Monday 25 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মিশন ২০৪১— কেমন হবে আগামীর স্মার্ট শহর-গ্রাম?

মোহাম্মদ শামছুজ্জামান ও কাজল আব্দুল্লাহ
২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৭:৩৬

২০৪১ সালে আমাদের গ্রামগুলো কি শহরের মতো ইট-সিমেন্টে ঘেরাও হয়ে যাবে? আমাদের গ্রামগুলো থেকে কি সব সবুজ হারিয়ে যাবে?

না, এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। শহরের সব সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন গ্রামগুলো হবে প্রাণবন্ত, সবুজ ও টেকসই। সবুজ নির্মলতা অটুট রেখেই গ্রামগুলো পরিণত হবে স্মার্ট সিটিতে। গ্রামের পাশাপাশি আগামীর বাংলাদেশে শহরগুলোও হবে সবুজ, পরিচ্ছন্ন ও বসবাসযোগ্য। বাসিন্দাদের মানসিকতায় পরিবর্তন ঘটিয়ে পরিচ্ছন্নতার চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে শহরগুলো হবে আরও দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষণীয়।

বিজ্ঞাপন

ভাবতে পারেন, গ্রামের অবারিত মাঠের মধ্য দিয়ে পাকা রাস্তায় ছুটছে বৈদ্যুতিক গাড়ি। বিশাল ফসলের মাঠের ওপর উড়ে চলেছে ড্রোন, কৃষক তার ফসল তদারকি করছেন হাতের ট্যাবে। ড্রোনের স্মার্ট সেন্সর ফসলের ছবি এআইয়ের মাধ্যমে অ্যানালাইসিস করে কৃষককে জানিয়ে দিচ্ছে মাটির স্বাস্থ্য ও ফলনের সম্ভাবনা। জেলেরা তাদের ভাগ্য আর অদৃষ্টের ওপর ছেড়ে দিয়ে বসে নেই।

স্মার্ট মাছ চাষিরাও মোবাইলে রিয়েল টাইম ড্যাশবোর্ডেই দেখছেন সিড, ফিড আর মেডিসিনের ইনভেন্টরি, পুকুরের ও মাছের রিয়েল-টাইম স্ট্যাটাস। পুকুরে বসানো আছে আইওটি ইকুয়েপমেন্ট। এআই প্রযুক্তি জানিয়ে দিচ্ছে কোন পুকুরে কখন কী লাগবে, মাছের খাবার ও মেডিসিন কখন লাগবে। পুকুরের অক্সিজেন ব্যালান্স থেকে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে মোবাইল অ্যাপ থেকে।

নকশা ও বুননে তাঁতিরা ব্যবহার করছেন ডেটানির্ভর স্মার্ট প্রযুক্তি। গ্রামের সোলার প্যানেল থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। ই-কর্মাসের মাধ্যমে মাঠ থেকেই ফসল বিক্রি করছেন চাষি। পার্সোনালাইজড ও ব্লেন্ডেড শিক্ষায় শিক্ষিত প্রজন্ম প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিত্যনতুন উদ্ভাবনে করছেন সমস্যার সমাধান। গ্রামে বসেই কাজ করছেন বিশ্বের নামকরা সব প্রতিষ্ঠানে। হয়ে উঠেছেন বিশ্ব নাগরিক।

বিজ্ঞাপন

গল্পের মতো মনে হলেও ঐতিহ্য আর আধুনিক প্রযুক্তির মেলবন্ধনে এরকমই হবে আগামী দিনের বাংলাদেশ। স্মার্ট বাংলাদেশে প্রযুক্তি কোনো বৈষম্য তৈরি করবে না। বরং সঠিক ও সহজ প্রযুক্তি নিশ্চিত করবে মানুষ ও সম্পদের সঠিক ব্যবহার। কম খরচে ও শ্রমে নিশ্চিত করা যাবে সর্বোচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং সর্বোপরি আনন্দময় জীবন।

শহরের সব সুযোগ-সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে। প্রযুক্তিনির্ভর গ্রাম-শহর গড়ার লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্মার্ট জেলা গড়ে তুলতে ‘স্মার্ট ডিস্ট্রিক্ট ইনোভেশন চ্যালেঞ্জ ২০২৩’ প্রতিযোগিতা শুরু করে এটুআই ইনোভেশন ফান্ড। সারাদেশের জেলা প্রশাসন সব মিলিয়ে ৭৫টি উদ্ভাবনী আইডিয়া জমা দেয়। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ে এই উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে নগরের ১০টি স্কুল বাসে জিপিএস ট্র্যাকার, জিআইএস প্রযুক্তি, ডিজিটাল হাজিরা ডিভাইস ও আইপি ক্যামেরা স্থাপন করে স্মার্ট বাসে রূপান্তরিত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা বাসে ওঠা-নামার সময় হাজিরা যন্ত্রের সামনে স্মার্ট কার্ড চাপ দিলেই খুদে বার্তা যাচ্ছে অভিভাবকদের মোবাইলে। এ ছাড়া ঘরে বসেই জিপিএস ট্র্যাকিং ও সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে বাস ও শিক্ষার্থীর অবস্থানও দেখতে পারছেন অভিভাবকরা। ধীরে ধীরে অন্যান্য শহরের পাশাপাশি গ্রামগুলোতেও এই ধরনের স্মার্ট সার্ভিস চালু হবে, যেন আরামদায়ক যাতায়াতের পাশাপাশি নিশ্চিত হবে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তাও।

গ্রাম-শহরের দূরত্ব কমিয়ে আনার এই গল্পযজ্ঞের আরেকটি ক্ষুদ্র চিত্র হলো পঞ্চগড়ের প্রান্তিক এলাকার জমিলা খাতুনের গল্প। পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার দেবনগর ইউনিয়নের এক বিধবা নারী জমিলা খাতুন (রূপক)। সম্পত্তি বলতে তার সম্বল কেবল একটি বাড়ি। সন্তানেরা শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। জমিলা তার সব কাজ নিজেই করেন। তবে বয়স বেড়ে যাওয়ায় দৌড়ঝাঁপের কাজগুলো ভালোভাবে করতে পারে না। বিশেষ করে বাড়ির খাজনা দেওয়া, গ্যাস বিল জমা ইত্যাদি কাজগুলো।

জমিলা খাতুনের মতো এমন নাম না জানা আরও বহু নাগরিকের দুর্ভোগ নিরসনে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসন পরিকল্পনা করে ক্যাশলেস পঞ্চগড় গড়ার, যা মূলত সরকারি সব সেবায় লেনদেন আরও সহজ, আরও স্বচ্ছ, আরও কম দুর্ভোগপূর্ণ করবে। জেলা প্রশাসনের এমন উদ্যোগে জমিলা খাতুনকে আর ব্যাংক থেকে টাকা তুলে, দফতর দফতর ঘুরে ঘুরে বিল পরিশোধের কাজ করতে হয় না। কোনো দালালের শরণাপন্নও হতে হয় না। তিনি ঘরে বসেই এখন মোবাইলের মাধ্যমে সব কাজ শেষ করতে পারেন।

শহরের মতো গ্রামের প্রতিটি মানুষও পাবেন উন্নত স্বাস্থ্য সেবা। প্রত্যেকের থাকবে একটি করে স্মার্ট হেলথ আইডি। এমন একটি উদ্যোগ বান্দরবান জেলায় সফলভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। টেলিমেডিসিন প্রযুক্তির মাধ্যমে গ্রামবাসী পাবেন দেশ-বিদেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের চিকিৎসা। বৈশ্বিক মহামারি কোভিড-১৯-এর সময় আমরা এরকম হতে দেখেছি। এরই মধ্যে গ্রামীণ পর্যায়ে প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক গড়ে তোলা হয়েছে। সেন্ট্রাল সার্ভারে সংরক্ষিত থাকবে প্রতিটি রোগীর ডিজিটাল ডাটাবেজ। রোগী যে হাসপাতালেই যাক না কেন, হেলথ আইডি দিয়ে চিকিৎসক তার অসুস্থতার সব হিস্ট্রি দেখে সহজে রোগ নির্ণয় ও নিরাময় করতে সাহায্য করবেন।

এই পরিবর্তনগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে কারণ, মাত্র ১৩ বছরে ৪০ শতাংশ থেকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে দেশ। গ্রাম-শহর মিলিয়ে দেশে মোবাইল ফোন সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির বেশি। এই সময়ের মধ্যেই মাত্র ৫৬ লাখের জায়গায় বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৩ কোটির বেশি। বিদ্যুতের পাশাপাশি মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেটের কল্যাণে যে অভাবনীয় কানেকটিভি তৈরি হয়েছে, তাতে গ্রামের মানুষ আর কোনোভাবেই পিছিয়ে থাকছে না শহর থেকে।

গ্রামের প্রতিটি নাগরিকের কাছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক স্মার্ট সেবা পৌঁছানোর মাধ্যমে দক্ষতা বিকাশ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছে অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)। গ্রামের মানুষ বাড়ির পাশে বসেই পাচ্ছেন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে ৩৮২ ধরনের সেবা। জন্মনিবন্ধন থেকে পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ জমি-সংক্রান্ত কাগজপত্র— সবই মিলছে এক জায়গায়। জাতীয় হেল্পলাইন ৩৩৩-এ ফোন দিলেই মিলছে চিকিৎসকের পরামর্শসহ সামাজিক সমস্যা সমাধানে সহায়তা। প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য রয়েছে বিশেষ প্রবাসী হেল্পডেস্ক, যেখানে বিদেশ যাওয়ার আগে-পরে সব ধরনের সহায়তা পাওয়া যায়।

গ্রামের তরুণ-তরুণীরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্যপ্রযুক্তির নানা বিষয়ে দক্ষ হয়ে নিজেদের কাজের সুযোগ নিজেরাই তৈরি করছে। সরকারি উদ্যোগে এমনই একটি অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে নাটোরের সিংড়ায়। দেশ-বিদেশে গ্রামীণ পণ্য সহজে বিক্রির জন্য তৈরি করা হয়েছে একশপ প্ল্যাটফর্ম। গ্রামের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য গড়ে উঠেছে সাথী নেটওয়ার্ক। প্রান্তিক মানুষের কথা মাথায় রেখে গ্রামের রাস্তায় চলার উপযোগী বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরি হচ্ছে এটুআইয়ের সহযোগিতায়।

তাই বলে কিন্তু শহরের সুযোগ-সুবিধা দিতে গিয়ে গ্রামের প্রাণ-প্রকৃতি ও পরিবেশের ক্ষতি করা হবে না। বরং একে টেকসইভাবে সংরক্ষণ করা হবে। এমনই এক উদ্যোগের অংশ হিসেবে চলনবিলে তৈরি হয়েছে সিংড়া-বারুহাস-তাড়াশ সাবমারসিবল সড়ক। মানে শুকনো মৌসুমে গাড়ি চলবে, তিন-চার মাসের বর্ষায় রাস্তার ওপর দিয়ে নৌকাও চলবে।

স্মার্ট গ্রাম উদ্যোগের পুরো আয়োজনটি গোষ্ঠীকেন্দ্রিক নয়, বরং সবার জন্য। প্রতিটি সেবা হবে ব্যক্তির চাহিদা অনুযায়। শুধু তাই নয়, ২০৪১ সালের বাংলাদেশে গ্রামের সমস্যার সমাধান গ্রামের মানুষই করবেন। এ জন্য সবকিছুর আগে দরকার মানসিকতা। আর তাই উদ্ভাবনী চিন্তা ও সমস্যা সমাধানের মানসিকতা তৈরিতে শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, উদ্যোগ— সবকিছু মিলে তৈরি হবে নতুন গ্রাম, যাকে আমরা বলতে পারি গ্রাম ২.০ (টু পয়েন্ট ও)। গ্রামগুলো স্মার্ট শিক্ষার আলোয় ঝলমল করবে। মুখরিত হবে উদ্ভাবনের গল্পে।

এমন লক্ষ্যকে বাস্তবে রূপ দিতে দেশব্যাপী ডিজিটাল সেন্টার তৈরি করেছে এটুআই। গ্রামের মানুষদের জন্য ইন্টারনেট ও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। এগিয়ে চলছে শিক্ষক বাতায়ন আর মুক্তপাঠের কার্যক্রম। শিক্ষক বাতায়ন শিক্ষকদের হাতে তুলে দিচ্ছে প্রযুক্তির দক্ষতা, যেন তারা গ্রামের শিশুদের শেখাতে পারেন প্রযুক্তিনির্ভর জগৎকে জয় করার কৌশল। আর মুক্তপাঠের অনলাইন কোর্সের মাধ্যমে গ্রামের মানুষ পাচ্ছেন যেকোনো বিষয়ে জ্ঞান, গড়ে তুলতে পারবেন নতুন দক্ষতা।

এরকমই একটি স্মার্ট গ্রাম ঝিনাইদহ জেলার হরিনাকুন্ডু উপজেলার হিজলী। বাল্যবিবাহ, অপরাধ ও আত্মহত্যার অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়ার পাশাপাশি স্বনির্ভর, ডিজিটাল ও পরিবেশবান্ধব একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে হিজলী।
উদ্ভাবনী এই মানসিকতার বাস্তব রূপ কিন্তু আমরা হাতে-কলমে পেতে শুরু করেছি। দেশের তরুণ সমাজ এগিয়ে আসছে যেকোনো সমস্যায় ‘আমিই সল্যুশন’ হিসেবে। এমনই এক তরুণ আহসান হাবিব, যিনি তৈরি করেছেন স্মার্ট সাদাছড়ি। এই সাদাছড়ি সময় বলে, সামনে কোনো বাধা থাকলে সেটিও বলে দেয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি কোথায় অবস্থান করছেন, আশপাশে কী আছে, সেটিও জানায়। এটি বাংলাসহ আরও কয়েকটি ভাষায় কথা বলে।

উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার পথে রয়েছে চ্যালেঞ্জ। তবুও এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি উন্নয়ন সংস্থাসহ নানা বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে অদম্য এই যাত্রায় থাকবে সব নাগরিকের অবদান। সুফলও পাবেন তারা। ‘জিরো ডিজিটাল ডিভাইড’ মন্ত্রে থাকবে না কোনো নাগরিক বৈষম্য। গ্রাম ও শহর, সবাই মিলে হাত ধরে গড়বে স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক: মোহাম্মদ শামছুজ্জামান, উপসচিব ও ন্যাশনাল পোর্টাল ইমপ্লিমেন্টেশন স্পেশালিস্ট, অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই); কাজল আব্দুল্লাহ, সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জাহাজী লিমিটেড

সারাবাংলা/টিআর

আগামীর গ্রাম আমিই সল্যুশন এটুআই মিশন ২০৪১ স্মার্ট গ্রাম স্মার্ট শহর

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর