Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পরিবেশ রক্ষায় শুধু আইন নয়, প্রয়োজন জনসচেতনতা

অমিত বণিক
৫ জুন ২০২৪ ১৪:১২

পরিবেশ মানবসভ্যতার এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। সভ্যতার ক্রমবিকাশ থেকেই মানুষ ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছে তার পরিবেশ। পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উদ্ভিদ ও প্রাণী জীবনের বিকাশ ঘটে। তাই পরিবেশ ও মানুষের মধ্যে রয়েছে এক নিবিড় যোগসূত্র। কিন্তু পরিবেশ দূষণের মাত্রা প্রকট হওয়ার কারণে মানবসভ্যতা আজ হুমকির সম্মুখীন। এ লক্ষ্যে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির জন্য জাতিসংঘ ৫ জুনকে ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। প্রতি বছর ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করার উদ্দেশ্য হলো, আমাদের এই গ্রহটিকে রক্ষা করার জন্য পরিবেশ সচেতনতা এবং পদক্ষেপের প্রচার করে বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত। সমস্যাগুলোকে মোকাবিলা করে। ২০২৪ সালের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য হলো ‘ভূমি পুনরুদ্ধার, মরুকরণ এবং খরা স্থিতিস্থাপকতা’। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তা নিয়ে আমাদের পরিবেশ। পরিবেশের উপাদানের মধ্যে রয়েছে গাছপালা, ঘরবাড়ি, পশুপাখি, রাস্তাঘাট, নদীনালা, পাহাড়-পর্বত এবং আরো অনেক কিছু। এসব উপাদান মানুষ ও অন্যান্য জীবের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য বিশুদ্ধ পরিবেশ অত্যন্ত প্রয়োজন। এগুলোর ক্ষতি হলে ভারসাম্য নষ্ট হয়। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট উভয় পরিবেশের সমন্বয়েই সৃষ্টি হচ্ছে আমাদের পরিবেশ।

বিজ্ঞাপন

মানুষের অসচেতনতা এবং অনিয়ন্ত্রিত আচরণের কারণেই পরিবেশ দূষণ হচ্ছে ও জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। মানবসৃষ্ট বিভিন্ন কারণে উৎপাদিত ক্ষতিকারক পদার্থ, যেমন- গ্রিন হাউস গ্যাস, তেজস্ক্রিয় পদার্থ, শিল্পকারখানার রাসায়নিক বর্জ্য, আগাছানাশক, ময়লা-আর্বজনা ইত্যাদি মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ করে। সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার উষ্ণতম স্থানের সঙ্গে শহরের বাইরে শীতলতম স্থানের দিন-রাতের ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য যথাক্রমে ৭ ও ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আবার ঢাকার মধ্যেও ভূপৃষ্ঠীয় তাপমাত্রার পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। ঋতুবৈচিত্রের বাংলাদেশে এখন কেবলই বৈচিত্র্যতার অভাব, সময়মতো বৃষ্টির অভাব, অসময়ে প্রবল বৃষ্টিপাত, বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ইত্যাদি আমাদের দেশের আবহাওয়ায় নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, ২০৬০ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। এতে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাবে। বর্তমানে আমরা সবচেয়ে বেশি যে সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি সেটা হল আমাদের গ্রহের বৃক্ষ হারিয়ে যাওয়া। আমাদের বন কেবল প্রজাতির আবাসস্থল নয়, তারা বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ এবং জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমনে শুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, প্রতি বছর, কৃষি এবং নগর উন্নয়নের জন্য বিশাল বনভূমি পরিষ্কার করা হয়, যার ফলে বাসস্থানের ক্ষতি, জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে সেইসঙ্গে বন পুনরুদ্ধারের জন্য আমাদের অবশ্যই স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। জলাভূমি, ম্যানগ্রোভ, তৃণভূমি এবং সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রগুলোও উল্লেখযোগ্য হুমকির সম্মুখীনে রয়েছে তাই জরুরি মনোযোগ প্রয়োজন। সরকার দেশের পরিবেশ সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘পরিবেশ সংরক্ষণ (সংশােধন) বিল ২০০২’ এবং ‘পরিবেশ আদালত (সংশোধন) বিল ২০০২’ নামে দুটি আইন পাস করেছে। কিন্তু আইনের সঠিক বাস্তবায়ন সঠিক ভাবে হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে বায়ুর তাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিজ্ঞানীদের ধারণা, গ্রিনহাউস ইফেক্টের কারণে তাপ বৃদ্ধির ফলে শিগগিরই মেরু অঞ্চল ও পর্বতশ্রেণির বরফ গলে সাগরের পানির উচ্চতা ১-২ মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর ফলে পৃথিবীর অধিকাংশ দ্বীপ সমুদ্রের লোনা পানির নিচে ডুবে যাবে এবং কোটি কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়বে ও প্রকট খাদ্য সংকট দেখা দেবে। পলিথিন, প্লাস্টিক ও রং তৈরির কারখানা থেকে ক্লোরোফ্লোরো কার্বন গ্যাস নির্গত হয়। এ গ্যাস বায়ুর ওজোন স্তরকে জাংস করে। ওজোন স্তর ছিদ্র হলে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি পৃথিবীতে এসে প্রথমে ফাইটোপ্লাংটনসহ বিভিন্ন অণুজীব ও পরে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণিকুলের ক্ষতি করছে। গ্রামের সুন্দর, নির্মল পরিবেশও নানাভাবে হচ্ছে দূষণের শিকার। যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলা যেন আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে আমরা অনেকেই কোথাও বেড়াতে গিয়ে কিংবা রাস্তাঘাটে যানবাহনে হাতের চানাচুরের প্যাকেটটি বা পানির বোতলটি ফেলতে দ্বিধা বোধ করি না। অধিকাংশ পর্যটন এলাকা কিংবা নদী থেকে টনের পর টন প্লাস্টিক বর্জা উত্তোলন, আমাদের অসচেতনতাকেই সামনে নিয়ে আসে। বর্জ্য বা ময়লা সঠিক স্থানে না ফেলার দরুন তা আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হচ্ছে। আজকাল হাসপাতালে রোগীর ক্রমবর্ধমান চাপ কী ইঙ্গিত করে? আসলে, আমাদের অসচেতনতাই রোগজীবাণু ছড়িয়ে পড়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। আমরা যত জানি, মানি তত কম। অন্যদিকে বর্জ্য নিষ্কাশনব্যবস্থাও অতিশয় দুর্বল আমাদের দেশে। বর্জ্য ফেলা হয় এমন সব জায়গায়, যেখান থেকে পরিবেশ দূষিত হওয়ার সমূহ আশঙ্কা থেকে যায়। যারা এ দায়িত্বে থাকেন তারাও যেন এগুলো যেনতেনভাবে ফেলে দিয়ে বেঁচে যেতে যান, যা কখনো কাম্য নয়। পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও নির্বিচারে সবুজ বৃক্ষ নিধন করার কারণে বৃক্ষ হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়াও শিল্প-কারখানা, ইট ভাটা, বর্জ্য, গ্রিনহাউস গ্যাস ইত্যাদি যারা বায়ু দূষিত হচ্ছে। পানি নিষ্কাশনের ড্রেনগুলো সাধারণত জলাশয়ের সাথে যুক্ত থাকার কারণে শহর, হাট-বাজার, বাসাবাড়ির ময়লা-আর্বজনা, খাল, বিল ও নদীতে পড়ে পানি দূষিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। বনভূমি উজাড়করণ এবং নির্দিষ্ট সময়ের আগে মারাত্মক ক্ষতি করবে। এতে ক্যান্সার ও বিভিন্ন প্রকার রোগের প্রকোপ বেড়ে যাবে।

সমগ্র বিশ্বে জৈব জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং শিল্পকারখানা থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনের কারণে বাতাসে এ গ্যাসের মাত্রা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন প্রকার যানবাহন থেকে নির্গত গ্যাসের মাত্রা বৃদ্ধির ফলে মারাত্মকভাবে পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। একটু রাজধানী ঢাকার দিকে লক্ষ করুন। দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, ঢাকা শহর আজ বিশ্বের দূষিত শহরের একটি। শুধু কি তা-ই, এটি এই তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ ও যানজট এ যেন ঢাকা শহরের নিত্যসঙ্গী। একসময় এ শহরটির চারপাশের প্রমত্ত নদীগুলো আজ বড়ই অসহায়। বুড়িগঙ্গা নদীর অবস্থা দেখলেই ঢাকার পরিবেশদূষণ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা বুঝতে কারো পরিবেশবিদ্যায় ডিগ্রিধারী হওয়ার প্রয়োজন নেই! অথচ এই নদীগুলোতেই একসময় দেখা যেত রংবেরঙের পালতোলা নৌকার। মানুষ এগুলোর স্বচ্ছ ও সুন্দর পানি ব্যবহার করত দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় কাজে। ঢাকা শহরের নদীর ওপর দিয়ে আজ নৌকা পারাপারেও দম আটকে আসে, পানির নোংরা দুর্গন্ধে। যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনার উপস্থিতি লক্ষণীয় হারে বেড়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে গাছকাটা নিষিদ্ধ ঘোষণ করতে হবে। আমরা নিজেরা বেশি করে গাছ লাগাবো আর অন্যকে গাছ লাগানোয় উৎসাহিত করবো। গাড়ির ক্ষতিকর ধোঁয়া বন্ধ রাখার চেষ্টা করা এবং অন্যকে এ ব্যাপারে সচেতন করা। পাহাড় কাটা বন্ধ রাখা এবং এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করা। ময়লা আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলা এবং বর্জ্য পদার্থ যেখানে সেখানে নিষ্কাশিত না করা। কৃষিতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সারের ব্যবহার বাড়াতে হবে। শিল্প-কারখানা, গৃহস্থালি ইত্যাদির বর্জ্য পদার্থ নির্দিষ্ট জায়গায় ফেলতে হবে। সর্বোপরি পরিবেশ দূষণ রোধে জনগণের সচেতনতা বাড়ানোর বিকল্প নেই।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সারাবাংলা/এসবিডিই

অমিত বণিক পরিবেশ রক্ষায় শুধু আইন নয়- প্রয়োজন জনসচেতনতা মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর