Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নববর্ষে পান্তা-ইলিশ: পুঁজিবাদীদের ‘বানোয়াট’ অপসংস্কৃতি

তাপস হালদার
১৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৬:০৮

বাঙালির সর্ববৃহৎ অসাম্প্রদায়িক উৎসব বাংলা নববর্ষ। বাংলাদেশ সহ বিশ্বের প্রতিটি বাঙালি নববর্ষের উৎসবে শামিল হয়। কোনো প্রকার ধর্মীয় ভেদাভেদ থাকেনা, প্রতিটি ধর্ম-বর্ণের মানুষের মিলন মেলায় পরিনত হয়। একসময় বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিল হালখাতা। নতুন বছরের শুরুর দিনে গ্রাম-গঞ্জের ব্যবসায়ীরা পুরনো হিসাব-নিকাশ বন্ধ করে নতুন হিসাব খুলতেন। ব্যবসায়ীরা খদ্দেরদের নিমন্ত্রণ করে মিষ্টিমুখ করাতেন। মুঘল সম্রাট আকবর কৃষকদের কাছ থেকে খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে একটি নতুন সন শুরু করেন। এটি কৃষকদের কাছে ‘ফসলি সন’ নামে পরিচিত। যা পরবর্তীতে ‘বাংলা সন’ বা ‘বঙ্গাব্দ’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।

বিজ্ঞাপন

পাকিস্তান আমলে পূর্ব বাংলার সংস্কৃতিকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো। বাঙালি সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানা তকমা দিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও কবিতার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এর প্রতিবাদে ১৯৬৪ সালে সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানট রমনা পার্কে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এসো হে বৈশাখ —এসো এসো’ গানের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করে ছায়ানট। ধীরে ধীরে রমনার বটমূলে উৎসবটি মহিরুহে পরিনত হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই রমনার বটমূলে বর্ষবরণ উৎসবটি জাতীয় উৎসবের স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে মঙ্গল শোভাযাত্রা। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের সময় ১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা শুরু করে মঙ্গল শোভাযাত্রা। পহেলা বৈশাখের দিন চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে টিএসসিতে এসে শেষ হয়। এখানে পশুপাখির মুখাকৃতির ছবি, গ্রামীণ ঐতিহ্যের বিভিন্ন অনুষঙ্গ নানা রংয়ের মুখোশ ও আলপনার মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। প্রতিবছর সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে থিম হিসেবে তুলে ধরা হয়। শিশু, কিশোর থেকে শুরু করে সববয়সী মানুষ মঙ্গল শোভাযাত্রার আনন্দে মেতে উঠে। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি দেয় ইউনেস্কো।

বিজ্ঞাপন

নববর্ষের ঐতিহ্য বলতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বৈশাখী মেলাকেই বোঝায়। গ্রামীণ খাদ্য -মিষ্টি, মন্ডা মিঁঠাই, চিড়া, মুড়ি, ছাতু, খই, জিল, নকুল দানা, বাতাসা, কদমা, খেজুরের গুড়, দই, রসগোল্লা, লুচি, সবজি, খিচুড়ি। এছাড়া কই, শিং, রুই-, কাতলা, দেশি মুরগি প্রধান তালিকায় ছিল। প্রায় সকলেই এসব খাদ্য খেয়ে নববর্ষ পালন করতো। সামর্থ্য অনুযায়ী আয়োজন করতো, তবে বিশেষ কোনো রেওয়াজ ছিলনা। ছোট বড় ছেলে মেয়েরা মেলায় গিয়ে রঙ্গিন হাঁড়ি, মাটির তৈজসপত্র, বেত ও বাঁশের আসবাবপত্র, বাঁশের বাশি সহ গ্রামীণ মানুষের তৈরি জিনিসপত্র কিনে বাসায় ফিরত।

বর্তমানে নববর্ষ উৎসব উদযাপনে পান্তা-ইলিশকেই প্রধান অনুষঙ্গ করেছে একশ্রেণির পুঁজিবাদী গোষ্ঠী। পান্তা-ইলিশ ছাড়া যেনো নববর্ষই বৃথা। অথচ পান্তা-ইলিশের সাথে বাঙালি সংস্কৃতির কোনো সম্পর্ক নেই। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে পান্তা ইলিশের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। কবি, সাহিত্যিকদের লেখায়ও পান্তা-ইলিশের অস্তিত্ব নেই। পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ খাওয়ার প্রচলন খুব বেশি দিনের নয়। নব্বইয়ের দশকে রমনার বটমূলে একদল ছাত্ররা শখের বশে পান্তা-ইলিশের দোকান শুরু করে। পরবর্তীতে আইডিয়াটা পুঁজিবাদীদের হাতে চলে যায়। যা আস্তে আস্তে দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে।

পান্তা ভাত বাঙালির জনপ্রিয় খাবারের মতো অন্যতম। যা হাজার বছরের পুরনো রীতি যা এখনো চলমান। পান্তা ভাত গরম ভাতের মতোই বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির অঙ্গ। রাতে রান্না করা বাড়তি ভাত জলে ভিজিয়ে রাখার পর তা পান্তা হয়। গ্রামীণ কৃষকদের কাছে পান্তা কেবল সকাল বেলার খাবারই নয়, অনেক সময় দিনের প্রধান খাবার হয়ে দাঁড়ায়। ভাত মূলত শর্করা জাতীয় খাবার। ভাত জল দিয়ে রাখলে গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া শর্করা ভেঙে ইথানল ও ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে। যা থেকে পান্তাভাতের ভিন্ন স্বাদ হয়ে থাকে। অন্যদিকে ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। এটি সামুদ্রিক নোনা জলের মাছ হলেও ডিম পাড়ার জন্য বড় নদী ও মোহনায় আসে। তখনই জেলেরা জাল ফেলে ইলিশ ধরে। এখন পর্যন্ত ইলিশের কোনো চাষ করা সম্ভব হয়নি। সাধারণত দামের কারণে ইলিশ বড় লোকের খাবার, কালেভদ্রে সাধারণ মানুষ বছরে দু-এক বার খেয়ে থাকে।

কৃষকেরা সূর্য ওঠার পরপরই পান্তা খেয়ে কাজে বের হতো। এর সঙ্গে জুটতো মরিচ, আলু কিংবা বেগুন ভর্তা। অনেক সময় খাল বিলে পাওয়া টেংরা, পুঁটি, টাকি, চিংড়ি মাছ যুক্ত হতো। গরিব কৃষকদের কাছে টাকা-পয়সা দিয়ে কিছু কিনে খাওয়া ছিল বিলাসিতা। কিন্তু পান্তা ভাতের সাথে ইলিশের অস্তিত্ব কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। ইলিশ সবসময়ই দামি মাছ। ইলিশ বিত্তবানদের গরম ভাতের সাথেই খাওয়ার প্রচলন ছিল। সাধারণ মানুষ ফসল উঠলে তখন হয়তো একটা ইলিশ কেনার সাহস করতো।

পুঁজিবাদী সংস্কৃতিতে পান্তা-ইলিশকে বৈশাখী খাবারের ব্র্যান্ডে পরিনত করেছে। বর্ষবরণের সাথে ইলিশকে এমন ভাবে যুক্ত করা হয়েছে, তাতে একশ্রেণির মানুষের কাছে মনে হবে পান্তা -ইলিশ ছাড়া পহেলা বৈশাখের কোনো মানে নেই। যার প্রভাব পড়ে ইলিশের বাজারে, চাহিদা হয়ে ওঠে আকাশচুম্বী। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগটা ব্যবহার করে। ইলিশের চাহিদা মিটাতে জাটকা নিধন শুরু হয়। বৈশাখকে কেন্দ্র করে এপ্রিল মাসেই মোট জাটকার ৬৫ শতাংশই নিধন হয়। যা আমাদের ইলিশ উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিরাট ক্ষতি। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে মা ইলিশ ডিম পাড়ে। আর মার্চ-এপ্রিল মাসে ইলিশ জাটকা অবস্থায় থাকে এজন্য পহেলা ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সারাদেশে ইলিশ ধরার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে। মৎস্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, মার্চ-এপ্রিলে জাটকা নিধন হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরে (আষাঢ়-শ্রাবন) ভরা মৌসুমেও ইলিশের সংকট হবে। কাজেই ইলিশকে বাঁচাতে হলে জাটকা নিধন বন্ধ করতে হবে।

২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা বাংলা নববর্ষে ব্যক্তিগত ভাবে ইলিশ বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আপনারা পান্তা-ইলিশ খাবেন না। ইলিশ ধরবেন না। পান্তা-ইলিশের পরিবর্তে খিচুড়ি, সবজি, বেগুন ভাজা ও ডিম ভাজা খাবেন। ’তারপর থেকে তিনি ধারাবাহিক ভাবে এই সিন্ধান্ত বহাল রেখেছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। সরকারি নববর্ষের অনুষ্ঠান গুলোতে ইলিশ বাদ পড়েছে। এছাড়াও আওয়ামী লীগের দলীয় নেতাকর্মীরাও পান্তা-ইলিশ দিয়ে নববর্ষের আয়োজন করেন না। তবে সবাই যে ঘরোয়া আয়োজনে পান্তা-ইলিশ তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে, সেটা জোর দিয়ে বলা যাবেনা। তবে প্রধানমন্ত্রীর আহবানের পর আয়োজন করে পান্তা-ইলিশ খাওয়ার অসুস্থ প্রতিযোগিতা অনেকটা কমে গেছে।

নববর্ষে পান্তা-ইলিশ গ্রাম থেকে শহরের অলিগলি পেরিয়ে অভিজাত রেস্তোরাঁয় স্থান করে নিয়েছে। নববর্ষে পান্তা-ইলিশ একপ্রকার বিলাসিতায় পরিনত হয়েছে। যারা নববর্ষে পান্তা-ইলিশ নিয়ে মাতামাতি করেন, তারা কেউই বছরে একবারও পান্তা খান না। পহেলা বৈশাখে ইলিশ নয়, বরং পান্তার সাথে লবন, মরিচ, আলুভর্তা, শুটকি ভর্তা, ডিম ভাজিই যথেষ্ট। এসবে বাঙালিয়ানা রয়েছে। নববর্ষে পান্তা-ইলিশ পুঁজিবাদীর তৈরি সংস্কৃতির নামে অপসংস্কৃতি।

লেখক: সাবেক ছাত্রনেতা ও সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ

সারাবাংলা/এসবিডিই

তাপস হালদার নববর্ষে পান্তা-ইলিশ: পুঁজিবাদীদের ‘বানোয়াট’ অপসংস্কৃতি মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

খুলনায় যুবকের পেটে মিলল ইয়াবা
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১২:০২

আরো

সম্পর্কিত খবর