অকুতোভয় বীর ফতেহ চলে গেলেন নীরবেই
১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ১৯:৫৮
তার বাবা ছিলেন পাকিস্তান আমলে ডিস্ট্রিক্ট জাজ। বনেদী ঘরের অবস্থাপন্ন পরিবারে জন্মানো ফতেহ আলী চৌধুরীর চলাফেরা ছিল অভিজাত ধরনের, বর্তমান যুগের ভাষায় যাকে আমরা ক্যুল ড্যুড বলতে পারি। রঙচঙ-এ হালফ্যাশনে পোশাক-পরিচ্ছদে বাবার সরকারী গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা, তৎকালীন হাইপ্রোফাইল সাবজেক্ট ইংলিশে পড়ালেখা করা, বন্ধু কাজী কামাল উদ্দিনের সাথে বাস্কেটবল কিংবা ক্রিকেট খেলা- সবমিলিয়ে আয়েশী আরামদায়ক জীবনযাপন বলতে যা বোঝায় আর কি। তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা, বাঙ্গালীর স্বাধিকারের অন্তহীন লড়াই, দেশব্যাপী পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠা জনসমুদ্রের সকল বাস্তবতা বিবর্জিত ফতেহ আলী হয়তো নিজেও জানতেন না নিয়তির লেখা তার গল্পটা গড়বে অবিশ্বাস্য ইতিহাস!
মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা বা তাগিদটা নানাভাবেই এসেছিল। কেউ রাজনৈতিকভাবে সচেতন ছিলেন, কেউ সরাসরি স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে চূড়ান্ত যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন, কেউবা আবার যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন পরিবারের উপর আঘাত আসায়, আক্রান্ত হয়ে। ফতেহ আলী চৌধুরীর যুদ্ধে যোগ দেবার গল্পটা একটু আলাদাই। রাজনীতি সম্পর্কে ততটা আগ্রহ বা জ্ঞান না থাকা ফতেহ ২৫ শে মার্চের রাতে বেরিয়েছিলেন হাটখোলার বড় রাস্তাটায় ব্যারিকেড দিতে। মহল্লার সব রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দেয়া হচ্ছে, তাদের রাস্তায় না দিলে কেমন দেখায়! মধ্যরাতে যখন পাকিস্তানী সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামের ভয়ংকর জেনোসাইডে ঝাঁপিয়ে পড়ল, নির্বিচারে হত্যা করতে থাকলো হাজার হাজার নিরীহ নিরপরাধ মানুষকে, তখনো নিরাপদে থাকা ফতেহ কল্পনাও করতে পারেননি পরদিন সকালটা তার জন্য কি চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে।
পরদিন কারফিউ তুলে নেবার বাইরে বেরিয়ে হঠাৎ তার চোখ পড়ল ভিসতিওয়ালার উপর (ভিসতিওয়ালা –যারা বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করতেন) ওদের বাড়ির সামনে মানুষটা মরে পড়ে আছে, গুলিতে গুলিতে বুকটা ঝাঁঝরা। পাকিস্তানী সেনারা কুকুরের মত গুলি করে মেরেছে ওকে, বেচারার চেহারায় বিস্ময় আর অবিশ্বাসের ছাপটা তখনো স্পষ্ট, যেন এভাবে বিনা কারনে মরে যাওয়াটা মেনে নিতে পারছে না। ফতেহ আলীর মনে পড়ে গেল ২য় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত দ্য ট্রেইন সিনেমার একটা দৃশ্যের কথা। ফ্রেঞ্চ গেরিলারা ফ্রেঞ্চ চিত্রকর্ম আর আর্টিফ্যাক্ট লুট করে নিয়ে যাওয়া জার্মান সেনাদের ট্রেনে হামলা চালিয়ে যখন তাদের কুপোকাত করতে সক্ষম হলো, তখন একমাত্র বেঁচে থাকা জার্মান কমান্ডার কর্নেল ভ্যান ওয়াইল্ডহাম গেরিলা ল্যাভিশেকে তাচ্ছিল্যভরা সুরে বলেছিল, ইউ আর নাথিং ল্যাভিশে, নাথিং বাট আ লিম্প অফ ফ্লেশ। বিউটি বিলংস টু দোজ হু ক্যান এপ্রিশিয়েট ইট, ইউ পিপল নট ইভেন ডিজার্ভ ইট।
সেই ট্রেনে থাকা ফ্রেঞ্চদের লাশের মধ্যে একটা ১৫-১৬ বছরের ফুটফুটে কিশোরী ছিল। চেহারায় তখনো অসহায় আকুতি, বোঝাই যাচ্ছে তাকে নির্যাতন করে মেরেছে জার্মান নরপশুরা।মাথায় আগুন ধরে যায় ল্যাভিশের, সাথে সাথে ফায়ার করে জার্মান কমান্ডারের দিকে। পিকাসো কিংবা ভিঞ্চির অসামান্য চিত্রকর্ম না, ল্যাভিশেকে ধাক্কা দিয়েছিল জার্মান কমান্ডারের টিটকারীতে মিষ্টি কিশোরীর নিষ্পাপ মুখটা। ভিস্তিওয়ালার নিষ্প্রাণ দেহটা দেখতে দেখতে আচমকাই সেই ফ্রেঞ্চ কিশোরীর চেহারা ভেসে ওঠে ফতেহর মনে, দুই চেহারায় কোন পার্থক্য পেলো না। সাথে সাথে তার চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো, ফ্রেঞ্চ গেরিলা কমান্ডারের মতই ফতেহ সিদ্ধান্ত নিল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবে, নিরীহ নিরপরাধ মানুষগুলোর হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
ফতেহ আলী একলা ছিল না। ২৭ তারিখ সকালে কারফিউ ওঠার পরেই বের হয়ে গিয়েছিল বদিউল আলম, শহিদুল্লাহ খান বাদল, আশফাকুস সামাদ আশফি আর মাসুদ ওমর। নাসিরুদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু প্রথমে পায়ে হেঁটে যায় কুমিল্লা, সেখানে খবর পায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে মিরেরসরাই, পায়ে হেঁটেই চলে যায় চট্টগ্রামের মিরেরসরাইয়ে। অবশেষে ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাম্পের খবর পেয়ে আগরতলা হয়ে চলে যায় মতিনগর।
আরও হাজির হয় মানিক, মাহবুব, আসাদ( রাইসুল ইসলাম আসাদ, অভিনেতা)। এপ্রিলের শুরুর দিকে চলে আসে জিয়া( জিয়াউদ্দিন আলী আহমেদ, বীর বিক্রম) , হাবিবুল আলম বীর প্রতীক, দুই জমজ ভাই মুনির আর মিজান, শ্যামল, শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণ এবং মেজর কাইয়ুম। তারপর শেষমেষ হাজির হয় ফতেহরা, মায়া (মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া)- কে মতলব থেকে তুলে নিয়ে সোনামুড়া বন্দর হয়ে আগরতলা হাজির হয় ফতেহ, কাজী কামাল, গাজি (গোলাম দস্তগীর গাজী), সিরাজ, জুয়েল(আবদুল হালিম চৌধুরী জুয়েল) ।
মতিনগর ক্যাম্পে গেরিলাদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন মেজর এটিএম হায়দার। সেক্টর কমান্ডার কর্নেল খালেদ মোশাররফের রাশভারী গুরুগম্ভীর ব্যাক্তিত্ব আর মেজর হায়দারের কড়া শাসনে-স্নেহের সম্মিলনে আন্তরিক ও নিখুঁত প্রশিক্ষণে ফতেহ আলী চৌধুরীরা হয়ে উঠলো একেকটা বারুদের টুকরো। সদারসিক সদালাপী ফতেহ ছিলেন হায়দারের বেশ প্রিয়। জুনের শুরুতে প্রথম পর্বের গেরিলাদের ট্রেনিং শেষ হবার পর তাদের পাঠানো হয় ঢাকায়। ১৭ জন গেরিলার এই দলটিই কাঁপিয়ে দেয় দখলদার পাকিস্তানী সেনাদের অন্তরাত্মা। খালেদ মোশাররফ বলেছিলেন, ঢাকার আশেপাশে কোথাও প্যানিক সৃষ্টির চেষ্টা করতে যেন পাকিস্তানী সেনারা সবকিছু ঠিকঠাক আছে এমন কোন প্রচারণা চালাতে না পারে। কিন্তু গেরিলারা সরাসরি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বাইরেই হামলা চালিয়েছিল, হতভম্ব এবং বিস্মিত খালেদ বলেছিলেন, দিস আর অল ক্র্যাক পিপল। সেই থেকেই এই গেরিলা দল ক্র্যাক প্লাটুন নামে অভিহিত হতে থাকে।
সেই ক্র্যাক প্লাটুনের অন্যতম প্রধান গেরিলা ছিলেন ফতেহ আলী। ছিলেন বিভিন্ন গেরিলা দলের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী কিংসপিন। অংশ নিয়েছিলেন প্রথম পর্বের প্রায় সকল গেরিলা অপারেশনে। তার দুই ভাই সাংবাদিক ও সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী ও ডা. মোরশেদ চৌধুরীও ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। শাহাদত চৌধুরী শুরু থেকেই ছিলেন হেডকোয়াটার থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে সংযোগ রক্ষাকারী অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুক্তিযোদ্ধা। মোরশেদ চৌধুরী আগরতলার মেলাঘরে ৪৮০ শয্যাবিশিষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দিতেন।
২৯ আগস্ট পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়ে ঢাকায় অপারেট করা সবগুলো ইউনিট, পাকিস্তানীদের হাতে নিখোঁজ ও শহীদ হন রুমি, বদি, জুয়েল, আলতাফ মাহমুদ, বকর, আজাদ, হাফিজসহ অনেকেই। ফতেহ আলী চৌধুরীদের হাটখোলার বাসাটা ব্যবহৃত হত মুক্তিযোদ্ধাদের হাইডআউট হিসেবে। সেখানেও অভিযান চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার করে পাকিস্তানীরা, ধরে নিয়ে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের। এরপরেই ফতেহ আলীসহ বাকি গেরিলাদের ফিরিয়ে নেয়া হয় মেলাঘরে, সেখান থেকে পাঠানো হয় নতুন দল। নভেম্বরে গেরিলাদের বিচ্ছিন্ন দলগুলোকে একত্র করে ঢাকা দখলের চূড়ান্ত লড়াই শুরু করেন ফতেহ আলী চৌধুরীসহ গেরিলা কমান্ডারেরা।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানীরা আত্মসমপর্ণ করার পর ফতেহ আলী চৌধুরী তৈরি করলেন আরেক ইতিহাস। ১৭ ডিসেম্বর সকালে ফতেহ ও হাবিবুল আলম রেডিও স্টেশন দখল করলেন, পাক বেতার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ বেতারের যাত্রা শুরু হলো। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে কর্নেল হায়দার বিশেষ ঘোষণা পাঠ করলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। হায়দারের নির্দেশে সন্ধ্যায় ডিআইটি ভবন ঘেরাও করে দখলে নিল গেরিলারা।
এরপরে টেলিভিশন সেন্টারে মেজর হায়দারের নির্দেশে পর্দায় বড় বড় করে লেখা উঠলো বাংলাদেশ টেলিভিশন। শুরু হলো স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম টেলিভিশন চ্যানেলের যাত্রা। গেরিলা বাহিনীর প্রতি মেজর হায়দারের নির্দেশাবলী ডিসপ্লে আকারে প্রচারিত হতে থাকলো স্ক্রিনে। তারপর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখা গেল ফতেহ আলী চৌধুরীকে। বিশেষ ঘোষণা পড়ছেন তিনি, এরপরেই আসলেন মেজর হায়দার, পাঠ করলেন বিশেষ নির্দেশাবলী। তৈরি হলো নতুন ইতিহাস।
প্রদর্শনবাদীতার এই যুগে ক্যামেরায় চেহারা দেখাতে পারলেই বর্তে যায় মানুষ। সামান্য কোন কাজও বিশাল আড়ম্বরে আমিত্ববাদের সাথে প্রচার করতে থাকে নিরলস প্রচেষ্টায়। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ব্যাক্তি হিসেবে প্রথমবারের মতন টেলিভিশনে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা পাঠকারী ফতেহ আলী চৌধুরীকে শেষবারের মতন টেলিভিশনে বা জনসম্মুখে ক্যামেরার সামনে দেখা গিয়েছিল সেই একাত্তরের ১৭ ডিসেম্বরেই। এরপর হঠাৎ করে তিনি হারিয়ে গেল, চলে গেল আড়ালে। যুদ্ধটা তার দায়িত্ব ছিল, সেটা ঠিকঠাক পালন করা হয়েছে, দেশ শত্রুমুক্ত হয়েছে, ব্যস! নিজের কীর্তি প্রচার করা তো দূরে থাক, গত অর্ধশত বছরে কেউ তার ঠিকঠাক একটা ইন্টারভিউও নিতে পারেনি, এমনভাবেই নিজেকে সাবধানে সরিয়ে রেখেছিলেন তিনি।
এই অধমের সৌভাগ্য হয়েছিল তার সাথে সামনাসামনি কথা বলবার। নতুন প্রজন্মের কাছে দেশকে শত্রুমুক্ত করবার ইতিহাসটা তার বলা উচিত এমনটা বলতেই এক বিচিত্র ক্ষোভ বেরিয়ে আসে তাঁর ভেতর থেকে, হু অ্যাম আই? আমি কেন? আমার সাক্ষাৎকার কেন নিতে চাচ্ছ তোমরা? আই এম নট অ্যা হিরো। সত্যিকারের হিরো দেখতে চাও? সত্যিকারের হিরো ছিল তরু ওস্তাদ, মুনির ওস্তাদ, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুর্ধর্ষ সেনা ছিল তারা। সেক্টর টু-এর হাজার হাজার গেরিলা যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছে ওরা, পাকিস্তানির সেনাদের সাথে চোখে চোখ রেখে ফাইট করছে। আজকে তারা কই? গ্রাম-বাংলার হাজার হাজার গ্রামে এমন অসংখ্য আনসাং(Unsung) হিরো আজ অবর্ণনীয় দুঃখ- কষ্ট যন্ত্রণায় জীবন কাটাচ্ছে , যারা সত্যিকারের বীর ছিল। পারলে তোমরা তাদের কাছে যাও, সাক্ষাৎকার নিতে হলে তাদের সাক্ষাৎকার নাও। এখানে কি চাও তোমরা?
এক মুক্তিযোদ্ধা ভয়ংকরভাবে আহত হয়েছিল, গুলিতে তার পেট ঝাঁজরা হয়ে গেছে, তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করছিলাম, আপনার কিছু বলার আছে? আপনার পরিচয় দেন, আপনার বাড়ি কই? ঠিকানাটা বলেন। ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় কোনমতে সে বললো, দুই নাম্বার সেক্টরেই আমার ভাই যুদ্ধ করে। ছোট বেলা থেকে সে আমারে ভিতু বইলা ক্ষেপাইত, বাপ-মা বহুত আফসোস করত আমার সাহস নাই বইলা। আপনি তারে খুঁজে বের করবেন। তারে বলবেন, আমি একলা কাভারিং ফায়ার দিছি, প্লাটুনের সবাই বাঁইচা গেছে। আপনি তারে বলবেন, আমি যুদ্ধ করতে করতে মারা গেছি। আমি ভয় পাই নাই। কথাটা শেষ করে সে আমার কোলেই মারা গেল।
তোমরা এই ধরনের অসংখ্য আনসাং হিরোদের বের করো। হোয়াই মি?হোয়াই মি? সুবেদার ওয়াহাবের কথা লিখ, শহীদ সুবেদার বেলায়েতের কথা লিখো, হারকিউলিসের মত বীরত্ব দেখাইছিল বেলায়েত, জাস্ট ওর একলার বীরত্বে সালদা নদী স্টেশন ঘাঁটি ছেড়ে প্রানটা হাতে নিয়ে পালাইছিল পাকিস্তানীগুলা, পেছনে ফিরে তাকানোর সাহসটা পর্যন্ত ছিল না। তোমরা ওদের বীরত্বগাথা তুলে আনো… ।
টর্চার সেলে ভয়ংকর নির্যাতন করা হয়েছিল রুমিকে, কিন্তু কোন তথ্য দেয় নাই রুমি, চোখে চোখ রেখে শুধু বলছিল, “You people are going to die. You can’t flee, you can’t leave-Nobody can save you- I can tell you this much”। ভয়ংকর মার খেয়েও বদি ঠাণ্ডা গলায় বলছিল, আমি কিছুই বলব না, যা ইচ্ছা করতে পারো। ইউ ক্যান গো টু হেল… ওদের কথা বলো, আমার সাক্ষাৎকার নেয়ার কি হল? জীবন দিল জুয়েল, মরে গেল বকর, আর আমি এখন নিজেকে বীর বলে বাহাদুরী করবো? তোমরা ভাবছটা কি?
সেপ্টেম্বরে গেরিলাদের পরবর্তী দলটাকে পাঠানো হবে ঢাকার আশেপাশের থানাগুলোতে, আড়াইহাজার, নারায়নগঞ্জ, ত্রিমোহনী। তিনটা সেকশনে বিভক্ত করে তিন জন কমান্ডার চূড়ান্ত করা হল। মায়া, গাজি আর ফতেহ আলী। মেজর এটিএম হায়দার তাদের ইন্সট্রাক্ট করতে বর্ডার চলে এলেন। অস্বাভাবিক গম্ভীর আর বিষণ্ণ হায়দার, ডাকলেন, ” ফতেহ , কাছে এসো”। ফতেহ সামনে এগিয়ে গেল, পিঠে হাত রেখে বিষাদে ঢাকা গলায় হায়দার বললেন, তোমার মনে আছে, একদিন তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি সবচেয়ে ভালবাসো কাকে? ফতেহ বলল, জি স্যার, মনে আছে। হায়দার বলে চলেন, “তখন তুমি বললে, নিজের জীবনকে তুমি সবচেয়ে বেশি ভালবাসো। কিছুটা অদ্ভুত লেগেছিল, কেউ তো এভাবে সরাসরি বলে না। বললাম, তাহলে যুদ্ধে এলে কেন? তুমি বলছিলা, সেইটা বাংলাদেশকে দিতে”। বলতে বলতে বুকে টেনে নিলেন ফতেহকে, শক্ত করে চেপে ধরলেন। ভারী গলায় হুকুম দিলেন, “জাস্ট ডোন্ট ডাই, দ্যাটস মাই অর্ডার”। বাধ্য সোলজারের মতো ফতেহ বলল, ইয়েস স্যার…
নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু নিজের প্রাণটা দেশের জন্য বিলিয়ে দিতে যে তরুণ ফতেহ আলী মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সহযোদ্ধা আর প্রিয়জনদের চোখে সামনে হারিয়ে যেতে দেখে তাদের স্মৃতি বুকে চেপে যে ফতেহ নিজেকে সরিয়ে রেখেছিল নীরবে নিভৃতে, তার যুদ্ধ আজ শেষ হলো।
And now his watch has ended…
তথ্যসূত্রঃ ১। টু স্যার উইথ লাভ- ফতেহ আলী চৌধুরী
২। এক সৈনিকের জন্য বীরত্বগাঁথা- ফতেহ আলী চৌধুরী
লেখক: অ্যাক্টিভিস্ট
সারাবাংলা/এসবিডিই