পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ডিসিরা কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবেন?
১৫ মার্চ ২০২৪ ১৭:৩৬
চার দিনব্যাপী জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলন ৩ মার্চ থেকে শুর হয়ে ৬ মার্চ শেষ হয়েছে । এবারের ডিসি সম্মেলনে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনারদের কাছ থেকে আসা ৩৫৬টি উন্নয়ন ও সংস্কার প্রস্তাব আলোচনায় উঠছে। প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলোয় জনসেবা বাড়ানো, জনদুর্ভোগ কমানো, রাস্তাঘাট ও ব্রিজ নির্মাণ, পর্যটনের বিকাশ, আইনকানুন বা বিধিমালা সংশোধন, জনস্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করা হয়েছে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, এবারের সম্মেলনের বিশেষত্ব হলো নতুন সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার বাস্তবায়নে ডিসিদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া যা সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এ নির্দেশনা দিয়েছেন।
এবার সম্মেলনে ৩০টি অধিবেশন হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে কার্য-অধিবেশন ২৫টি। এছাড়া একটি উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, স্পিকারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ নিয়ে একটি এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ, নির্দেশনা গ্রহণ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে দুটি অধিবেশন হবে। কার্য-অধিবেশনগুলোয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগের মন্ত্রী/উপদেষ্টা/প্রতিমন্ত্রী/সিনিয়র সচিব/সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। এবার সম্মেলনে ৫৬টি মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থা এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় অংশ নিয়েছিলেন। অন্য বছর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে একটি সেশন থাকলেও এবার রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বিদেশে থাকায় সেটি সম্ভব হয়ে উঠেনি। এছাড়া সেনাপ্রধান এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। তবে সেনাবাহিনীর অন্য কর্মকর্তাদের সঙ্গে ডিসিদের সৌজন্যে সাক্ষাৎ ও মতবিনিময় হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, এবারের ডিসি সম্মেলনে প্রথমবারের মতো সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিবরা বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসিদের কাছে তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়েছেন। এজন্য শুরুরদিন রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় উন্নয়নে মাঠ প্রশাসন শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছিল। এবারের সম্মেলনে বেশি সংখ্যক প্রস্তাব সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ সংক্রান্ত। এ সংক্রান্ত প্রস্তাব ২২টি। এছাড়া ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যক্রম, স্থানীয় পর্যায়ে কর্মসৃজন ও দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি বাস্তবায়ন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন, তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং ই-গভর্নেন্স, শিক্ষার মানোন্নয়ন ও সম্প্রসরণ, স্বাস্থ্যসেবা পরিবারকল্যাণ, পরিবেশ সংরক্ষণ ও দূষণরোধ এবং উন্নয়নমূলক কাজ বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও সমন্বয় করা।
সাধারণত প্রতি বছর জুলাই মাসে ডিসি সম্মেলনের আয়োজন করার রেওয়াজ রয়েছে। ২০১৯ সালে জেলা প্রশাসক সম্মেলনে প্রথম বারের মতো প্রধান বিচারপতি, তিন বাহিনী প্রধান, জাতীয় সংসদের স্পীকারের সঙ্গে ডিসি ও বিভাগীয় কমিশনাররা বৈঠক করেন। ডিসি সম্মেলনে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে ডিসিদের কার্য-অধিবেশন, এছাড়া একটি উদ্বোধন অনুষ্ঠান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মুক্ত আলোচনা, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত, স্পীকারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত ও একটি সমাপনী অনুষ্ঠান থাকে। কার্য অধিবেশনগুলোতে মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রতিনিধি হিসেবে মন্ত্রী, উপদেষ্টা, প্রতিমন্ত্রী,, সিনিয়র সচিব ও সচিবরা উপস্থিত থাকেন। সম্মেলন উপলক্ষে জেলা প্রশাসক ও বিভাগীয় কমিশনাররা লিখিতভাবে মাঠ প্রশাসনের সমস্যাগুলো নিয়ে প্রস্তাব দিয়ে থাকেন। অধিবেশনের সময় এগুলো ছাড়াও ডিসিরা তাৎক্ষণিক বিভিন্ন প্রস্তাব তুলে ধরেন। এটি একটি রুটিন ওয়ার্ক হলেও এই সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দেশের সার্বিক প্রশাসনিক চিত্র পাওয়া যায় এবং একই সঙ্গে সিভিল সার্ভিসের একজন জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ আমলা হিসেবে জেলা প্রশাসকদের মনোভাব সম্পর্কেও সরাসরি একটি ধারণা পাওয়া যায়।
এবার ৩ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে চার দিনের ডিসি সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেন সেবার মনোভাব নিয়ে সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে যাতে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয় তথা উন্নয়নের দিকে বাংলাদেশ যেন এগিয়ে যায়। বাজার পরিস্থিতি নজরদারি, মজুত ও মূল্যবৃদ্ধি রোধে জেলা প্রশাসকদের কাজ করতে নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে ভেজালরোধে অভিযান পরিচালনা এবং কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত বন্ধে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন সবেচেয়ে বড় কিছু সমস্যা আছে। এখন কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত দেখি। পড়ালেখা করা ছেলে-মেয়েরা কেন এসবে জড়াবে? এটা সবার দেখতে হবে। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবক ও শিক্ষকসহ সবাইকে নজরদারি বাড়াতে হবে। ছেলে-মেয়েরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যায় কি না, নজরদারি বাড়াতে হবে অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে। (কিশোরদের) গ্রেফতার করে লাভ নেই। গ্রেফতার করলে অপরাধীদের সঙ্গে মিশে আরও খারাপ হয়ে যাবে। গোড়া থেকে সমস্যার সমাধান করতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘বাজার পরিস্থিতিরি দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রমজান আসলে কিছু ব্যবসায়ী মজুত করে দাম বাড়িয়ে মুনাফা নিতে চায়। কোথাও যাতে ভোক্তাদের হয়রানিতে পড়তে না হয়, সেদিকে নজর রাখতে হবে। বিদেশনির্ভর না হয়ে নিজেদের উৎপাদনে গুরুত্ব দিতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য যেন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারে, সেটি খেয়াল রাখতে হবে। খাদ্যে ভেজাল দেওয়ার বিষয়টিও দেখতে হবে। রোজা আসলে এটা বেড়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রী মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনকে জনগনকে কর প্রদানে উৎসাহিতকরন ও সচেতনতা সৃষ্টি, জনগনকে সার্বজনীন পেনশন স্কীম গ্রহন,সমবায়ের মাধ্যমে কৃষিকে উৎসাহিত করন,সেচ কাজে স্যোলার প্যালেণের ব্যবহার নিশ্চিত করনের উদ্যোগ গ্রহন ও সমন্বিত বাজার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আহ্বান জানান । পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুপ প্রভাব মোকাবেলায় সচেতনতা সৃষ্টি,ভ‚গর্ভস্ত পানির ব্যবহার রোধ করে জলাধার সংরক্ষন ও এর ব্যবহার নিশ্চিত করন,,লবণাক্ততা প্রেিরাধে ব্যবস্থা গ্রহন ,সুপেয় পানির ব্যবস্থা গ্রহন, ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য নির্দেশনা । ’নির্বাচনে যথাযথ দায়িত্ব পালন করায় জেলা প্রশাসকদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৭৫ সালের পর থেকে যতগুলো ভোট দেখেছি, এবারের নির্বাচন সব থেকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে যারা নির্বাচন চায়নি, তাদের কাছে নির্বাচন হয়তো পছন্দ নাও হতে পারে। কিন্তু সাধারণ মানুষের আগ্রহ বেশি ছিল। বিশেষ করে নারী ও তরুণ ভোটাররা; তারা যে অংশ নিতে পেরেছে নির্বাচনে, এর ক্রেডিট আপনাদের (ডিসি)। এজন্য আপনাদের আবারও ধন্যবাদ জানাই।’
জেলা প্রশাসক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে অর্থ, বাণিজ্য শিল্প, শিক্ষা, খাদ্য, কৃষি, বিমান, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে প্রথম অধিবেশনে। বৈঠকে দেশের বিভিন্ন স্থানে পর্যটনের বিকাশ ঘটানোর ওপরে জোর দেওয়া হয়। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনির আওতায় সুবিধাভোগীরা যাতে সরকারি সহায়তা পান এবং আয়কর আদায়ের ওপরে জোর দেওয়া হয় জেলা প্রশাসক সম্মেলনের আলোচনায়।৪ টা মাচর্ সোমবার সম্মেলনের শুরুতেই বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পর্যটন মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং তার আলোকে পর্যটন শিল্প বিকাশে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি সারা দেশে পর্যটন শিল্প বিকাশে প্রতিটি জেলায় একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও একজন সহকারী কমিশনারকে দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।পর্যটন সম্ভাবনাময় ১৩টি জেলাকে চিহ্নিত করে কার্যক্রম গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা করেন তারা। এরপর ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকে দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেবোত্তর আইন দ্রুত প্রণয়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে মর্মে আলোচনা হয়েছে। মসজিদ, মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানসমূহের ইমাম, মুয়াজ্জিন, পুরোহিত ও অন্যান্যদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় সম্মানী দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
পর্যায়ক্রমে দেশের সব ইমাম ও পুরোহিতকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আর সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আলোচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক প্রকাশনা পাঠের সংস্কৃতি গড়ে তোলার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দেশের বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী ও কর্মকান্ড তুলে ধরে একটি ‘মনীষী জাদুঘর’ তৈরির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। প্রতিটি জেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সঠিকভাবে তুলে ধরার জন্য সমন্বিতভাবে পরিকল্পনা গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থমন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনায় ২০২৬ সালে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তরণে Smooth Transition Strategy প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভাগীয় কমিশনার এবং জেলাপ্রশাসকগণকে সম্পৃক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অর্থ বিভাগের সঙ্গে আলোচনায় রিজার্ভ বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আলোচনা হয়। সর্বজনীন পেনশন স্কিম উদ্যোগকে অধিকতর জনমুখী ও জনপ্রিয়করণের লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় ও জেলা পর্যায়ে টাস্কফোর্স গঠন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি কর্মচারীদের জন্য বিভিন্ন এলাকার আবাসনের ভাড়া নির্ধারণের নীতিমালা প্রণয়ন সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের আলোচনায় আইএমইডি’র ঊচগওঝ (Electronic Project Management Information System) সফটওয়ারে প্রকল্প পরিদর্শন করে জেলা প্রশাসকদের সরাসরি মতামত প্রদানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ।পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের আলোচনায় ভাসমান জনসংখ্যার ডাটাবেইজ তৈরির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।আরো আলোচনা হয়েছে উপজেলা পর্যায়ে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনিসহ দরিদ্র ও অতিদরিদ্রের জন্য গৃহীত প্রকল্পের উপকারভোগী নির্বাচনের সুবিধার্থে জরিপভিত্তিক একটি অনলাইন ডাটাবেজ তৈরিকরণ এবং অনলাইন উপকারভোগী নির্বাচনের ব্যবস্থাকরণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। আর পরিকল্পনা বিভাগের সঙ্গে আলোচনায় কোনো জেলায় বাস্তবায়িত যেকোনো ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নের পূর্বে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভার মতামত গ্রহণের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের আলোচনায় আয়কর পরিষেবা বৃদ্ধির জন্য এক বা একাধিক উপজেলা নিয়ে সার্কেল গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। নকল বা জাল ব্যান্ডরো/স্ট্যাম্প ব্যবহার রোধকল্পে দন্ডবিধি, ১৮৬০-এর ২৬২ ধারা মোবাইল কোর্টের তফসিলভুক্ত করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রয়োজন হলে প্রতি সপ্তাহেই বাজার মনিটরিং করতে জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
মঙ্গলবার (৫ মার্চ) ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের তৃতীয় দিনের চতুর্থ অধিবেশনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্য অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের মন্ত্রী এ কথা জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ডিসিরা আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে তেমন কোনো কথা বলেনি। তারা বিভিন্ন ধরনের কিছু ছোট ছোট পয়েন্ট যেমন মাদকদ্রব্য নিয়ে কথা বলেছেন। অচল বন্দিদের কিভাবে আরও একটু ছাড় দেয়া যায় এবং ভার্চুয়াল কোর্ট যেটা কোভিডের সময় চালু করেছিলাম, সেটা বাংলাদেশের সব জায়গায় চালু করা যায় কিনা। বিশেষ করে জঙ্গিদের আনা নেওয়ার ঝুঁকি থাকে। এই ধরনের কয়েদিদের ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে করা যায় কিনা সেটা নিয়ে তারা বলেছেন। আমরা পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সারা বাংলাদেশে এই কোর্ট চালু করা যায় কিনা সেটা দেখবো বলে জানিয়েছি।’তিনি বলেন, ‘আমাদের সচিবরা কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন, যাতে জেলা পর্যায়ে যে কোর কমিটি রয়েছে। তারা যেন প্রতি মাসে একটি সভা করে। যাতে সবার সঙ্গে একটি সুসম্পর্ক থাকে এবং কোনো অসুবিধা হলে সেগুলো যেন দ্রুত সমাধান করতে পারেন।’স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলেছি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে আমাদের যে নিরাপত্তা বাহিনী কাজ করছেন। ড্রাগ ব্যবহার রোধে জেলা প্রশাসকদের আমি বলেছি, তারা যেন সামাজিকভাবে ব্যবহার রোধ করে। আমরা মাদকের ব্যবহার রোধে যেমন তামাকের, আমরা ধূমপানের বিরুদ্ধে কথা বলছি না। আপনারা নিশ্চয়ই দেখেছেন কেউ প্রকাশ্যে ধূমপান করে না। আমরা সে জায়গাগুলোতে কাজ করার জন্য ডিসিদের বলেছি। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ আমাদের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গিয়েছে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ করেছি তারা যেন প্রতিমাসে এবং প্রয়োজন হলে প্রতি সপ্তাহেই বাজার মনিটরিং করে। যাতে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে থাকে বিষয়ে অনুরোধ করা হয়েছে ।’নদী পথে যত্রতত্র বালু উত্তলন না করে সে বিষয়েও ডিসিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘আপনাদের পাশে নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন থাকবে। যখন আপনাদের প্রয়োজন হবে তখন নিরাপত্তা বাহিনী তারা আপনার পাশে থাকবে।
সার্বিক পর্যালোচনায় দেথা যায় যে সরকার প্রধান কর্তৃক নির্দেশনা অবশ্যি সকল নির্দেশনাই ডিসি গন পালন করবেন সত্যি কিন্তু তাদের দাপ্তরিক বিধিবদ্ধ কাজগুলো সর্বাগ্রে স্থান পাবে সেটাই সাভাবিক । জেলা প্রশাসকরা তাদের সম্মেলনে ব্যাপক অর্থে অনেক প্রস্তাব রেখেছেন যেমন শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, জমিজমা থেকে মাদক, খেলাধুলা থেকে মারামারি, নদী ভাঙন থেকে রা¯স্তায় কীভাবে বাস চলবে ইত্যাদি। সব কিছুতেই ডিসিরা তাদের সরাসরি অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব করেছেন তা হলে সংসদ সদস্যরা কি করবে? একজন সংসদ সদস্য যদিও আইন প্রণেতা; কিন্তু তিনি তো তার এলাকার প্রকৃত জনপ্রতিনিধিও। তারা কি এসব কথা সংসদে তুলে ধরেন না বা ধরলেও তাতে কি কোনো কাজ হয় না? সংসদ সদস্যরা কি এগুলো নিয়ে কোনো চিন্তা করেন না? সবই ডিসিদের করতে হবে?
সবকিছু যাতে ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়ে পড়ে সেজন্য স্থানীয় প্রশাসনকে ক্ষমতায়িত করার বিষয়টি নিয়ে বহু বছর ধরেই আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া এবং রাজনৈতিক প্রভাবসহ বিভিন্ন কারণে মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তারা সিদ্ধান্ত নিতে চান না। প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের জন্য মাঠ প্রশাসন এখনও অনেক ক্ষেত্রে ‘কেন্দ্রের দিকে’ তাকিয়ে থাকে। এতে সাধারণ মানুষ সরকারী সেবা পেতে বিড়ম্বনা ও দীর্ঘসূত্রতার কবলে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার নির্দেশনা দিয়েছে, স্থানীয় প্রশাসন যেসব সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে পারে সেসব।
উপরের আলোচনা থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে জেলা প্রশাসক ও জন প্রতিনিধিদের মধ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীক যে ভারসাম্য তা অনেক ক্ষেত্রেই বিঘ্নিত হয় এবং উভয় পক্ষই আরও বেশী প্রতিনিধিত্ব চান যা ডিসিদের বক্তব্য থেকে বুঝা যায়। যেমন এক: পূর্বে নিয়ম ছিল জেলার বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মেনেজিং কমিটির সভাপতি থাকবেন জেলা প্রশাসক। কিন্তু পরবর্তিতে তা পরিবর্তন করে স্থানীয় সংসদ সদস্যকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে সংসদ সদস্যরা তাদের নির্ধারিত লোকদের যাতে নিয়োগ দেয়া হয় সেই প্রচেষ্টার সবটাই করে থাকেন যার সাথে স্থানীয় রাজনীতি জড়িত। ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, অভিভাবক, এলাকার নিরীহ লোকজন মনে করেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো কমিটিতে যাতে কোনো জনপ্রতিনিধি না থাকে এবং পূর্বের অবস্থায় বজায় থাকুক। কারণ ওই ধরনের পাবলিক প্রতিনিধিদের থেকে মাঠ পর্যায়ের এসব আমলাকে সাধারণ মানুষ ঢের পছন্দ করেন, তাদের ওপর নির্ভর করা তারা অনেকটাই নিরাপদ মনে করেন। তারই অংশ হিসেবে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ‘নিয়োগ পুল’ গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসকদের সম্মেলনে। বেসরকারি কলেজে অধ্যক্ষ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি রোধ করার জন্যই এই প্রস্তাব। এবার সম্মেলনে একজন জেলা প্রশাসক সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সিন্ডিকেট এবং পরিচালনা কমিটিতে ডিসিকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব করেছেন। জেলা পর্যায়ে উচ্চশিক্ষার সার্বিক সমন্বয়ের জন্য এটা প্রয়োজন। এতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন সময় আন্দোলনের সময় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে ডিসি সহায়তা দিতে পারবে; দুই: প্রধানমন্ত্রী বলেছেন জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত প্রতিনিধি অর্থাৎ সংসদ সদস্য থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণে যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে কি-না বা বাস্তবায়নও যথযাথভাবে হচ্ছে কি-না সেগুলো সমন্বয় করতে হবে। উন্নয়ন প্রকল্প যত্রতত্র যেন না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। কিন্তু বাস্তবে ডিসিদের দ্বারা এত সকল কাজ করা সম্ভব হবে কিনা তা কতটুকু সম্ভব হবে তা বলা দুষ্কর; তিন: স্বাস্থ্য বিধি সবাই যাতে মেনে চলে তা নিশ্চিত করার তাগিদও পেয়েছেন জেলা প্রশাসকরা। এখন প্রশ্ন দাড়ায় ডিসিরা নিজ নিজ জেলায় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবে এবং জাতী গঠনমূলক সকল দফতর তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করবে। সবকিছুই যদি ডিসিদের দেখতে হয় তা হলে তারা নির্বাহী কাজ কখন করবে? মাঠ প্রশাসনে তারা উপজেলাগুলোতে তদারকির সময় পাবে তো? জেলার প্রশাসক হিসাবে গ্রামের মানুষের সাথে ডিসির সংযোগ কিভাবে হবে?; চার: অনেকেই বলে ডিসিরা সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়নই প্রধান কাজ যদিও তাদের বিধিবদ্ধ অনেক কাজ রয়েছে যা তাদের চাকুরী বিধিতে উল্লেখ রয়েছে। সরকার আসে সরকার যায় কিন্তু প্রশাসনিক কাঠামোতে তাদের অবস্থান রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রভাবান্বিত হওয়ার কথা নয়। কিন্তু সব নির্বাচিত সরকারই জনপ্রশাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে যা কাম্য নয়। এর ফলে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথেই ডিসিরা বিভিন্নভাবে দন্ডিত হয় চাকুরীতে; পাঁচ: সমালোচকরা বলেন ডিসিরা পদায়ন পান রাজনৈতিক বিবেচনায়, মেধার মানদন্ডে নয় যা বাংলাদেশের সব সরকারী চাকুরীর ক্ষেত্রে একটি সংস্কৃতিতে পরিনত হয়েছে। যার ফলে এটি একটি অর্থনেতিকভাবে লাভজনক পদ হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে যেখানে নৈতিকতার বিষয়টি একটি বিবেচ্য বিষয়। নিশ্চয়ই বিসিএস (প্রশাসক) ক্যাডারের কর্মকর্তারা সি.এস.পি./ইপিসিএস ক্যাডারের মত মানসম্মত হবে না যার একটি প্রতিফলন ঘটবে তাদের সার্বিক কার্যক্রমের উপর সেটাই স্বাভাবিক যা ৫৩ বছরের বাংলাদেশের একটি বাস্তব প্রতিবিম্ব। তারা না পারছে অফিস কিংবা মাঠ প্রশাসন সামলাতে যার সাথে যুক্ত হয় জনপ্রতিনিধি (এমপি, উপজেলা/মিউনিসিপালিটি/ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান)’দের প্রভাব। যার ফলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা বাস্তবায়নে কতটুকু সফলকাম হবে তা সময়ই বলে দেবে। চার দিনের এ সম্মেলন শেষে জেলার প্রশাসকগণ ফিরে গেছেন তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে এবং প্রত্যাশার বিষয় হলো মাঠ পর্যায়ের সম্পর্কে সরকারের উপলব্ধির পরিসর বাড়াতে জেলা প্রশাসকগণ অবদান রাখবেন যা সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জেলা প্রশাসকদের করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হতে সাহায্য করবে। এখানে উল্লেখ্য যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, গত বছর অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে উত্থাপিত ২১২টি প্রস্তাবের ১৩০টি বাস্তবায়ন হয়েছে এবং ৮২টি বাস্তবায়নাধীন ও বাস্তবায়নের হার ৬২ শতাংশ। তবে সরকারের অগ্রাধিকার বাজার ব্যবস্থায় মুদ্রানিয়ন্ত্রন বিশেষত রমজান মাসকে রেখে তা কতটুকু সম্ভব হবে তাই এখন দেখার বিষয় ।।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এজেডএস