রাষ্ট্রপতির প্রতি খোলা চিঠি, প্রতিকার হয়নি এখনও
৪ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:২৮
‘রাষ্ট্রপতির প্রতি খোলা চিঠি: শ্যামপুর মাদরাসা নিজভূমে পরবাসী’- শীর্ষক মাদ্রাসাটি স্থায়ী জায়গায় ফিরিয়ে আনার এই নিবেদনটি গত ২০২২ সালের ১৫ জুন জাতীয় প্রথম শ্রেণির নিউজ পোর্টাল ‘সারাবাংলা’য় প্রকাশিত হয়। লেখাটি পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। শেয়ার হয়েছে ৫৫৯ টা।
কিন্তু ভীষণ পরিতাপের বিষয় হলো, জায়গা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এ সমস্যাটির সুরাহা করা হয়নি প্রায় দুবছরেও। অথচ, বিপুল জনগোষ্ঠীর আবেদনের মুক্তির উপায় হিসেবে গণমাধ্যমে রাষ্ট্রপতির প্রতি এই খোলা চিঠি লেখার অবতারণা হয়েছিল।
বঙ্গবন্ধুর মতো সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদও সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্র নয়, ন্যায্যতার গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। সেই ন্যায্যটাই আজ ক্ষমতার বিষবাষ্পে ১৪ বছর হলো ভূলণ্ঠিত।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রাষ্ট্রপতির রাষ্ট্রীয় পদে আর না থাকলেও নিজের এলাকা বলে সকলের অভিভাবক হয়ে ন্যায্যতার প্রশ্নে শ্যামপুর মাদ্রাসাটি পুনরুদ্ধার করে শ্যামপুর গ্রামে ফের ফিরিয়ে দিতে পারেন। শ্যামপুর গ্রামবাসী তার হস্তক্ষেপের দিকেই আজও তাকিয়ে রয়েছেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণটি কবে আসবে। কেননা, তিনি ছাড়া শ্যামপুর গ্রামবাসীর যাওয়ার জায়গা আর বাকি নেই।
নষ্ট রাজনীতির নষ্টামিতে পড়ে শ্যামপুর মাদ্রাসাটি ১৪ বছর ধরে শ্যামপুর গ্রামে নেই। কারণ, রাষ্ট্রপতি পরিবারের ঘনিষ্ঠজনের একটি ক্ষমতাধর অংশ মাদ্রাসাটির স্থায়ী জায়গা শ্যামপুর গ্রামে ফিরতে দিচ্ছেন না। তা নিয়ে গেম খেলছেন।
বিষয়টি রাজপরিবারের জন্য নিদারুণ বদনাম ও কলঙ্কের। এতে তারা শ্যামপুর গ্রামবাসীর দ্বারা ক্রমেই অভিশপ্ত হয়ে উঠছেন। যা আজ তাদের ওপরে আর কেউ নেই বলে অন্যায়টা বহাল রয়েছে আর ন্যায্যটা শৃঙ্খলিত।
একটু খুলে বললে, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ছোট ভাই মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রিন্সিপাল মো. আবদুল হক নূরু এবং ছোট বোন উপজেলা চেয়ারম্যান ও মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের মা আলহাজ্ব আছিয়া আলম স্পষ্টত শ্যামপুর মাদ্রাসাটি শ্যামপুর নিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে জোরালো অবস্থান নিয়েছেন। যা তাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ও মর্যাদার সাথে শোভা পায় না। কেননা, এটি ক্ষমতার অপব্যবহার ও অন্যায়।
তবে, ছেলে এমপি রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক শ্যামপুর গ্রামবাসীর একাধিক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই আসনের জনপ্রতিনিধি হিসেবে ন্যায্যতার বিচারে শ্যামপুর মাদ্রাসা শ্যামপুর গ্রামে নিয়ে যাওয়ার পক্ষে। সেই অনুযায়ী তিনি প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দদের সাথে নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে মাপঝোঁকে জায়গা চিহ্নিত করে মাটি ভরাট ও ইটের বেষ্টনী দিয়ে পাঠদানের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে প্রিন্সিপাল মো. আবদুল হক নূরু ও মিঠামইন উপজেলা চেয়ারম্যান আলহাজ্ব আছিয়া আলম মাদ্রাসাটি মাতৃকোলে ফেরার পথে শক্ত প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। যার ফলে শ্যামপুর মাদ্রাসাটি শ্যামপুরে প্রত্যাবর্তনে সদ্গতি নেই। এ নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতির পরিবারে চলছে সত্য-মিথ্যার চরম দ্বন্দ্ব। সেখানে এমপি তৌফিক ন্যায্য একটি বিষয় মিটিয়ে দিয়েও কোনঠাসা।
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের পরিবারের ভেতর মিঠামইন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক নতুন বগাদিয়া গ্রামের মো. নূরুল হক ভূঞা খুবই দক্ষতার সাথে এই দ্বন্দ্ব ও বিভক্তির বীজ বুনতে সক্ষম হয়েছেন।
লোকজন বিষয়টিকে এখন দাবা খেলার গেমের সাথে তুলনা করছেন – ‘ঘোড়ার চাল আড়াই ফাল, রাজা চেক মন্ত্রী কাটা।’ এতে বেশ খোশমেজাজেই রযেছেন নূরু ভূঞা।
শ্যামপুর দারুল উলুম দাখিল মাদ্রাটির রেজিস্ট্রি কাওলামূলে উপযুক্ত এক একর স্থায়ী জায়গা রয়েছে। শ্যামপুর গ্রামের মরহুম মো. জজ মিয়া তা দান করে গেছেন।
সেটি কিশোরগঞ্জের মিঠামইন উপজেলা ১নং গোপদিঘী ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে অবস্থিত। জমির সঠিকতায় মাদ্রাসাটি এখানেই প্রতিষ্ঠিত হয়, পাঠদানের অনুমতি পায় এবং এমপিওভুক্ত হয়।
এমপিওভুক্তির পরপরই তাতে অশনি শক্তি ভর করে। ২০১১ সালে মাদ্রাসার সুপার মো. আমিনুল হক নতুন বগাদিয়া গ্রামের সেই মো. নূরুল হক ভূঞার মদত ও সহযোগিতায় মাদ্রাসার জায়গা ‘গভীর জলে নিমজ্জিত এবং ব্যবহারে অনুপযোগী’ ইত্যাদি বানোয়াট তথ্য-উপাত্ত দাখিল করেন এবং আদালতকে বিভ্রান্ত করে অন্যত্র ‘অস্থায়ীভাবে’ পাঠদান কার্যক্রম চালানোর অনুমতি লাভ করেন। ফলে এটাকে ক্ষমতাবানেরা শ্যামপুর মাদ্রাসা শ্যামপুর গ্রামে আর না ফেরার পুঁজি বানায়।
সেই সুবাদে নিজ স্বার্থ হাসিলে মাদ্রাসাটি কুক্ষিগত করার মানসে মো. নূরুল হক ভূঞার ব্যক্তি মালিকানাধীন ধলাই-বগাদিয়া বাজারে ভাড়াতে অস্থায়ীভাবে প্রশাসনিক ও শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম নামকাওয়াস্তে চালানোর সুযোগ করে দেয়। মাদ্রাসার নাম পরিবর্তনেরও চেষ্টা চালায়। আর বানিয়ে নেন পকেট কমিটিও। ফলে এখানে এ যাবৎ নেই কোনো জবাবদিহিতা; হিসাবনিকাশেরও নেই কোনো বালাই।
অপরদিকে ১৪ বছর ধরে মাদ্রাসার অবকাঠামোগত উন্নয়ন বরাদ্দ দফায় দফায় ফেরত চলে যাচ্ছে শ্যামপুর মাদ্রাসা শ্যামপুরে না থাকায়। এছাড়া পাঠদান কার্যক্রমের অভাবে শতশত অভিভাবকদের স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দিলেও এবং শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ জীবনে অমানিশার অন্ধকার নেমে আসলেও রাজনৈতিক ক্ষমতার অপপ্রয়োগে শিক্ষার পরিবর্তে ব্যক্তিস্বার্থই আসল উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছে।
মাদ্রাসাটির নিজস্ব ঘর রয়েছে শ্যামপুর গ্রামে মনোরম পরিবেশে, বিশাল পরিসরে। কিন্তু এখানে নেই কোনো শিক্ষক-কর্মচারী, না আছে কোনো শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম। তা যে কেউ সরেজমিনে গেলে প্রমাণ পাবেন।
তবুও ক্ষমতা আছে বলে মিঠামইন উপজেলা চেয়ারম্যান ও মাদ্রাসার ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আলহাজ্ব আছিয়া আলম স্রেফ হাওয়ার ওপর সুপারসহ ১৭ জন শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন-ভাতা বিলে স্বাক্ষর অব্যাহত রেখেছেন। সত্যিকার অর্থে তিনি না চিনেন মাদ্রাসা, না জানেন বাস্তব অবস্থা ও পাঠদান কার্যক্রমের হালহকিকত।
তিনি একে তো উপজেলা চেয়ারম্যান, তার ওপর সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের ছোট বোন এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদের মা হওয়ায় মাদ্রাসাটি একটি আদর্শ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠার কথা থাকলেও তা না হয়ে এটিকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
অধিকন্তু উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক রাষ্ট্রপতির ছোট ভাই প্রিন্সিপাল মো. আবদুল হক নূরু দেশবরেণ্য একজন শিক্ষাবিদ হওয়া সত্ত্বেও শ্যামপুর মাদ্রাসা শ্যামপুর গ্রামে ফিরিয়ে দিতে নারাজ। যে কারণে শ্যামপুর মাদ্রাসা শ্যামপুর গ্রামে যেতে পারছে না।
এদিকে লাই পেয়ে সুপার মো. আমিনুল হক এরইমধ্যে মাদ্রাসাটি বিড়াল ছানার মতো সাতবার জায়গা বদল করে বর্তমানে ধলাই-বগাদিয়া বাজারে আছে পরগাছা হয়ে। ধলাই-বগাদিয়া হাইস্কুলের ছোট একটি মাত্র টিনশেড ঘরে পুরো মাদ্রাসা দেখিয়ে আসছেন। অর্থাৎ, অফিসসহ ১০টি শ্রেণি পাঠদান কার্যক্রম এবং সবকিছু ঠিকঠাক দেখিয়ে আসছেন কাগজে-কলমে, অসম্ভব উপায়ে। তবুও বহাল রয়েছে পাঠদানের অনুমতি। তা যেন ‘আলোর নিচে অন্ধকার’ প্রবাদটির বাস্তব রূপায়ণ।
‘শ্যামপুর মাদ্রাসা আল্লা চালায়’ – এরূপ মন্তব্য শিক্ষা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তাব্যক্তিদের, যাদের ওপর দেখভাল করার দায়িত্ব সরকার দিয়েছে। কিন্তু নষ্ট রাজনীতির ক্ষমতার চাপে পড়ে তারা ভীতসন্ত্রস্ত; অসহায়। কর্তৃত্বের প্রশ্নে মিঠামইন উপজেলা যেন আলাদা এক ভূখণ্ড। তৈরি করে রাখা হয়েছে ভীতির সংস্কৃতি।
এভাবেই নষ্ট রাজনীতির ঘুণপোকা সমাজের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ঝাঁঝরা করে দিচ্ছে। বিবাদ বাড়াচ্ছে সমাজে। অথচ ভয়ে মুখ খুলছেন না কেউ। যদিও কেউ সাহস করে লেখনির মাধ্যমে এসব অনাচার ও অসঙ্গতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, তা শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দিয়ে হয়রানির নজিরও রয়েছে।
এখানে স্মরণ করতেই হয়, একটি আদর্শ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়বো বলে ২০০৫ সালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবদুল্লাহ আল হাসান চৌধুরীর মাধ্যমে আমি মাদ্রাসার যাবতীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে দিয়েছি। সর্বোপরি, আমি ও আমার সহধর্মিণীর উপর্যুপরি পীড়াপীড়িতে দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ প্রিন্সিপাল মো. আবদুল হক নূরুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতে মাদ্রাসাটি ২০১০ সালে এমপিওভুক্ত হয়।
যিনি গড়েন, তার দ্বারা কি ধ্বংস মানায়? কারো মিস গাইডে বা কারো কান কথায় কিংবা মিঠা কথায় মোহগ্রস্ত হয়ে ক্ষমতা আছে বলেই কি তাদের দ্বারা একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্ষতি করতে পারেন? এক এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেড়ে নিয়ে আরেক এলাকায় প্রতিস্থাপন করা ন্যায্য কি? তাতে না পাবে সমাজে ও রাষ্ট্রে গ্রহণযোগ্যতা। না লোকে ভালো বলবে? বরং একটি বাজে দৃষ্টান্ত হয়ে অভিশাপের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে না?
পরিশেষে ক্ষমতাবান ও দায়িত্বশীলদের বলবো যে, পরের ধন নিয়ে আর কতো কাড়াকাড়ি! তার বদলে ‘মনেরে আজ কহ যে, / ভালো-মন্দ যাচাই আসুক সত্যরে লও সহজে।’
লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও কলামিস্ট, সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়
সারাবাংলা/এসবিডিই