Sunday 24 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মূল্যস্ফীতি, মজুরি হার ও জীবন-জীবিকা প্রসঙ্গ

ড. মিহির কুমার রায়
১ মে ২০২৪ ১৪:৪১

মহান মে দিবস আজ। বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলনসংগ্রামের স্বীকৃতির দিন। শ্রমিকদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে প্রতিবছর ১ মে সারাবিশ্বে দিবসটি পালন করা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও গুরুত্বের সঙ্গে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে আজ সরকারি ছুটি। এবারের মে দিবসের প্রতিপাদ্য– ‘শ্রমিকমালিক গড়ব দেশ, স্মার্ট হবে বাংলাদেশ।’

মহান মে দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশসহ বিশ্বের সব শ্রমজীবী মানুষকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়ে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেন, আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প ও শ্রমবান্ধব বর্তমান সরকার শ্রমিকের সার্বিক কল্যাণসাধন ও দক্ষতা বাড়ানোতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নত কর্মপরিবেশ, শ্রমিকমালিক সুসম্পর্ক, শ্রমিকের পেশাগত নিরাপত্তা, সুস্থতাসহ সার্বিক অধিকার নিশ্চিতকরণের কোনও বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মালিকশ্রমিকের মধ্যে সৌহার্দ ও সুসম্পর্ক বজায় রাখার মাধ্যমে নিরাপদ কর্মপরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রম আইন যুগোপযোগী ও আধুনিকায়ন করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন খাতে কর্মরত শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছে। আমরা রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শিল্পের শ্রমিককর্মচারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে একটি কেন্দ্রীয় তহবিল গঠন করেছি এবং সহয়োগিতা অব্যাহত রেখেছি। সব সেক্টরে শ্রমিকদের বেতনভাতা বাড়ানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

১৮৮৬ সালের এদিনে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেটের শ্রমিকরা ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। ওই সময়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের ঘিরে থাকা পুলিশের প্রতি অজ্ঞাতনামা কেউ বোমা নিক্ষেপ করলে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর গুলি চালায়। এতে ১০১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হয়। ওইদিন তাদের আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে বিশ্বে শ্রমিক শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ শিকাগোর হে মার্কেটে দিনে ৮ ঘণ্টা কাজের দাবিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকজন শ্রমিককে জীবন দিতে হয়। তবে দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয় আরও পরে। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবার্ষিকীতে প্যারিসে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে ১৮৯০ সাল থেকে শিকাগো প্রতিবাদের বার্ষিকী আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে পালনের প্রস্তব করেন রেমন্ড লাভিনে। ১৮৯১ সালে আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে এ প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরপর ১৮৯৪ সালে মে দিবসের দাঙ্গার ঘটনা ঘটে। এই ধারবাহিকতায ১০০ বছর পর ১৯০৪ সালে আমস্টারডাম শহরে অনুষ্ঠিত সমাজতন্ত্রীদের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এ উপলক্ষ্যে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই প্রস্তাবে বিশ্বজুড়ে সব শ্রমিক সংগঠন ১ মে ‘বাধ্যতামূলকভাবে কাজ না করার’ সিদ্ধান্ত নেন। এরপর থেকে সারাবিশ্বে দিনটি ‘মে দিবস’ হিসাবে পালিত হয়ে আসছে।

শ্রমিক মজুরি, মূল্যস্ফীতির হার ও জীবনের গল্প

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্যমতে, গত মার্চে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। আগের বছরের একই মাসে যা ছিল ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ। চলতি বছরের মার্চে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল আরও বেশি, ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ। আর ১২ মাস ধরে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। কিন্তু সে অনুযায়ী বাড়েনি শ্রমজীবীদের মজুরি। বিষয়টি বিবিএসের তথ্যেও উঠে এসেছে। গত মার্চে সাধারণ মজুরি বাড়ানোর হার ছিল ৭ দশমিক ৮০ শতাংশ। সে হিসাবে মূল্যস্ফীতির তুলনায় তা কম ছিল ২ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ। আর খাদ্য মূল্যস্ফীতি প্রায়ই সার্বিক মূল্যস্ফীতিকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের শ্রমজীবীসহ নিম্ন আয়ের মানুষ প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য গ্রহণ এবং চাহিদা ছেঁটে জীবনযাপনের ব্যয় সংকুলান করছেন। জীবিকা নির্বাহ কঠিন হওয়ায় অনেকে আবার শহর ছাড়ারও চিন্তা করছেন। তাদেরই একজন পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার ইউনুস আলী। আগে দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে অন্যের কৃষিজমিতে কাজ করতেন। সেই আয় দিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হওয়ায় পাড়ি জমান ঢাকায়। কারওয়ানবাজারে এখন কুলির কাজ করছেন। থাকেন একটি মেসে। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এ সময়ে নিজের খাবার খরচ ও মেস ভাড়া মিটিয়ে বাড়িতে তেমন টাকা পাঠাতে পারছেন না বলে জানান। তাই আবার গ্রামে পরিবারের কাছেই ফিরে যাওয়ার চিন্তা করছেন ইউসুফ।

বিজ্ঞাপন

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, প্রকৃত আয় না বাড়ায় শ্রমিকদের ভোগ কমছে। দীর্ঘমেয়াদে জীবনয়াত্রার মান কমে গিয়ে তারা চরম দারিদ্র্যসীমায় নেমে যেতে পারেন। আর ভোগ কমলে বিনিয়োগও কমবে। ফলে কমে আসতে পারে প্রবৃদ্ধিও। টিকতে না পেরে ২০২৩ সালে প্রতি হাজারে প্রায় ১৪ জন শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান। পাঁচ বছর আগে এ হার ছিল একজনেরও কম। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস২০২৩ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছর প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছে ১৩ দশমিক ৮ জন। আগের বছর এ হার ছিল ১০ দশমিক ৯ জন। ২০২১ সালে প্রতি হাজারে ৫ দশমিক ৯ জন শহর ছেড়ে গ্রামে পাড়ি দেন। ২০২০ সালে এ হার ছিল ৮ দশমিক ৪ জনে। ২০১৯ সালে প্রতি হাজারে শহর ছেড়ে গ্রামে গেছেন একজনেরও কম বা দশমিক ৭ জন। অর্থাৎ আগের চেয়ে বেশি মানুষ এখন শহর ছেড়ে গ্রামে যাচ্ছেন।

তীব্র তাপপ্রবাহের প্রভাব জীবনমানে

চলমান তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে ঠিকমতো বাইরে কাজ করতে পারছেন না শ্রমিকরা। এতে তাদের আয় কমে গেছে। সংসার চালাতে অনেককে বেশ হিমশিম খেতে হচ্ছে। বরগুনা থেকে ঢাকায় এসেছেন নজরুল ইসলাম। জীবিকা নির্বাহ করছেন রিকশা চালিয়ে। এফডিসি মোড়ে তার সঙ্গে কথা হলে জানান, রোদের প্রখরতায় ঠিকমতো কাজ করতে পারছেন না। কিছু সময় পরপর পানি বা শরবত পান করতে হচ্ছে, তাতে বাড়তি ব্যয়ও গুনতে হচ্ছে। অথচ সে অনুযায়ী আয় নেই তার। নিম্ন আয়ের মানুষকে মজুরির একটি বড় অংশই ব্যয় করতে হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতেই। অথচ মূল্যস্ফীতির তুলনায় তাদের আয় বাড়ানোর হার সেভাবে বাড়েনি। আর খাদ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ভারী বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রংপুর থেকে ঢাকায় এসে রিকশাভ্যান চালান আলম মিয়া। তিনি জানান, আগে গাড়ির জমা হিসেবে দিনপ্রতি মালিককে দিতে হতো ১৫০ টাকা করে। এখন সেটি বাড়িয়ে দিতে হয় ২০০ টাকা। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই দাম বেড়ে গেছে।

বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে কম মজুরি বেড়েছে শিল্প খাতের শ্রমিকদের। গত মার্চে এ খাতের মজুরি বাড়ানোর হার ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ। অর্থাৎ সাধারণ মজুরির তুলনায় তাদের মজুরি বাড়ানোর হার আরও কম। যদিও কৃষি ও সেবাখাতের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর হার ছিল ৮ শতাংশের বেশি। দেশে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির আগেও মূল্যস্ফীতির তুলনায় শ্রমিকের মজুরি হার ছিল বেশি। পণ্যের দামের চেয়ে মজুরি বেশি পাওয়ায় শ্রমিকের প্রকৃত আয় বা ক্রয়ক্ষমতাও বেশি ছিল তখন। কিন্তু ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত টানা ২৬ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির চেয়ে শ্রমের মূল্য কম, যা দারিদ্র্যসীমার হারকে উসকে দিচ্ছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এর বক্তব্য, ‘প্রকৃত আয় না বাড়ায় শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি বাড়ছে না। ফলে তাদের জীবনমান কমছে। দীর্ঘমেয়াদে তারা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাবে। আর ভোগ কমায় বিনিয়োগ কম হবে। এতে প্রবৃদ্ধিও কমে আসবে।

এর প্রভাব থাকবে খানা ও জাতীয় পর্যায়েও। সামাজিক অসন্তোষ ও বিচ্ছিন্নতাবোধও বাড়তে পারে এ কারণে।’ বিভাগভিত্তিক হিসাবে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম, বরিশাল ও সিলেট বিভাগে মজুরি বাড়ানোর হার ৭ শতাংশের কম। অর্থাৎ এসব এলাকায় মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বেশি। সিলেটে মজুরি বাড়ানোর হার ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ, চট্টগ্রামে ৬ দশমিক ৫৩ আর বরিশালে ৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ। দেশের ৬৩ খাতের তথ্য সংগ্রহ করে মজুরি বাড়ানোর পরিসংখ্যান প্রকাশ করে বিবিএস। এর মধ্যে ১৭টি খাত কৃষিসংক্রান্ত, শিল্পসংশ্লিষ্ট ৬৩টি ও সেবাসংক্রান্ত খাত রয়েছে ১৬টি।

মূল্যস্ফীতি বাড়লে দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়, যারা দারিদ্র্যসীমার কাছাকাছি ছিল চলমান পরিস্থিতির কারণে তারা সীমার নিচে নেমে যাবে। আর এটা চলতে থাকলে চরম দারিদ্র্য ও বৈষম্যও বেড়ে যাবে।’ বিবিএস মূলত ১২টি খাতের সমন্বয়ে মূল্যস্ফীতির হিসাব প্রকাশ করে। মূল্যস্ফীতির খাতভিত্তিক তথ্যমতে, খাদ্যের পাশাপাশি বাসা ভাড়া, পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস ও অন্যান্য জ্বালানির বিল বাবদ ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে। মার্চে এ খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১ দশমিক ৯৩ শতাংশ। বাড়ির আসবাবখাতে এ হার ছিল ১৩ দশমিক ৬১ শতাংশ। বিনোদন খাতে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১৭ শতাংশের বেশি।

এ ব্যাপারে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী বলেন ‘মূল্যস্ফীতি যে হারে বাড়ছে সেভাবে মজুরি বাড়েনি। তার বড় কারণ শ্রমিকের চাহিদা না বাড়া। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং ডলার সংকটসহ আমদানি নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে বিনিয়োগ কম হচ্ছে। ফলে শ্রমের চাহিদাও কম। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এলে এবং অর্থনীতি চাঙ্গা হলে শ্রমিকের মজুরি আবার বেড়ে যাবে। এটা সাময়িক সমস্যা, দুইতিন মাসের মধ্যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসতে পারে। মূল্যস্ফীতির প্রভাব মোকাবেলায় করণীয় সম্পর্কে তার বক্তব্য হলো, উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে ভালোভাবে নজর দিতে হবে। সরকার অবশ্য সামাজিক সুরক্ষা জোরদারে চেষ্টা করছে। আগামী বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ ও সেবার পরিধি বাড়বে বলে আশা করছি আমরা। টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। সরকার এ বিষয়ে সজাগ রয়েছে।

কৃষি শ্রমিক ও মে দিবস

কৃষিতে শ্রম দিয়ে যারা জীবিকা অর্জন করে তাদের কৃষি শ্রমিক বলা হয়। নানা কারণে কৃষিতে শ্রমশক্তি ক্রমহ্রাসমান। ২০০০ সালে দেশের মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ৬০ শতাংশ ছিল কৃষি শ্রমিক। সেটি কমে বর্তমানে ৩৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০৫০ সাল নাগাদ তা ২০ শতাংশে ঠেকতে পারে। মূলত কৃষি শ্রমখাতে অবহেলার কারণে দেশে কৃষি শ্রমিকের হার দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। কৃষি খাতে ভর্তুকি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রণোদনা, কৃষি ঋণ, বিনামূল্যে এবং ভর্তুকি মূল্যে উচ্চফলনশীল বীজ সরবরাহ, সারসহ কৃষি উপকরণে উন্নয়ন সহায়তা প্রদান ইত্যাদির প্রচলন থাকলেও কৃষক যখন মাঠে কাজ করবেন তখন তার স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা তথা মানসিক প্রশান্তির জন্য কোনও অবকাঠামোগত সুবিধা নেই। প্রখর রোদে তারা কাজ করলেও বিশ্রাম নেওয়ার কোনও জায়গা নেই। কৃষককে মাঠেঘাটের নোংরা কাদামাটির ওপর বসেই খাবার খেতে হয়। কাছাকাছি কোনও নিরাপদ পানির উৎস না থাকায় অনিরাপদ পানি খেতে হয়। প্রতি বছর মে দিবস এলেই শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে নানারকম সভাসমাবেশ, বক্তৃতাবিবৃতি, সেমিনারসিম্পোজিয়াম ও শোভাযাত্রার আযােজন করা হয়। সংবাদপত্রে বের করা হয় বিশেষ ক্রোড়পত্র। ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সম্প্রচার করা হয় আলোচনা অনুষ্ঠান, প্রামাণ্য অনুষ্ঠান ও টক শো।

মে দিবস আসে আবার চলেও যায়। কিন্তু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রমিক শ্রেণী তথা কৃষি শ্রমিকদের কথা থাকে উপেক্ষিত। অথচ কৃষিভিত্তিক আমাদের এ দেশ বাংলাদেশ। মোট জনশক্তির প্রায় ৫০ ভাগ এখনো প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষিকাজে নিয়োজিত। কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর সর্বাধিক এ খাতটি নিয়ে তেমন কোনও আলোচনা দেখা যায় না। উপরন্তু কৃষি শ্রমিকদের নেই কোনও সংগঠন, সমিতি বা কারখানার শ্রমিকদের মতো ট্রেড ইউনিয়ন। আর তাই তাদের মৌলিক মানবিক ও সামাজিক অধিকার, সুযোগসুবিধা এবং নানা সমস্যা থেকে যায় অতল অন্ধকারে।

কৃষি শ্রমিকদের অর্ধেকই হলো আবার নারী কৃষি শ্রমিক। যেখানে কৃষি শ্রমিকদের শ্রমিক শ্রেণীর অংশই মনে করা হয় না সেখানে নারী কৃষি শ্রমিক যারা ফসল রোপণবপন, পরিচর্যা এবং ফসল সংগ্রহোত্তর কার্যক্রমের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত তাদের অবস্থান কোথায় তা সহজেই বোধগম্য। বিগত জাতীয় কৃষিশুমারিগুলোর রিপোর্টে দেখা যায়, দেশে কৃষি খামারের সংখ্যা ও আয়তন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বেড়েছে ভূমিহীন ও বর্গাচাষীর সংখ্যা। গ্রামে বর্গাচাষীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কৃষিখামারের আয়তন কমে যাওয়ায় কৃষি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক কিছু নয়। দ্রুত নগরায়ণ ও গ্রামে ভূমিহীনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় শহরেও ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। উচ্চমূল্যের কৃষি উপকরণ, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, কৃষিতে মধ্যস্বত্বভোগী ও মহাজনের দৌরাত্ম্য, কৃষিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকরা খাপ খাওয়াতে না পারা প্রভৃতি কারণে স্বাধীনতাউত্তর ক্রমান্বয়ে প্রান্তিক কৃষকরা ভূমিহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হচ্ছে। বর্তমানে এদের অবস্থা হয় বর্গাচাষী বা কৃষি দিনমজুর কিংবা নগর শ্রমিক। খুলনা বিভাগে জমিতে লবণাক্ততা ও রাজশাহী বিভাগে খরা ও পানিস্বল্পতার কারণে অনেক জমি কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। ফলে বেকার হয়েছে পড়ছে কৃষি শ্রমিক। এছাড়াও দেশে কৃষি শ্রমিকদের সারা বছর নিরবচ্ছিন্ন কাজ থাকে না। তাই তারা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এজন্য আমরা লক্ষ করি ধান কাটার মৌসুমে পর্যাপ্ত কৃষি শ্রমিক পাওয়া যায় না।

সরকার শ্রমিকদের স্বার্থ সংরক্ষনে সজাগ রয়েছে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ বির্নিমানে শ্রমিকদের নিয়ে সাথে করে দেশকে গড়বে। মে দিবস বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন। দেশে দ্রব্যমূল্যের সঙ্গে সংগতি রেখে অন্য পেশাজীবীদের বেতনভাতা বাড়লেও অনেকেই পিছিয়ে রয়েছেন। এছাড়াও অনেক প্রতিষ্ঠানে বেতন অনিয়মিত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে। জয় হোক মেহনতি মানুষের।

লেখক: অধ্যাপক (অর্থনীতি) , সাবেক ডিন, ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদ, সিটি ইউনিভার্সিটি, ঢাকা

সারাবাংলা/এসবিডিই

বিজ্ঞাপন

বিদেশ বিভুঁই। ছবিনামা-১
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ২৩:০০

আরো

সম্পর্কিত খবর