বই বাড়িয়ে দাও
২৩ এপ্রিল ২০২৪ ১৫:১৭
বই নিয়ে কত কথা প্রতিদিন। এসব কথার বড় অংশজুড়ে থাকে হাহুতাশ, আক্ষেপ, উদ্বেগ, উচাটন। কাগজের বই হারিয়ে যাচ্ছে, পাঠাভ্যাস কমে যাচ্ছে, প্রযুক্তির দাপট বাড়ছে ইত্যাদি, ইত্যাদি। সব কথা যেমন সত্য নয়, তেমনি আবার মিথ্যেও নয়। সমাজ-বাস্তবতার রূপান্তর ঘটছে,আর্থ-সামাজিক অবস্থা পাল্টাচ্ছে, মানুষের মন, চিন্তা, সামগ্রিক ভাবনার জগতে তোলপাড় চলছে প্রতিনিয়ত। এমন সময়ে পাঠাভ্যাস কিংবা বইপড়ার মতো সুকুমার চর্চায়ও পরিবর্তন আসবে সেটাই স্বাভাবিক।
ওরিয়ানা ফাল্লাচীর বিখ্যাত একটি বই, ‘হাত বাড়িয়ে দাও’। তার কাছে ঋণ স্বীকার করেই লেখার শিরোনাম ‘বই বাড়িয়ে দাও’। পাথরে খোদাই করে কিংবা গাছের বাকলে যখন মানুষ মনের ভাব প্রকাশ করত সেই সময় থেকেই বলা হয়ে আসছে বইয়ের কোন বিকল্প নেই। আজও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষতার যুগে এসে বলা হচ্ছে বই-ই মানুষের বিশ্বস্থ সঙ্গী।
কথা হলো, তবু কেন বলতে হয় বই বাড়িয়ে দাও। সময়টা এখন এমন যে, হাত বাড়ালেই মন যা চায় তা-ই পাওয়া যায়। এমনকি আঙুল দিয়ে ছুঁয়েই পাওয়া যায় কত কিছু। এই সহজ পাওয়া আর দেখার তুমুল উন্মাদ সময়টা আমাদের চিন্তাভাবনায় নিয়ে এসেছে বহুমুখী উদ্বেগ। সম্ভাবনার চোখে যতটুকু দেখার সুযোগ মেলে তারচেয়ে বেশী বেগে ধেয়ে আসে দুর্ভাবনাগুলো। বইয়ের প্রয়োজন সেই দুর্ভাবনাগুলোকে তাড়াতে।
ডিজিটাল জমানা বই পড়ার অভ্যাসকে খেয়ে ফেলেছে-এরকম বুলি এখন অহরহ শোনা যায়। বিষয়টা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না কিন্তু প্রযুক্তি পাঠাভ্যাসে যে নিয়ে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন সেটিও অস্বীকার করা যায় না। পাঠের বিবর্তন ঘটছে প্রতিনিয়ত। ভূর্জপত্র তালপাতা, প্যাপিরাস কিংবা টাইপরাইটারের যুগ পেরিয়ে এলো মুদ্রণযন্ত্র। রূপান্তর হচ্ছে বইয়েরও। কাগজের বইয়ের পাশাপাশি এখন যুক্ত হয়েছে ইবুক, কিন্ডেল, অডিও বুক ইত্যাদি। তবে কাগজের বই পড়া আর অনলাইনে, স্ক্রিনে বই পড়ার মধ্যে পার্থক্য তো অবশ্যই আছে। বিশেষ করে মানুষের মস্তিষ্কের বোধগম্যতা বিকাশের জন্য মুদ্রিত বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। একটি কাগজের বই কিংবা বইয়ের ঘ্রাণে যে অদ্ভুত ভালোলাগা লুকিয়ে থাকে, দুটি পৃষ্ঠার মাঝখানে ভাবনার যে আলোকরশ্মি উঁকি দিয়ে যায় সেটা ব্যাকুল পাঠক ছাড়া কেউ অনুভব করতে পারবে না। আবার সময়ের সাথে চলতে গিয়ে পিডিএফ কিংবা কিন্ডেল বুকও আমাদের অন্যরকম আনন্দ দেয়। অডিও বুক নতুন প্রজন্মের পাঠাভ্যাসে যুক্ত করেছে ভিন্নধর্মী আবেগ। পাঠের একেকটি মাধ্যমের উপকারিতা একেক রকম। মোটকথা, কাগজের বইকে ডিজিটাল বইয়ের মুখোমুখি দাঁড় করানো সমীচীন হবে না। পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারলে সেটা সময়ের দোষ না। আসল কথা হলো, যার যার সুবিধা অনুযায়ী যেকোনোভাবে বইয়ের সাথে থাকা।
তাই বলি,যেভাবেই হোক বই বাড়িয়ে দিন। বাচ্চার জন্মদিনের চকলেটের সাথে বই বাড়িয়ে দিন, বিয়ের অনুষ্ঠানে ডিনার সেটের সাথে বই বাড়িয়ে দিন। স্কুলের ম্যাথ, সায়েন্স, জিওগ্রাফির সাথে ফেলুদা, ঠাকুরমার ঝুলি এগিয়ে দিন, পাড়ার স্পোর্টসের পুরস্কারে বই বাড়িয়ে দিন। ঈদে, পুজায়, ছুটিতে, অবকাশে বইকে সঙ্গী করুন। যখন যাকে কাছে পান বলুন, বইয়ের চেয়ে মানুষের আপন কেউ নেই। তাকে বুঝান, একটি সার্থক জীবনের জন্য বই পড়ার প্রয়োজন সর্বাগ্রে। বইকে সুখে-দুখে,আনন্দ-বেদনায়, হতাশায়-সফলতায় নিজের জীবনের সঙ্গী করুন। আর এই কাজটি কেউ আপনাকে করে দেবে না, নিজেকেই এগিয়ে আসতে হবে।
ম্যাক্সিম গোর্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদার’কে অবলম্বন করে নাটক লিখেছেন ব্রেখট। সেখানে মা বলছেন (শঙ্খ ঘোষের অনুবাদ)-
‘ঘর নেই যার,খোঁজো তোমার স্কুল
কাঁপছে শীতে,জানো তোমার মূল
খিদেয় কাতর, ধরো তোমার বই
অস্ত্র হবে ও-ই’
বই কি তবে দুর্দিনে, দুঃসময়ে লড়াই করার অস্ত্রও নয়?
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সিলেট ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, প্রবর্তক, ইনোভেটর বইপড়া উৎসব
সারাবাংলা/এসবিডিই