Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ঈদ-পুজায় ভুরিভোজই উৎসব?

মোস্তফা কামাল
৯ এপ্রিল ২০২৪ ১৩:০৩

উৎসব মানে কেবল মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়া? কোলাকুলি-মোলাকাত? কোনো উৎসবই একা একা করা যায় না। আর উৎসব কেবল ঈদ বা পূজাই? মনে মিল থাকলে খালি পেটেও উৎসব হতে পারে। মনে ভেজাল থাকলে, পেটপুরে খেয়ে, ‘উৎসব যার যার ধর্ম সবার’ ধরনের নানান মনোহরি স্লোগানেও ঊসব হয় না। হতে পারে না। মনমগজে স্যাকুলার-সাম্প্রদায়িকতা পুষে রেখে উৎসবকে সার্বজনীন বলা কেবলই ভাওতাবাজি। একদিকে সংখ্যা দিয়ে লঘু-গুরু নির্নয়, তারওপর ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে জন্ম নেয়া কাউকে সেকুলার ভাবার চিন্তা করাও কঠিন, অবান্তর। চোখ মেললেই চারদিকে বাঁকা চোখ বা দয়ার চোখ। তাচ্ছিল্য বা অতি আদর মনে করিয়ে দেয়- সে কে-কী? আছে কোথায়? তা তাকে অসহায় করে। জেদিও করে। আঘাতগুলো ভুলতে পারলেও অপমানগুলো ভোলা সহজ হয় না। হয়ই না। এসবের একটা জের আপনাআপনিই ঘটে। যথারীতি ঘটে চলছে। যা সত্যিকার উৎসবকে খাটো করছে। উৎসবের সীমানা তো ছোট করছেই।

বিজ্ঞাপন

উৎসব মানে খাই খাই নয়? খালি পেটে রোজা পালনও একটি উৎসব। সন্ধ্যায় ইফতার, শেষরাতে সেহরি খাওয়াও উৎসব। এসব দেখাও এক একটি উৎসব। হিন্দুসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পুজা-পার্বণের নানা পর্বেও কতো উৎসব। বিশেষ কোনো দিনে ডেকে নিয়ে একখিলি পান খাওয়ানোর মাঝেও উৎসব বোধ করা যায়। কেবল ঈদ বা পুজার দিনে রহিম-রামের গলায় জড়িয়ে ধরা বা সেমাই-মিঠা-মণ্ডা খাওয়াকেই ঊৎসব মনে করা নিতান্তই সংকীর্ণতা। বারো মাসে তেরো পার্বণে যদি করিম, রহিম আলাউদ্দিন, ব্যবসাসফল হয়েও যায়। তবে তাকে বঞ্চিত করার মানে কি? বিক্রেতা বারো মাসে তেরো পার্বণ পালনকারী দলের সদস্য নন। ঈদে টুপি, লুঙ্গি, নারিকেল বিক্রি করে- শ্যাম, মধু, উজ্জ্বল কিছু টাকার ব্যবসা করতে পারলে সুলেমানের মুসলমানিত্বে লাগবে কেন? সেই ভাবনা থেকে সরে ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’ আওড়িয়ে বা বিকৃত করে উৎসবকে খাওয়া পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার একটি বাতিক লক্ষণীয়। বিষয়টি নির্মোহে আলোচনার মতো। অবশ্যই সম্প্রদায় নিয়ে ভাবা এক কথা। সাম্প্রদায়িক হওয়া আরেক বিষয়।

বিজ্ঞাপন

উৎসবে একটি বাঙালিয়ানা বরাবরই ছিল, আছে। তা সব ধর্মাবলম্বীতেই। উৎসব এলে চরম কঞ্জুসও তার হাত কিছুটা হলেও খোলে। অসামাজিক মানুষটাও দরজা খুলে রাখে। খুব চায়, কেউ কেউ আসুক। চায় নিজেও যেতে। কারণ একাকি কোনো উৎসব উদযাপন করা যায় না। উৎসবে যার যার সাধ্যমতো পোশাক কেনে। ধনী-গরিব সবাই তাদের ঘরবাড়ি যদ্দুর সম্ভব সাফসতুর করে। উৎসবে ধর্মীয় কৃত্যগুলো নিজ ধর্মের। কিন্তু দিনের বাকি সময় প্রতিবেশী অন্য ধর্মের মানুষ তার কাছে অচ্ছ্যুৎ থাকে না। এমন সৌন্দর্যবোধের বাঙালিকে অসৌন্দর্যে ঠেলে পাঠায় কারা? ইতিহাসের তথ্য-সাবুদ বলছে, বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশের মানুষ সংখ্যায় কম হলেও ইসলাম গ্রহণ করেছে মহানবীর জীবদ্দশাতেই। পরবর্তীকালে সংখ্যায বেড়েছে। কিন্তু এখনকার মতো হিন্দুবিদ্বেষী বক্তব্য দেড়শো বছর আগেও কোনো ইসলামি আলেম দেননি। সুন্নি-ওহাবি-শিয়া-সালাফি ক্যাচাল এমন ছিল না। গত শতকের আশির দশকে সৌদি পেট্রো ডলার অনেকখানি খেয়ে ফেলেছে বাঙালি মুসলমানের মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো। আর এখন সব ধর্মের মানুষের একটা অংশের মাঝেই সাম্প্রদায়িক চিন্তার ঢেউ। সুযোগ পেলেই দেখিয়ে দেয়ার চিকন চিন্তা। আবার উদারতার নামে আরেক ভেজাল।

সামাজিক মানুষ ও তাদের সমাজকে নিছকই সংখ্যা দিয়ে বিবেচনার রীতি আধুনিক রাষ্ট্র এবং ভোটের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ফলে প্রসঙ্গের বাইরে বিমূর্ত ভাবে ‘সংখ্যালঘু’ কথাটিরও অপব্যবহার ঘটে। আধুনিক রাষ্ট্রে ক্ষমতা তৈয়ার ও বৈধ করবার প্রক্রিয়ার বিচার ছাড়া ‘সংখ্যালঘু’ বর্গটির যথেচ্ছ ব্যবহার প্রপাগাণ্ডা ও প্রচারের কাজেই বেশী ব্যবহার করা হয়। হিন্দুদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মুসলমান, মুসলমানদের অনুষ্ঠানে হিন্দুদের যাতায়াতে এক সময় দাওয়াত বা নিমন্ত্রণ দিতে হয়নি। উৎসব বা মজা করতে-দেখতে ছুটে গেছে। ‘তখন উৎসব যার যার ধর্ম সাবার’-এর মতো কাব্যিক এতো সুন্দর স্লোগান আবিস্কার হয়নি। তখন তো কোনো ঝামেলাও হয়নি। আজকাল হচ্ছে কেন? ফেরটা কোথায়? খোঁচাটা আসে কোত্থেকে? এ উপমহাদেশ কখনো খুব সেক্যুলার ছিল না। আবার পরস্পরকে ঘায়েলের খেয়ালও ছিল না। এখন অসাম্প্রদায়িক হওয়ার গান, কবিতা, স্লোগান বেশি। সাম্প্রদায়িকতাও বেশি। দেশান্তরি হওয়ার সংখ্যাও বেশি। তবে, ভারতে নয়। সুদুর যুক্তরাষ্ট্রসহ পূর্ব-পশ্চিম সব প্রাশ্চেই। নিরাপদ বা ভালো থাকতে আফ্রিকান দেশেও ছুটে যাচ্ছে বাংলার মানুষ। চিরস্থায়ীও হয়ে যাচ্ছে। থিতুও হচ্ছে। তা দুর্ভাগ্যজনক নয়, চরম হতাশারও। সমস্যার মূল অনেক গভীরে। সেইক্ষেত্রে ধর্ম দিয়ে সংখ্যার লঘু-গুরু পরিমাপের দিন আসলেই শেষ। তা শক্তিমানের খপ্পরে পড়লে হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। মর্মে মর্মে উপলব্ধি করা যায় দূর্বলের উপর সবলের তেজ। উৎসবের প্রকৃত অর্থ-সামর্থও বোঝা যায়।

উৎসব প্রশ্নে এখানে কবিগুরু বড় প্রাসঙ্গিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা… ‘উৎসব একলার নহে। মিলনের মধ্যেই সত্যের প্রকাশ- সেই মিলনের মধ্যেই সত্যকে অনুভব করা উৎসবের সম্পূর্ণতা। একলার মধ্যে যাহা ধ্যানযোগে বুঝিবার চেষ্টা করি, নিখিলের মধ্যে তাহাই প্রত্যক্ষ করিলে তবেই আমাদের উপলব্ধি সম্পূর্ণ হয়। মিলনের মধ্যে যে সত্য, তাহা কেবল বিজ্ঞান নহে তাহা আনন্দ, তাহা রসস্বরূপ, তাহা প্রেম। তাহা আংশিক নহে, তাহা সমগ্র; কারণ, তাহা কেবল বুদ্ধিকে নহে, তাহা হৃদয়কেও পূর্ণ করে। যিনি নানাস্থান হইতে আমাদের সকলকে একের দিকে আকর্ষণ করিতেছেন, যাঁহার সম্মুখে, যাঁহার দক্ষিণ করতলচ্ছায়ায় আমরা সকলে মুখোমুখি করিয়া বসিয়া আছি, তিনি নীরস সত্য নহেন, তিনি প্রেম। এই প্রেমই উৎসবের দেবতা- মিলনই তাঁহার সজীব সচেতন মন্দির।

এ প্রশ্নে চন্ডীদাসও প্রাসঙ্গিক। প্রশ্নও আছে। তার কেন সংশয় জেগেছিল মানুষের মানুষ হওয়া নিয়ে? তিনি কেন লিখেছিলেন- ‘শুনহ মানুষ ভাই-সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই? মানবিক আচার আচরণ যেখানে উপেক্ষিত সেখানে মূল্যবোধ নির্বাসিত যে হবেই; সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। সংস্কৃতিচর্চা যেখানটায় কেবলমাত্র ফ্যাশনের জায়গা আর মুখোশের জায়গায় এসে ঠেকেছে। সেখানে রুচিবিকৃতির চরম রূপ। উৎসবের মর্ম শেষ করা, সংখ্যা দিয়ে লঘু-গুরু ঠিক করা ওই রুচিবিকৃতিরই অনিবার্য জের। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন যেই নোংরামি বহু আগেই জানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। ভাবতে অবাক লাগে আজ, এতো যুগ পরে আমরা সেই সত্যেরই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেছি। যেখানে দাঁড়িয়ে সাম্যবাদের গান হয় না, সেখানে দাঁড়িয়ে একে অন্যের প্রতি লীন হওয়ার সুযোগ থাকে না।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই

ঈদ-পুজায় ভুরিভোজই উৎসব? মত-দ্বিমত মোস্তফা কামাল

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর