোনো শান্তি আলোচনায় ইউক্রেনের অবস্থা যাতে দুর্বল না হয়, সে জন্য এই পথ পরিবর্তন প্রয়োজনীয়। প্রশাসনের একজন মুখপাত্রের কথা উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি জানিয়েছে, যে যাই বলুক এই যুদ্ধের সমাপ্তি যুদ্ধের ময়দানে নয় আলাপ আলোচনার টেবিলেই হতে হবে।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির সাফল্য কী? গাজায় সংঘাতের পর এই প্রশ্ন আসবেই। বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির একটি মাপকাটি হতে চলেছে ইউক্রেন যুদ্ধ। কারণ এটি ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নয়,পশ্চিম বনাম রাশিয়ার প্রক্সি যুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ইউক্রেন আর তেমন একটা সহায়তা পাবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং বিষয়টি ক্রমশ জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
মোক্র্যাটদের মধ্য থেকেও কেউ কেউ এর বিরোধিতা করতে শুরু করেছে। মাথায় রাখতে হবে কেবল তহবিল সরবরাহ নয়, কিয়েভের প্রতি মার্কিন অস্ত্রের সরবরাহ ও ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। এই শূন্যস্থান পূরণের চাবি যেহেতু ইউরোপের হাতেও নেই সুতরাং এটা কি বলা যায়! যুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয় লাভের স্বপ্ন ক্রমশ ম্লান হয়ে যাচ্ছে!
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এজেডএস