কৃষিগুচ্ছে ভর্তি; যোগ্যতা ও ফলাফলে বৈষম্য
২১ এপ্রিল ২০২৪ ১৪:২২
বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞান বিষয়ে ডিগ্রী প্রদানকারী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ২০২৩-২০২৪ শিক্ষাবর্ষে ১ম বর্ষ স্নাতক শ্রেণীর ভর্তি বিজ্ঞপ্তি ১৬.০২.২০২৪ তারিখে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণ ও ফলাফল প্রস্ততিতে বৈষম্যসমূহ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নির্ধারণে বৈষম্য
বিজ্ঞপ্তির ২নং ক্রমিকে আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা নিম্নরূপে নির্ধারণ করা হয়েছে:
ক) ২০১৯/২০২০/২০২১ সালে এসএসসি/সমমান এবং ২০২২/২০২৩ সালে এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় যারা বিজ্ঞান বিভাগ হতে জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়সহ উত্তীর্ণ হয়েছে, কেবলমাত্র তারাই আবেদন করতে পারবে।
খ) আবেদনকারীর এসএসসি/সমমান এবং এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় উভয় ক্ষেত্রে প্রতিটিতে চতুর্থ বিষয় ব্যতীত ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০ এবং সর্বমোট ন্যূনতম জিপিএ ৮.৫০ থাকতে হবে।
বাংলাদেশে কৃষি গুচ্ছে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তির জন্য উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গনিত বিষয়সমূহে উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু বিজ্ঞপ্তিতে উক্ত ৪ বিষয়ের প্রতিটিতে আলাদাভাবে কত জিপি থাকতে হবে, তা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ উক্ত ৪ বিষয়ে শুধু উত্তীর্ণ হলেই চলবে। উক্ত ৪ বিষয়ের মধ্যে রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান সকলের জন্য আবশ্যিক। সকল প্রার্থীর ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞান ও গনিত বিষয়ের একটি ৩য় আবশ্যিক, অন্যটি অতিরিক্ত (৪র্থ) বিষয় হিসেবে বিবেচিত। অর্থাৎ কৃষিতে ভর্তির জন্য সকল আবেদনকারীকেই উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে উক্ত ৪ বিষয়ে উত্তীর্ণ হওয়া বাধ্যতামূলক।
জীববিজ্ঞান ও গনিত ব্যতিত অন্য কোন বিষয় ৪র্থ বিষয় হিসেবে থাকলে তিনি ভর্তির অযোগ্য। কিন্তু ভর্তির জন্য আবেদনের যোগ্যতা এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় ৪র্থ বিষয় ব্যতিত ন্যূনতম জিপিএ ৪.০০ নির্ধারণ করায় একই যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে কেউ ভর্তির সুযোগ পাবে, আবার কেউ সুযোগ পাবে না।
বিষয়টির ধারণা অধিকতর পরিষ্কার করার জন্য নিম্নে দুইজন আবেদনকারীর উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর ফলাফলের বিশ্লেষণ করা হলো:
বিষয় আবেদনকারী ’ক’ বাংলা, ইংরেজি, আইসিটি, রসায়ন পদার্থবিজ্ঞান, আবশ্যিক বিষয় হিসেবে জীববিজ্ঞান এবং চতুর্থ বিষয় গনিতে প্রাপ্ত জিপিএ যথাক্রমে ৩.৫, ৪, ৫, ৩.৫, ৩.৫। এক্ষেত্রে চতুর্থ বিষয় ব্যাতিত তারা জিপিএ আসে ৩.৮৩। একই শিক্ষার্থী যদি জীব বিজ্ঞানকে চতুর্থ বিষয় করে তবে তার জিপিএ আসে ৪.০৮।
মতামত ৪র্থ বিষয় ব্যতিত জিপিএ ৩.৮৩ থাকার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহনের অযোগ্য ৪র্থ বিষয় ব্যতিত জিপিএ ৪.০৮ থাকার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহনের যোগ্য।
উপরোক্ত ’ক’ ও ’খ’ উভয় আবেদনকারীর এইচএসসি পরীক্ষায় মোট জিপিএ ৪.৩৩ হওয়া সত্বেও ’ক’ আবেদনকারীর ৩য় আবশ্যিক বিষয়ে কম জিপি (৩.৫) ও ৪র্থ বিষয়ে বেশী জিপিএ (৫) থাকায় ৪র্থ বিষয় ব্যতিত তার জিপি ৩.৮৩ থাকার কারণে তিনি ভর্তির অযোগ্য। অন্যদিকে কিন্তু, ’খ’ আবেদনকারীর ৩য় আবশ্যিক বিষয়ে বেশী জিপি (৫) ও ৪র্থ বিষয়ে কম জিপি (৩.৫) থাকায় ৪র্থ বিষয় ব্যতিত তার জিপিএ ৪.০৮ থাকার কারণে তিনি ভর্তির যোগ্য। অথচ উভয়েরই জীববিজ্ঞান ও গনিতের একটি ৩য় আবশ্যিক ও অন্যটি ৪র্থ বিষয় হিসেবে উত্তীর্ণ। উপরোক্ত পর্যালোচনায় বোঝা যায় যে একই যোগ্যতা থাকা স্বত্বেও আবশ্যিক বিষয়ে কম ও অতিরিক্ত বিষয় বেশি জিপি থাকার কারণে একজন আবেদনকারী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে; অথচ একই যোগ্যতা থাকা অন্য আবেদনকারী আবশ্যিক বিষয়ে বেশী ও অতিরিক্ত বিষয় কম জিপি থাকার কারণে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্য বিবেচিত হচ্ছে।
ফলাফল প্রস্ততিতে বৈষম্য
বিজ্ঞপ্তির ৬নং ক্রমিকে ফলাফল প্রস্ততির ক্ষেত্রে নিম্নরূপে পদ্ধতি উল্লেখ করা হযেছে:
“মোট ১৫০ নম্বরের ভিত্তিতে ফলাফল প্রস্তুত করা হবে। ভর্তি পরীক্ষার ১০০ নম্বরের সাথে এসএসসি/সমমানের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের (চতুর্থ বিষয় ব্যতীত) ভিত্তিতে ২৫ এবং এইচএসসি/সমমানের পরীক্ষায় প্রাপ্ত নম্বরের (চতুর্থ বিষয় ব্যতীত) ভিত্তিতে ২৫ নম্বর যোগ করে ফলাফল প্রস্তুত করে মেধা ও অপেক্ষমান তালিকা তৈরি করা হবে।”
প্রত্যেক আবেদনকারীর ক্ষেত্রেই জীববিজ্ঞান ও গনিত বিষয়ের একটি ৩য় আবশ্যিক ও অন্যটি চতুর্থ বিষয় হিসেবে বিবেচিত। অতএব, এক্ষেত্রেও যার ৩য় আবশ্যিক বিষয়ে বেশী নম্বর ও চতুর্থ বিষয়ে কম নম্বর, তার ২৫ নম্বরের মধ্যে বেশী নম্বর যুক্ত হবে, অথচ একই বিষয় পড়েও যার ৩য় আবশ্যিক বিষয়ে কম নম্বর ও চতুর্থ বিষয়ে বেশী নম্বর আছে, তার কম নম্বর যুক্ত হবে। সকল প্রার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এনিয়মটি কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না।
আমি প্রক্টর/এডভাইজার/উপ-উপাচার্য হিসেবে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক ভর্তি কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। তখন ভর্তি পরীক্ষায় আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষার ৪র্থ বিষয়সহ জিপিএ উল্লেখ করা হতো এবং উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়সমুহের প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদা ভাবে কমপক্ষে ৩.০০ জিপি থাকা বাধ্যতামূলক ছিল। গুচ্ছ পদ্ধতিতে কৃষিতে স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর (২০১৯-২০ থেকে) আবেদনকারীদের ভোগান্তি কমলেও আবেদনের যোগ্যতা হিসেবে এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান উভয় পরীক্ষায় (৪র্থ বিষয় ব্যতিত) ন্যূনতম জিপিএ নির্ধারণ করায় আবেদনকারীগণ সমসুযোগ পাচ্ছেন না। অথচ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের জীববিজ্ঞান, রসায়ন, পদার্থবিজ্ঞান ও গণিত বিষয়সমুহের প্রত্যেকটিতে আলাদা আলাদা ভাবে ন্যূনতম জিপি উল্লেখ না থাকায় উল্লেখিত বিষয়মসূহে শুধুমাত্র উত্তীর্ন (দূর্বল) প্রার্থীগণই আবেদনের সুযোগ পাচ্ছে।
আবার ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ পর্যন্ত ফলাফল প্রস্ততির সময়ে এসএসসি/সমমান পরীক্ষার মোট জিপিএ এর ৮ গুন ও এইসএসসি/সমমান পরীক্ষার মোট জিপিএ এর ১২ গুন করে প্রাপ্ত স্কোর ভর্তি পরীক্ষার ১০০ নম্বরের সাথে যোগ করে ফলাফল তৈরী করা হতো, ফলে কোন প্রার্থীর ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি হতো না ।
উপরোক্ত বিষয়াবলীর সঠিক অনুধাবনের জন্য গভীর পর্যবেক্ষনের প্রয়োজন রয়েছে। আশাকরি কৃষি বিশ^দ্যিালয়সমূহের উপাচার্যবৃন্দের সঠিক পর্যবেক্ষন ক্ষমতা রয়েছে এবং একই যোগ্যতাসম্পন্ন সকল প্রার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়ার মানসিকতা পোষণ করেন। অধিকতর যোগ্য প্রার্থী নির্বাচনের জন্য নিম্নোক্ত শর্ত আরোপ করা যেতে পারে:
১। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের প্রতিটিতে কমপক্ষে জিপিএ ৪.০০ (৪র্থ বিষয়সহ) এবং মোট জিপিএ কমপক্ষে ৮.৫ এর স্থলে ৮.৭৫ বা ৯.০০ (৪র্থ বিষয়সহ) নির্ধারণ করা যেতে পারে।
২। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ের প্রত্যেকটিতে কমপক্ষে জিপি ৩.৫ নির্ধারণ করা যেতে পারে, এমনকি উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেনীর ইংরেজি বিষয়েরও নূন্যতম জিপি ৩.৫ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
৩। ফলাফল প্রস্ততির ক্ষেত্রে ভর্তি পরীক্ষার নম্বরের সাথে এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি উভয় পরীক্ষার মোট জিপিএ বা মোট নম্বর যোগ করে প্রস্তত করতে হবে।
উল্লেখ্য যে সাধারন গুচ্ছভুক্ত ২৪টি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে বিজ্ঞান শাখা হতে এইচএসসি/সমমান পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আবেদনকারীদের এসএসসি/সমমান ও এইচএসসি/সমমান উভয় পরীক্ষায় (৪র্থ বিষয়সহ) ন্যূনতম জিপিএ ৩.৫ সহ সর্বমোট জিপিএ কমপক্ষে ৮.০০ নির্ধারণ করা আছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এর মত সনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ এবং পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অকৃষি অংশ উল্লেখিত ২৪ বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত।
আশাকরি সমযোগ্যতাসম্পন্ন সকল শিক্ষার্থীকে সমান সুযোগ দেওয়ার লক্ষে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের উপাচার্যবৃন্দ বিষয়টি আমলে নিয়ে পূণঃ ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করার ব্যবস্থা গ্রহন করবেন। তা না হলে ভুক্তভোগী যে কেহই আইনের আশ্রয় গ্রহণ করতে পারে।
লেখক: অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
সারাবাংলা/এসবিডিই
কৃষিগুচ্ছে ভর্তি: ন্যূনতম যোগ্যতা ও ফলাফল প্রস্ততিতে বৈষম্য প্রফেসর ড. মো. সেকেন্দার আলী মত-দ্বিমত