অগ্নিঝরা মার্চ, রোদনভরা বসন্ত আমাদের
৪ মার্চ ২০২৪ ১৫:১৯
বাংলাদেশ নামের দেশটির জন্ম ইতিহাসে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তৃতীয় মাস- মার্চ। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই মাসটি ঋতুরাজ বসন্ত। আর বাঙালির মুক্তির ইতিহাসে অগ্নিঝরা-রক্তঝরা-অশ্রুঝরা-রোদনভরা বসন্ত আমাদের এই মার্চ মাসটি। একাত্তরের এই মাস গৌরব আর শোকের অবিমিশ্রিত মরমে মাখা। স্বাধীনতার গৌরব, বীরের রক্তস্রোত আর লাখো মায়ের অশ্রুঝরার মাস এই মার্চ। সব পেরিয়ে স্মৃতিবহুল এই মাসটি বাঙালির গৌরব, অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস।
একাত্তরের মার্চের সঙ্গে জড়িয়ে আমাদের স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাসের অনেকটুকুই। একাত্তরের এই মাসেই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। প্রতিবাদে-প্রতিরোধে ফেটে পড়েছিল বাঙালি। দুই শতকের ইংরেজ শাসন আর দুই দশকেরও বেশি সময়ের পাকিস্তানি শাসন-শোষণের ইতিহাস পেরিয়ে এই মাসেই বাঙালি জেগে উঠেছিল ফিনিক্স পাখির মতো। রক্তের সাগরে ভেসে আদায় করে নিয়েছিল নিজের স্বাধিকার, অর্জন করেছিল স্বাধীনতা।
একাত্তরের মার্চে যে রাজনৈতিক সংঘাতকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, তার গোড়াপত্তন হয়েছিল আরও অনেক আগে। সাতচল্লিশে যে তত্ত্বকথার ওপর ভিত্তি করে ১২শ মাইলের বেশি দূরত্বে থাকা সামাজিকভাবে দুটি পরস্পরবিরোধী দেশকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল সেই তত্ত্বটি অসার প্রমাণিত হয়েছিল তথাকথিত সেই স্বাধীনতার কয়েক বছরের মধ্যেই। ফলশ্রুতিতে শুরু থেকেই বিভেদ, বৈষম্য, অশান্তি প্রকট আকার ধারণ করেছিল। বিভেদ বেড়ে কয়েক বছরের মধ্যেই নিগৃহীত বাঙালির আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে। আটচল্লিশের ২৪শে মার্চ পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার প্রক্রিয়া শুরু হয়- যার ফলশ্রুতিতে সংগঠিত হয় ৫২’র ভাষা আন্দোলন। এরপর একে একে ১৯৬২ সালে বৈষম্যমূলক শিক্ষানীতি প্রত্যাখ্যান, ৬৬’র শিক্ষা আন্দোলন ও ছয় দফা উপস্থাপন, ৬৮’র আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯-এর গণআন্দোলন ও ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, ৭০ এর সাধারণ নির্বাচন ও বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব- এতোসব ঘটনাবলী পেরিয়ে আসে একাত্তরের মার্চ মাস।
একাত্তরের বসন্ত এসেছিল ঘটনাবহুল হয়েই। একের পর এক রাজনৈতিক ঘটনাবলী ঘটে চলেছিল সত্তরের আলোচিত নির্বাচনের পর থেকেই। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর সামরিক শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা টালবাহানা করতে থাকে। উদ্দেশ্য স্পষ্ট, ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে রাখা। মার্চের প্রথম দিনটিতে ক্ষমতা হস্তান্তরের লক্ষ্যে ৩ মার্চ ঢাকায় ডাকা জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত করে সামরিক সরকার। এর প্রতিবাদে গর্জে ওঠে গোটা দেশ। ঢাকায় শুরু হয়ে যায় প্রতিরোধ আন্দোলন। হাজার হাজার মানুষ মিছিল করে হাজির হয় হোটেল পূর্বানীর সামনে। সেখানে তখন বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে চলছিল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল বৈঠক। সেই বৈঠকের মাঝে উপস্থিত হয়ে উত্তেজিত জনতা বঙ্গবন্ধুর কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার দাবি জানান। বঙ্গবন্ধু জনতাকে সংযত থাকতে উপদেশ দেন এবং ৭ মার্চ পর্যন্ত প্রতিবাদ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। সেদিন তিনি এ-ও বলেন ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে জাতির উদ্দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতি নির্ধারণী ঘোষণা দেবেন।
পরের দিন ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্র নেতারা। ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করেন। সেই ঘোষণা অনুযায়ী ৪ মার্চ দেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। সকল ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। ৫ মার্চ আওয়ামী লীগ ঢাকায় লাঠি মিছিলসহ বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করে। এই দিনে দেশের শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং পেশাজীবীরা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে শপথ গ্রহণ করেন। ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন, ৩ মার্চের স্থগিত করা জাতীয় পরিষদ অধিবেশন বসবে ২৫ মার্চ। কিন্তু এরপরও আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো অসহযোগ আন্দোলন পুরোপুরি চালিয়ে যেতে থাকে।
এরপর আসে ঐতিহাসিক সেই ৭ মার্চ। উত্তপ্ত মার্চের এই দিনে রমনার রেসকোর্স ময়দানের জনসমুদ্রে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, শতাব্দীর মহাপুরুষ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা পৃথিবী কাঁপানো ভাষণের টগবগে রক্তে আগুন জ্বলা বজ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ১৮ মিনিটের ঐতিহাসিক সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদেরকে স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যত ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল- ঐতিহাসিক মার্চের এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণটি ছিল একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় বার্তা। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণটি ছিল মূলত বাঙালির মুক্তির আন্দোলনের একটি স্পষ্ট দিকনির্দেশনা। উত্তাল মার্চে মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন- যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতার সম্যক ধারনা এত প্রগাঢ় ছিল যে, তিনি কোনও অবস্থাতেই একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করে আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের তকমা লাগানোর সুযোগ দেননি। কারণ দেশে দেশে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের ব্যর্থতা এবং এসব আন্দোলনের আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলেও, শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের সকল প্রস্তুতির সার্বিক দিক নির্দেশনা দিলেও পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ঘোষণা আনুষ্ঠানিকতাটি বাদ রাখেন। ২৫ মার্চের রাতে জাতি যখন পাকিস্তানিদের একতরফা যুদ্ধের শিকার হয় তখনই ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
একাত্তরের বসন্তেই বাঙালিরা হানাদার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এই মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের মাস- বাঙালির আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নিজের অধিকার দাবির মাস। বাঙালির স্বপ্ন দেখার মাস। সেই স্বপ্নে অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালির স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্য পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাস। সশস্ত্র প্রতিরোধের মাস এই মার্চ। বাঙালির আত্মত্যাগের মাস মার্চ। একাত্তরের বসন্তেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া প্রকম্পিত করে বাঙালি গর্জে উঠেছিল- ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘জয়বাংলা- জয়বাংলা’। এই মার্চেই গাঢ় সবুজের মধ্যে রক্তিম সূর্য সম্বলিত বাংলাদেশের স্বর্ণালি মানচিত্রখচিত নতুন পতাকা উড়েছিল বাংলার আকাশে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে, আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণার মাস এই মার্চ।
এই মার্চেরই ভয়াল কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অস্ত্র, গোলা, ট্যাঙ্ক-কামান নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। মেতে উঠেছিল নির্মম গণহত্যায়। অগ্নিঝরা রক্তঝরা উত্তাল অগ্নিগর্ভ এই ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ রক্তিম মার্চেই বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল। এই মার্চেই শুরু হয়েছিল রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এই মার্চের কোকিল ডাকা রক্তিম পলাশ-শিমুল ফোটা উত্তাল এই বসন্তের দখিনা বাতাসে জ্বলে উঠেছিল বিক্ষুব্ধ বাংলা বর্ণমালার চার অক্ষরের একটি অতি প্রিয় শব্দ ‘স্বাধীনতা’। এই শব্দটির জন্য আমরা ভেসেছিলাম রক্তের সাগরে, লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে আর কোটি মানুষের ত্যাগের মাধ্যমে পেয়েছিলাম নিজেদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। স্বাধীনতা অর্জনের তিন মাসের মধ্যে বায়াত্তরের এই চৈতালি বসন্তে আমরা বিদায় জানিয়েছিলাম আমাদের বিপদের বন্ধু, একাত্তরের রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে।
এই মার্চে, এই বসন্তেই জন্ম এমন এক মহামানবের যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। আমরা একটি নতুন পতাকা পেতাম না, একটি মানচিত্র পেতাম না, একটি জাতীয় সংগীত পেতাম না। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সেই বাঙালি, শতাব্দীর মহাপুরুষ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন ঋতুরাজ বসন্তে।
মার্চ মাস বীর বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক ‘অগ্নিঝরা মার্চ’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে এবং থাকবে। একাত্তরের সেই আগুনঝরা, রক্তঝরা সেই বসন্ত এসেছিল সময়ের প্রয়োজনে। বাঙালিকে নিয়েছিল তার পরম কাঙ্খিত, স্বপ্নের স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। এই মার্চ বাঙালির অবিমিশ্রিত অনুভূতির মাস। রক্তে ভেসে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখার মাস এই মার্চ। অগ্নিঝরা এই মার্চ, রোদনভরা বসন্ত আমাদের।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী
সারাবাংলা/এসবিডিই