Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সংগঠন ও সংগঠনের নেতৃত্ব: প্রসঙ্গ বেসিস নির্বাচন

নাজনীন নাহার
১৩ মার্চ ২০২৪ ২৩:৫৫

২০০৩ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি (বিসিএস) আয়োজিত কম্পিউটার মেলায় প্রথম প্রকাশ ও বাজারে আসে থ্রিডি গেম ঢাকা রেসিং। এটি বাংলাদেশে প্রথম ত্রিমাত্রিক বা থ্রিডি গেম। আমার জানামতে, ওই সময়ে আমার সঙ্গে যারা সাংবাদিকতায় ছিলেন তারা সবাই কম-বেশি এই বিষয়টি নিয়ে লিখেছেন।

২০০২ সালে বাংলাদেশের সফট-এডজ লিমিটেড নির্মিত প্রথম ত্রিমাত্রিক অ্যানিমেশনে তৈরি ধারাবাহিক কার্টুন ‘মন্টু মিয়ার অভিযান’ সম্পর্কেও জানি সেই মেলা থেকেই। ওই সময়ে বাংলাদেশি দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগানো ও ইটিভিতে প্রচারিত দর্শকপ্রিয় এই কার্টুনটি পরে আন্তর্জাতিকভাবে একাধিক পদক ও সম্মাননা লাভ করে।

বিজ্ঞাপন

গল্পগুলো বললাম সংগঠনের আয়োজনগুলোর গুরুত্ব বোঝাতে। সময় বদলেছে। গেম এবং অ্যাপও তৈরি হয়েছে অনেক। কিন্তু ২০ থেকে ২২ বছরে এই শিল্প খাতের গুণগত উন্নয়ন কতটা হয়েছে?

একটা সময় বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির (বিসিএস) মেলা ছিল আমাদের কাছে ভীষণ আর্কষণীয়। বছরজুড়ে অপেক্ষা থাকত কখন মেলা হবে। মেলায় নতুন কী প্রযুক্তিপণ্যের প্রদর্শনী হবে, কোন পণ্য কতটা ভালো হবে, কোন পণ্যের ওপর বিশেষ ছাড় থাকবে— এসব বিষয় নিয়েই মেলাগুলোর প্রতি প্রত্যাশা থাকত বেশি।

আরও পড়ুন- বেসিসের লেনদেনে অনিয়মের অভিযোগ, ইজিএম না করেই অডিট ফার্ম বদল

একইভাবে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) আয়োজিত বেসিস সফটএক্সপোও ছিল আমাদের কাছে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি আয়োজন। দেশের সফটওয়্যার খাত কতটা এগুতে পারল, ইআরপি ছাড়া কোন কোম্পানি নতুন কী সফটওয়্যার বানাল, কয়টি দেশীয় অ্যাপস প্লেস্টোরে আপলোড হলো, নতুন কোনো গেমস আমরা বানালাম কি না, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বানানো রোবটটির কতটা উন্নতি হলো— এ রকম আরও কত কী ছিল আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে! এর বাইরেও আমার কাছে বেসিস সফটএক্সপোতে বিশেষ আগ্রহ ছিল বি-টু-বি সেশনগুলো নিয়ে। কতগুলো বিদেশি কোম্পানি এলো, কতগুলো দেশীয় প্রতিষ্ঠান সফলভাবে মিটিং করে উপকৃত হলো বা কত টাকার ক্রয়াদেশ পেল— এগুলো ছিল প্রতিবেদনের মূল বিষয়।

বিজ্ঞাপন

এখনো বেসিসের মেলায় বি-টু-বি সেশন হয়, তবে আগের মতো নয়। এখন মেলা শেষে জানা যায় না কোন প্রতিষ্ঠান কোন দেশ থেকে কত টাকার পণ্যের ক্রয়াদেশ পেল বা পেল ক্রয়ের আশ্বাস। আয়োজনের উদ্দেশ্য এখন ভিন্ন। এক বিলিয়ন রফতানির বাংলাদেশ থেকে সময়ের ধারাবাহিকতায় আমরা পাঁচ বিলিয়নের স্বপ্নে এসেছি, কিন্তু আবেদন হারিয়েছে আয়োজনগুলো!

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে অ্যাসোসিয়েশনগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। বিসিএস, বেসিস ও আইএসপিএবিসহ তুলনামূলক তরুণ সংগঠন বাক্কো বা ই-ক্যাব— প্রতিটি সংগঠনই নিজ নিজ খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। শিল্প খাতের উন্নয়ন ও সদস্যদের স্বার্থ সুরক্ষাসহ ব্যবসায়িক সমস্যা দূরী করা এবং নীতি নির্ধারণে সরকারকে পরামর্শ দিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সংগঠনগুলোর অন্যতম দায়িত্ব।

এই খাতের সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো বিসিএস, যার বয়স ৩৬-এর বেশি। বেসিসও তাদের ২৫ বছর পূর্তি পালন করেছে। পরিপক্ক এই দুই সংগঠনের কাছে তাই সবার প্রত্যাশাও বেশি। এ বছর, অর্থাৎ ২০২৪ সাল হলো নির্বাচনের বছর। জাতীয় পর্যায়ের সংসদ নির্বাচন দিয়ে বছর শুরু হয়েছে। বছরের শুরুর ভাগেই আছে বিসিএস, বাক্কো ও আইএসপিএবিসহ বেসিসের নির্বাচন। যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশে নির্বাচনের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাই এই নিয়ে সদস্যদের আগ্রহ বরাবরই বেশি।

কিন্তু এবারের নির্বাচন ইস্যুতে পুরোনো দুই সংগঠন বিসিএস ও বেসিস জড়িয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন জটিলতায়। বিসিএস নির্বাচন আপাতত স্থগিত। আর বেসিস এখন আলোচনার শীর্ষে। সদস্যপদ বাতিল করে আবার বাধ্য হয়ে ফিরিয়ে দেওয়া, ইসি সদস্যদের অনুমতি ছাড়াই অডিট ফার্ম নিয়োগ আর অডিট করানো বা প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক ব্যাখ্যা না দেওয়ার ঘটনাগুলো সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে বেসিস অফিসে চুরি! চুরির মামলা শুনলাম গড়াবে ডিবি পর্যন্ত। সবকিছু মিলিয়ে এই খাতে অবদান রাখা নিয়ে বেসিসের প্রতি আমাদের যে প্রত্যাশার জায়গা ছিল, সেই জায়গাটি থেকে বেসিস অনেকটাই সরে গেছে বলে আমার মনে হচ্ছে।

এ ছাড়াও সংগঠনগুলোর বর্তমান নেতৃত্বের মধ্যে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার এক ধরনের মানসিকতা এবং সংগঠনের সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে ব্যক্তি স্বার্থ উদ্ধার করার প্রবণতা স্পষ্ট। এর কারণটা স্পষ্টভাবে আমরা সবাই জানি। লবিং বা টেন্ডারভিত্তিক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের যৌথ মেলবন্ধন এবং নেতৃত্বের বিকাশে আমরা হারালাম সংগঠনগুলোর চিরচেনা রূপ। ফলস্বরূপ সংগঠনগুলো হয়ে পড়ল অবকাঠামোগতভাবে দুর্বল। ফলে সরকারি নীতি-নির্ধারণীর বিভিন্ন পর্যায়ে এখন আর গুরুত্ব দেওয়া হয় না সংগঠনের মতামতকে।

সেদিন একজন প্রতিমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘সংগঠনগুলো সরকারের প্রশংসা এমনভাবে করে যে আমরা দলের লোক হয়েও লজ্জা পেয়ে যাই!’ ক্ষমতার প্রতি সবার এতটা আগ্রহের কারণও আমাদের কাছে পরিষ্কার। বর্তমানে সংগঠনের সদস্যদের স্বার্থ হারিয়ে গেছে ব্যক্তি স্বার্থের কাছে। নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতা নেমে এসেছে ব্যক্তিগত কাঁদা ছোড়াছুড়ির পর্যায়ে। দূরে সরে যাচ্ছেন যোগ্য নেতারা। কারণ সবাই তো আর কাঁদা ছুড়তে পারেন না। এই অধঃপতনের ফলাফলই আজ দৃশ্যমান।

নির্বাচনে পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে, এটা স্বাভাবিক বিষয়। পরিস্থিতি বা প্রেক্ষাপটে এটা ভাবা যেতে পারে যে বর্তমান কমিটিকে কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। তাহলে ইসি কমিটির উচিত বিষয়গুলো সদস্যদের অন্তত সঠিকভাবে জানানো বা ব্যখ্যা দেওয়া। তাহলেও বিষয়গুলো নিয়ে সবার ধারণাগুলো স্পষ্ট হয়। আর বেসিস সদস্যদের ফেসবুক গ্রুপের আলোচনায় কিন্তু মনে হয় না ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মিথ্যা বা নেহায়েতই গুজব বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

পরিশেষে বলব, সময় এসেছে গুছিয়ে নেওয়ার। সময় এসেছে নিজেদের দায়িত্ব ও করণীয়কে বুঝবার। দেশকে এগিয়ে নিতে বেসরকারি খাতের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের জায়গায় নিজেরা যোগ্যতার সঙ্গে থাকতে না পারলে একটা সময় নিজেদের উন্নয়নে, নিজেদের দাবি আদায়ে কথা বলাটা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়বে। তাই সময় এসেছে ঘুড়ে দাঁড়ানোর।

আমাদের সরকার কিন্তু যথেষ্ট স্মার্ট। তারা জানে সংগঠনের সঙ্গে কী করা দরকার। তাই সরকারের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে সংগঠনকেও হতে হবে স্মার্ট। কারণ উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞ, আজ দেশ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখান থেকে সরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ নেই।

তাই আশা করব, বেসিসের বর্তমান ইসি বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে দেখবে এবং সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাধানের মাধ্যমে তাদের যোগ্যতার পরিচয় দেবে। পাশাপাশি বিধি অনুযায়ী নিরীক্ষা প্রতিবেদনের সমস্যাটিরও সমাধান ইসি সদস্যরা করবেন এবং সুন্দরভাবে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন তারা উপহার দেবেন— এটিই প্রত্যাশা। নির্বাচনে সদস্যদের আন্তরিক অংশগ্রহণ ভীষণ জরুরি। ভোট এক ধরনের উৎসব। তাই জটিলতাগুলো নিরসন করে ঘনিয়ে আসা বেসিস নির্বাচনকে উৎসবমুখর করা বর্তমান ইসিরই দায়িত্ব।

লেখক: তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সাংবাদিক ও সভাপতি, বাংলাদেশ আইসিটি জার্নালিস্ট ফোরাম (বিআইজেএফ)

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

আইসিটি খাত তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিসিএস বেসিস বেসিস নির্বাচন

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর