স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
২৬ মার্চ ২০২৪ ১৭:৪৪
‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’- জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই একটি মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে বাংলার মানুষ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পরাধীনতার শৃঙ্খলা ভেঙে গর্জে উঠেছিল মুক্তির নেশায়।
“স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে / কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব শৃঙ্খল বলো কে পরিবে পায় হে / কে পরিবে পায়? “
এটা একটি গানের কলি। কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা নিয়ে গাওয়া হয়েছে। গেয়েছেন কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্বাধীনতা মানুষের জন্মগত অধিকার। মানুষ বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা ও সংগ্রামের মাধ্যমে এ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ জন্য স্বাধীনতার স্বাদ এত মধুর। যুগে যুগে এটা মানুষের কর্মে চিন্তায় ও চেতনায় অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।
শব্দগত অর্থে স্বাধীনতা বলতে স্ব-অধীনতা বোঝায়। যে দিবসে স্বাধীনতা ঘোষিত হয় বা অর্জিত হয় সে দিনটি স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করা হয়। যে দিবসে যে জাতি পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির আনন্দ লাভ করে সে দিবসটি সে জাতির জন্য নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
স্বাধীনতা সমাজ জীবনের এমন এক অবস্থা যেখানে সবাই অধিকার ভোগ করতে পারে। স্বাধীনতা মানে প্রত্যেক নাগরিকের বাঁচার অধিকার, কথা বলার অধিকার, আপন সম্পত্তি ভোগ করার অধিকার। এ ব্যাপারে অধ্যাপক লাস্কি বলেছেন, “স্বাধীনতা বলতে আমি বুঝি- সেসব সামাজিক অবস্থার ওপর থেকে বিধি-নিষেধের অপসারণ, যেগুলো বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় মানুষের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য অপরিহার্য।”
২৬ মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। আমাদের জাতীয় জীবনে যা সবচাইতে গৌরবময় ও পবিত্রতম দিন। প্রতিবছর দিবসটি আমাদের মাঝে উপস্থিত হয়ে আমাদের পূর্ব-পুরুষদের অক্ষয়কীর্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে যায়।
স্বাধীনতা দিবস তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে মুক্তির প্রতিজ্ঞায় উদ্দীপ্ত হওয়ার ইতিহাস। বাঙালির ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যেদিন বর্বর পাকিস্তানিদের পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের সর্ব শ্রেণির মানুষ সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল।
চূড়ান্ত পর্বে এসে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। এ দিন বাংলার মানুষ পাকিস্তানি ঔপনিবেশিক স্বৈরশাসনের ২৪ বছরের গ্লানি থেকে মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল। এই স্বাধীনতা লাখো মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও শহিদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে। এই দিনে জাতি স্মরণ করছে তাঁদের।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা এক দিনে আসেনি। এর জন্য প্রায় ২৪ বছর এ দেশের মানুষকে আন্দোলন করতে হয়েছে। দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিশ্বমানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে ‘বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্রের।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হলেও চূড়ান্ত আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল একাত্তরের ১ মার্চ থেকেই। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাঙালির জীবনে নানা কারণে এ মাস অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস। অসংখ্য ঘটনার উজ্জ্বল সাক্ষী।
১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে জন্ম নেয় ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি রাষ্ট্র। পাকিস্তানের অভ্যুদয়ের শুরুতেই এর শাসকগোষ্ঠী এ দেশের মানুষের ওপর জোর করে উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। এ দেশের মানুষ তীব্র আন্দোলনের মাধ্যমে জীবন দিয়ে তা রুখে দিয়েছে, প্রতিষ্ঠিত করেছে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা।
১৯৫৪ সালে এ দেশের মানুষ যুক্তফ্রন্টকে বিজয়ী করে সরকার গঠনের সুযোগ দিলেও ষড়যন্ত্রকারী শাসকগোষ্ঠী তা ভেঙে দিয়েছে। এরপর ১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের বৈষম্যমূলক নীতিমালার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ১৯৬৬ সালে বাংলার মুক্তির সনদ ৬ দফা ঘোষণা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয় এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা আন্দোলনেরই এক একটি বিজয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী তাদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা ও সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। তারা আলোচনার নামে গভীর ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে।
এটা বুঝতে পেরে বঙ্গবন্ধু দেশব্যাপী অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। ৭ মার্চ ১০ লাখ জনতার এক বিশাল সমাবেশে। তিনি প্রয়োজনীয় জরুরি দিকনির্দেশনাসহ ঘোষণা করেন – ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে দেশের ঘুমন্ত নিরীহ মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ চালায়। শুরু করে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ। মধ্যরাতের পরে তারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহুর্তে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ওয়্যারলেস বার্তায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এই স্বাধীনতা ঘোষণা দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করা শুরু হয়েছিল মূলত ৬ দফার মধ্য দিয়েই। উনসত্তরের বিশাল গণআন্দোলনে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন হলো। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ‘৭০ -এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনকে নিলেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণভোট হিসেবে। আর ব্যালটে তিনি এমন অভাবিত বিজয় অর্জন করলেন, যখন পাকিস্তানিদের বুলেট, ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, কামান সবই তুচ্ছ হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু লড়াই-সংগ্রাম করেছেন, জেল খেটেছেন; তারপরও কোনকিছুর বিনিময়ে নিজের আদর্শ বিসর্জন বিকিয়ে দেননি। তাঁর এই দৃঢ় মনোভাব বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ, চিন্তা, চেতনা সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে মিশে গেছে, যা মানুষকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে চলতে সহায়তার করে। মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতা লাভ করে বাঙালিরা বিশ্বে মাথা উঁচু করে বসবাস করছে।
এ দিন সমগ্র দেশবাসীর বহুকাল লালিত মুক্তি ও সংগ্রামের অঙ্গীকারে ভাস্কর। এই দিবসটি দারিদ্র্য, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার মহান আদর্শে উদ্বুদ্ধ। এ দিন আমাদের আত্মপরিচয়ের গৌরবে উজ্জ্বল, ত্যাগে ও বেদনায় মহীয়ান।
স্বাধীনতার ৫০ বছরের সফল পথচলা শেষে ৫৪ বছরে পা রাখল আমাদের মাতৃভূমি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। প্রতিবছর গৌরবময় এ দিনটি পালন করতে গিয়ে আমাদের কর্তব্য হয়ে ওঠে স্বাধীনতার স্বপ্ন ও সাধ আমরা কতটুকু বাস্তবায়ন করতে পেরেছি, জাতীয় জীবনে আমাদের অর্জন কতটুকু আর বিশ্বসভায় আমাদের অবস্থান কোথায় সেসব মিলিয়ে দেখা।
এদিক থেকে এ দিনটি আমাদের আত্মসমালোচনার দিন, হিসেব মিলাবার দিন, আত্ম-জিজ্ঞাসার দিন। আর বলে যায় এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আমাদের কিছু করণীয় আছে।
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়
সারাবাংলা/এসবিডিই