Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা: এবার তারিখটাও বদলে দিলো বিএনপি!

আসাদ জামান
৩০ মে ২০২৪ ০০:১৫

রাজনীতিতে মিথ্যার চর্চা একেবারেই স্বাভাবিক ঘটনা। মিথ্যা না বললে রাজনীতি হয় না। কিন্তু যে মিথ্যা জাতির ইতিহাসকে বদলে দেয়, সে মিথ্যা যে পক্ষ থেকেই হোক, তার প্রতিবাদ হওয়া দরকার। এই প্রতিবাদ করার জন্য কোনো দল বা সংগঠনের সক্রিয়া সদস্য বা কর্মী হওয়ার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন কেবল ইতিহাসারে প্রতি দায়বদ্ধতা, সত্যের সারথি হওয়া।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ৪৩তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার (২৯ মে) গণমাধ্যমে দলটির মহাসচিবের নামে যে ‘বাণী’ পাঠানো হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে দেশের মানুষ যখন দিশেহারা ঠিক সেই মুহূর্তে ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা পুরো জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উজ্জীবিত করেছে।’

এতদিন শুধু জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে আসছিল বিএনপি। কিন্তু তারা কোনোদিন বলেনি, জিয়া এই ঘোষণাটা ২৬ মার্চ দিয়েছিলেন। জন্ম-মৃত্যুবার্ষিকীতে দেওয়া বাণীতে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করলেও ঘোষণার তারিখটা সব সময় ২৭ মার্চ হিসেবেই উল্লেখ করেছে বিএনপি। কখনো কখনো কৌশলে এড়িয়ে গেছে। তবে তাদের নিজেদের লেখা বই-পুস্তক দলিল-দস্তাবেজে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণার তারিখ ২৭ মার্চ-ই উল্লেখ আছে।

প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহর লেখা ‘প্রেসিডেন্ট জিয়া: রাজনৈতিক জীবনী’ বইয়ের ২৬ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখা হয়েছে— ‘‘সম্প্রতি একাত্তর সালের ২৫ মার্চের ঘটনাবলি নিয়ে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল সে ব্যাপারে শমসের মুবিন চৌধুরী বীর বিক্রম জানান: সত্যি বলতে কী, ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতরকেন্দ্র থেকে দেওয়া মেজর জিয়ার সেই বিখ্যাত স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে নিজের ভাষ্য দিতে গিয়ে প্রত্যেকেই আসল সত্য থেকে দূরে সরে গেছেন। এই সাহসী লোকটির অধীনে চট্টগ্রামে লড়াই করাকালে আমার স্বকর্ণে তা (স্বাধীনতার ঘোষণা) শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— মেজর জিয়ার নির্দেশে ২৮ মার্চ সারাদিন ধরে সেই কেন্দ্র থেকেই আমাকে তার ঐতিহাসিক ঘোষণাটি বার বার প্রচার করতে হয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন সুবেদ আলী ভূঁইয়া।… আওয়ামী লীগ নেতা হান্নানের সুনির্দিষ্ট অনুরোধে মেজর জিয়া তার ৩০ মার্চ দেওয়া দ্বিতীয় ভাষণে শেখ মুজিবের নাম অন্তর্ভুক্ত করেন।… মেজর জিয়ার ২৭ মার্চ ঘোষণাটা শেষ হয়েছিল এই কথাটি দিয়ে— ‘Under the circumstances I declare myself provisional head of the government of Bangladesh. Joy Bangla.’ (বর্তমান পরিস্থিতিতে আমি নিজেকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধান হিসেবে ঘোষণা করছি, জয়বাংলা।)’’

রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর জিয়ার যে সরকারি জীবনবৃত্তান্ত প্রকাশিত হয়, সেখানে লেখা ছিল— ‘১৯৭০ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামে নবগঠিত অষ্টম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে জিয়াকে বদলি করা হয়। এই রেজিমেন্টে নিয়োজিত থাকাকালেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন এবং ১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সাড়ে সাত কোটি স্বাধীনতাকামী বাঙালির পক্ষে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।’ (সূত্র: দ্য বাংলাদেশ অবজার্ভার, ২২ এপ্রিল ১৯৭৭)

এ ছাড়া স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থপতি বেলাল মোহাম্মদ ২০১০ সালের ২১ মার্চ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সিনিয়র রিপোর্টার প্রদীপ চৌধুরীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ হয় ২০১০ সালের ২৮ মার্চ।

ওই সাক্ষাৎকারে বেলাল মোহাম্মদ বলেন, “২৬ মার্চ এদিক-সেদিক টেলিফোন করছি। টেলিফোন দেওয়ার পর চন্দনপুরের তাহের সোবাহান নামে আমার এক বন্ধু ছিল, তিনি বললেন, ‘একজন উচ্চ পদের মেজরের সন্ধান আমি জানি, তবে নাম জানি না। তিনি পটিয়াতে আছেন। তিনি হেডকোয়ার্টারের বাইরে এসেছিলেন বাবর ও সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাসের জন্য। তিনি আজ রাতে, মানে ২৬ শে মার্চ দিবাগত রাতে সিচুয়েশন অবজার্ভ করার জন্য পটিয়াতে আছেন।”

‘আমাকে উনি অ্যাডভাইজ করলেন, ২৭ তারিখ যদি পটিয়াতে যেতে পারেন নিশ্চয়ই ওনাকে ওখানে পাবেন। বললেন, যেহেতু বাইরে আছেন, নিশ্চয়ই উনি বঙ্গবন্ধুর সাপোর্টার হবেন। আমার আরেক বন্ধুর সাহায্যে আমরা একটা গাড়ির ব্যবস্থা করে পরদিন সকালে রওনা হয়েছি পটিয়ায়। আর আমার সহকর্মীদের বলে দিয়েছি, কালুরঘাটের দিকে আস্তে আস্তে যাবে। আমি পটিয়া থেকে আসার পর প্রোগ্রাম শুরু হবে।’

“পটিয়ায় পৌঁছেই দেখা গেল আর্মি গিজ গিজ করছে।… এখানে যে আর্মি অফিসার আছেন, তার নাম মেজর জিয়াউর রহমান। তার সঙ্গে দেখা হলো। তাকে বললাম, ‘আপনি তো এখানে ব্রডকাস্ট শুনেছেন।’ তিনি বললেন, ‘আপনারা যে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করেছেন, তা শুনেছি এবং খুশি হয়েছি।’”

‘আমি বললাম, আপনি যদি দয়া করে আপনার এই ছাউনিটা এখান থেকে সরিয়ে কালুরঘাটে নিয়ে যেতেন, তাহলে বাড়িটা প্রটেক্ট হবে। আমরাও ওখানে স্থায়ীভাবে থাকতে পারব। স্থায়ীভাবে না থাকতে পারলে কোনো কমিটমেন্ট করা যাবে না। ঠিক টাইমে রেডিওতে প্রোগ্রাম দেওয়া অ্যাডভেঞ্চার নয়। বেশ কিছু লোক লাগে। সব রকমের পয়েন্টে লোক বসে থাকা লাগে।’

“তারপর উনি আর দেরি করেন নাই। সৈন্যদের রওনা করিয়ে দিলেন। নিজেও একটা জিপে করে রওনা হলেন। আমাদের গাড়িটা ওনার গাড়ির পেছনে পেছনে চলল। পথে যেখানেই উনি বেশি মানুষের জটলা দেখলেন, যারা কর্মস্থল ছেড়ে পোটলা-পুটলি নিয়ে চলে যাচ্ছে, সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে একটা বক্তৃতা দিলেন। ‘আপনারা যার যার কাজের জায়গায় চলে যান। ইনশাল্লাহ দুয়েক দিনের মধ্যে আমরা পাঞ্জাবিদের খতম করে দেবো। আর উর্দু ভাষায় যারা কথা বলে তারা সব আমাদের দুশমন। তাদেরকে শেষ করে দেন।’”

“এটাই ছিল ওনার বক্তব্য। এই দশ জায়গায় থেমে থেমে যাওয়ার কারণে আমাদের কালুরঘাটে পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।… আমার সহকর্মী যারা উপস্থিত ছিল, তারা প্রোগ্রাম শুরু করল। একসময় জিয়াউর রহমান ও আমি একটা রুমে বসেছি। আমার এক সহকর্মী আমাকে কিছু কাগজপত্র দেখাচ্ছে। আমি কী মনে করে বললাম, ‘আচ্ছা মেজর সাহেব, এখানে তো আমরা সবাই মাইনর, আপনিই একমাত্র মেজর। আপনি কি নিজের কণ্ঠে কিছু বলবেন? উনি বললেন, ‘হ্যাঁ। সত্যিই তো, কী বলা যায়?’”

‘সঙ্গে সঙ্গে একটা কাগজ এগিয়ে দেওয়া হলো। তার প্রতিটি শব্দ তিনিও উচ্চারণ করেছেন এবং আমিও উচ্চারণ করেছি। এভাবে লেখা শুরু হলো— ‘আই, মেজর জিয়া অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট ন্যাশনাল লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ডু হেয়ার বাই ডিক্লেয়ার ইন্ডিপেনডেন্স অব বাংলাদেশ।… খোদা হাফেজ জয় বাংলা।’”

‘এই ঘোষণাটির খসড়াও তৈরি হলো আমার সঙ্গে আলাপ করে।… আর আমার সহকর্মীদের বলে দিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যে মেজর জিয়া একটা জরুরি ভাষণ দেবেন। এভাবে দুই-তিনবার অ্যাডভান্স অ্যানাউন্সমেন্ট করা হলো। তারপর তিনি নিজের কণ্ঠে ইংরেজিটা পড়েছেন। বাংলাটা আমার সহকর্মী আব্দুল্লাহ আল ফারুকের কণ্ঠস্বর ভালো, তাকে দিয়ে শুনিয়েছি। এভাবেই হলো। কোনো রকম পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না, পরিকল্পনা ছিল না এবং এটা স্বাধীনতা ঘোষণা না। এটা হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে একই কথার পুনরুক্তি করা।’

‘রাষ্ট্রপতি জিয়া কোনোদিন নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক বলেননি। ২৬ তারিখও বলেননি, উনি সবসময় ২৭ তারিখই (২৭ মার্চ) বলেছেন।… পরবর্তী সময় যে ঘোষক-টোষক বলা হয়েছে, এগুলো তৈরি করা। রাষ্ট্রপতি জিয়া এগুলো ক্লেইম করেননি।’

প্রকৃত অর্থে জিয়াউর রহমান জীবিত অবস্থায় কোনোদিন নিজেকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবিই করেননি। তার মৃত্যুর পর বিএনপির রাজনীতি খালেদা জিয়ার হাতে পড়লে এ বিতর্ক প্রথম শুরু হয়। খালেদা জিয়ার হাত থেকে বিএনপির রাজনীতি যখন তারেক রহমানের হাতে পড়ে, তখন এটা ‘পূর্ণতা’ লাভ করে। তারপরও জিয়ার ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ সংক্রান্ত তারিখ বিএনপি এতদিন ২৭ মার্চ-ই বলে আসছিল। হঠাৎ কেন ২৬ মার্চে নিয়ে এলো?

এর পেছনে কারণটা হলো— জিয়ার ২৭ মার্চের ‘বেতার ঘোষণা’কে স্বাধীনতার ঘোষণা দাবি করলেও ক্ষমতায় থেকে এবং ক্ষমতার বাইরে থেকে ২৬ মার্চকেই ‘মহান স্বাধীনতা দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছে বিএনপি। এ নিয়ে প্রধান প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ তো বটেই সুধী এবং সাধারণ মহল থেকেও প্রশ্ন উঠছে— জিয়ার ঘোষণা যদি স্বাধীনতার ঘোষণা হয়, তাহলে স্বাধীনতা দিবস ২৭ মার্চ নয় কেন? যে ২৬ মার্চ বিএনপি স্বাধীনতা দিবস পালন করে, সেদিন তো জিয়া ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দেননি। তার জীবদ্দশায় কোনো দিন দাবিও করেননি যে তিনি ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। সুতরাং এ ধরনের প্রশ্ন থেকে বাঁচতে বিএনপি হয়তো জিয়ার ঘোষণার তারিখটাই বদলে দিতে চাচ্ছে!

জিয়ার ‘স্বাধীনতার ঘোষণার’ তারিখটা ছাড়াও মির্জা ফখরুলের ওই ‘বাণী’-তে আরেকটি স্পর্শকাতর ভুল বা কৌশলে স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাস অস্বীকারের ইঙ্গিত রয়েছে। বাণীর চতুর্থ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষে জাতি বিদেশি শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে।’

১৯৭১ সালের বাঙালির যুদ্ধটা ছিল দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে। বিজয়টাও ছিল পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। কী এক অজানা কারণে জিয়ার মৃত্যুবার্ষিকীতে দেওয়া বাণীতে ‘পাকিস্তান’ শব্দটার উল্লেখ না করে ‘বিদেশি’ শব্দটা ব্যবহার করল বিএনপি— সেটাও গভীর কৌতূহলের জন্ম দিয়েছে বৈকি! এভাবে ইতিহাসকে অস্বীকার করে বা ভুল ইতিহাস লিখে বিএনপি কী অর্জন করতে চায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়। অবশ্য বড় দলগুলোর চেয়ারম্যান-মহাসচিব বা সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নামে পাঠানো বিবৃতি/বাণীর খসড়া সাধারণত অফিস স্টাফরা লিখে থাকেন। দফতর সম্পাদক চোখ বুলিয়ে দেন এবং যার নামে পাঠানো হয়, তিনি সচারাচার এসব বিবৃতি/বাণী পড়ে দেখেন না। ফলে এসব বিবৃতি/বাণীতে থাকা ভুলগুলোকে খুব একটা বেশি গুরুত্ব দেওয়ার সুযোগ থাকে না। তবুও কথা থেকে যায়…।

লেখক: সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

সারাবাংলা/টিআর

জিয়াউর রহমান টপ নিউজ স্বাধীনতার ঘোষণা


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর