৬ দফা: বাঙালির ম্যাগনাকার্টা
৬ জুন ২০২৪ ২২:২৮
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যূদয় এশিয়ার রাষ্ট্রসমূহে এক অসাধারণ অবস্থান নিয়ে আছে। ভারতীয় জাতীয়তা ও ধর্মভিত্তিক পাকিস্তানি জাতীয়তার বিপরীতে নৃতাত্ত্বিকভাবে একক জাতিসত্তার স্বতন্ত্র জাতীয়তার বিকাশ; এবং গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ ধরে সশস্ত্র যুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা অন্যান্য উপনিবেশসমূহের স্বাধীনতা অর্জনের পথ থেকে স্বতন্ত্র ও অনন্য। ইতিহাস জানান দেয়- এশিয়াসহ বিশ্ব উপনিবেশসমূহের স্বাধীনতা অর্জনের পথ প্রায় অভিন্ন। এসব দেশ হয় সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। নতুবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দখলদারিত্ব ছেড়ে সাম্রাজ্য গুটিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো দেশের স্বাধীনতা দান হিসেবে অর্জিত হয়েছে। এই তিনপথের বাইরে বাংলাদেশ একমাত্র রাষ্ট্র যা ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও সশস্ত্র যুদ্ধের সমন্বয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এখানেই স্বাধীন বাংলাদেশের অনন্যতা।
পাকিস্তানের যাত্রালগ্নে রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির বিকাশ, মর্যাদা ও অস্তিত্ব বিপন্ন হতে থাকে। ধর্মেরভিত্তিতে বিভক্ত পাকিস্তানে তথাকথিত মৌলিক গণতন্ত্রের নামে এককেন্দ্রিক রাষ্ট্রপতি শাসন সম্বলিত শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে পূর্বাঞ্চলের বাঙালি জনগোষ্ঠী ও পশ্চিমাঞ্চলের পাখতুন, বালুচ, সিন্ধি প্রভৃতি জাতিগোষ্ঠীসমূহের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। তাতে মানুষের স্বাধীন বিকাশের পথ একবারেই রুদ্ধ হয়। একইসঙ্গে কথিত মৌলিক গণতন্ত্রীদের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী তৃণমূল পর্যন্ত একটি সমর্থক-বলয় গড়ে তোলে। ফলে পাকিস্তানের কাঠামোর ভেতরে গণতন্ত্রের সংগ্রাম দুষ্কর হয়ে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৫ সালে মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচন প্রত্যাশিতভাবেই সামরিক শাসক আইয়ুবের পক্ষে গেলে গণতান্ত্রিক শিবিরে আবারও হতাশা নেমে আসে। এই সময়ে পাক-ভারত যুদ্ধ পাকিস্তানের রাজনীতিতে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। যুদ্ধে পরাজয়ের মুখে রাশিয়ার তাসখন্দে পাক-ভারত শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের সকল মহল এ চুক্তিকে প্রত্যাখ্যান করলেও বাঙালি স্বার্থের প্রতিভূ শেখ মুজিব ও তাঁর দল আওয়ামী লীগ চুক্তির পক্ষে বক্তব্য রাখেন। মুজিব স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন যে, যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। ¯্রফে ভারতের শুভেচ্ছার ওপর এ অঞ্চল যুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছিল।
১৯৬৫‘র অসম পাক-ভারত যুদ্ধকে বাঙালি স্বার্থের আপসহীন লড়িয়ে শেখ মুজিব কাজে লাগাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতিতে সকলপ্রাপ্ত গণতান্ত্রিক সুযোগ কাজে লাগিয়ে অগ্রসরমান গণতান্ত্রিক গোষ্ঠী পাক-ভারত যুদ্ধের পরবর্তীতে তাসখন্দ চুক্তির পটভূমিতে লাহোরে এক কনভেনশনে মিলিত হয়। উদ্দেশ্য- আইয়ুবের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পন্থা কী হবে তা নির্ধারণ। ১৯৬৬-এর ফেব্রুয়ারির এ কনভেনশন যুদ্ধবাস্তবতার আলোকে এবং বাঙালির আশা-আকাক্সক্ষাকে সমন্বিত করে একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কর্মসূচি তুলে ধরার সুযোগ এনে দেয় শেখ মুজিবকে। তিনি এই কনভেনশনে পূর্বপাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা হিসেবে ৬টি দাবি উত্থাপন করেন, যা ঢাকায় এসে ৬-দফা কর্মসূচি হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
৬-দফা ঘোষণার সাথে তা পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থ ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতার বাইরের শক্তির কঠোর সমালোচনার মুখে পড়ে। আইয়ুব থেকে শুরু করে তার পা-চাটা ফকা চৌধুরী, মোনেম খাঁ, সবুর খাঁ, কাজী মাহাবুদ্দিন প্রমুখ নেতা এবং নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, মমতাজ দৌলতানা, মাহমুদ আলী কাসুরী, জুলফিকার আলী ভুট্টো, মওদুদী ও তার তস্য পদসেবী গো. আযমসহ বিরোধী বাঙালি-অবাঙালি নেতৃবৃন্দ ৬-দফার বিরোধিতায় মাঠ সরগরম করে তুলল। আইয়ুব বললেন অস্ত্রের ভাষায় ৬-দফার মোকাবেলা করা হবে। বিরোধীরা বললেন যে, এটা বিচ্ছিন্নতার নগ্ন দলিল। এমনকি বামনেতা মাওলানা ভাসানীও ৬-দফাকে সিআইএ-এর দক্ষিণ এশীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে দেখলেন। তিনি ঘোষণা করলেন যে, শেখ মুজিব হচ্ছেন মার্কিন দালাল। সরকারি ও অন্যান্য বিরোধী নেতারা তাকে ভারতীয় দালাল আখ্যা দিলেন। তারা ভিন্ন ভিন্ন প্লাটফরমে থাকলেও ৬-দফার বিরোধিতায় একসুরে কথা বলতে থাকলেন। কিন্তু কেন এমনটা হল? একমাত্র মস্কোপন্থী ওয়ালি ন্যাপ (পূর্বাঞ্চলে মোজাফ্ফর ন্যাপ) ছাড়া সকলেই ৬-দফা আতঙ্কে ভুগতে লাগলেন। যেন ৬-দফার ভূত তাদের তাড়িয়ে বেড়াতে লাগল।
আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতাদের একাংশ ৬-দফা প্রশ্নে দ্বিমত পোষণ করলেও একই বছরের ১৩ মার্চ অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রস্তাবসমূহ একটি সুসংঘবদ্ধ কর্মসূচি হিসেবে কাউন্সিলে অনুমোদন সাপেক্ষে অনুমোদন করে। ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে ৬-দফা কর্মসূচি অনুমোদন লাভ করে। শেখ মুজিব কর্তৃক সারাদেশে ৬-দফাকে জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তাঁর তরুণ ও তেজস্বী সহকর্মীদের নিয়ে এক ব্যাপক কর্মযজ্ঞে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এভাবে ৬-দফাকে কেন্দ্র করে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এক স্বতন্ত্র স্বাধীন বাঙালি আবাসভূমির আকাক্সক্ষার রূপ নিতে থাকে।
লাহোর-প্রস্তাবের আলোকে ফেডারেশন গড়ার অর্থই হচ্ছে দুটি সার্বভৌম রাষ্ট্রর সংঘ প্রতিষ্ঠা করা। এ ধরনের ফেডারেশন তত্ত্বে থাকলেও বাস্তবে কোথাও এর অস্তিত্ব নেই। কেন্দ্রের বা ফেডারেল সরকারের হাতে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রেখে তাকে করারোপের অধিকার বঞ্চিত রাখার যে প্রস্তাব; তা ফেডারেল সরকার নয়, ফেডারেটিং স্টেটের সার্বভৌমত্বের খোলাখুলি স্বীকৃত। এবং ফেডারেল সরকারের যুদ্ধব্যবস্থাকে ফেডারেটিং স্টেটের সদিচ্ছার ওপর ছেড়ে দিয়ে স্টেট কর্তৃক আঞ্চলিক প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠনের প্রস্তাব আর যাই হোক একই ছাদের নিচে বসবাসের কোনো উদ্যোগ নয়। এই কথা যারা ৬-দফা কর্মসূচি নিয়ে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম রচনা করছিলেন তারা যেমন জানতেন, জানতেন তারাও যারা এর বিরোধিতা করছিলেন।
বস্তুত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাধারণ সূত্র অনুযায়ী ৬-দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে পাকিস্তানে ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন কোনো অবাস্তব বা অস্বাভাবিক প্রস্তাব না হলেও কোনো ফেডারেল রাষ্ট্রের গঠনই ৬-দফানুগ নয়। ষাটের দশকে এ ধরনের ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের কয়েকটি প্রচেষ্টা মধ্যপ্রাচ্যে ভেস্তে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র বা যুগোস্লোভিয়ায় ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামো থাকলেও একমাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যতীত অন্য দুটি ফেডারেশন যে ক্ষণভঙ্গুর ছিল তা ইতিহাসের শিক্ষায় আজ প্রমাণিত। মার্কিনীদের রয়েছে এক ভাষা ও সংস্কৃতি, ধর্মবোধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য। দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তারা একটি কার্যকর গণতন্ত্রও প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাই তাদের ফেডারেল শাসন ফেডারেটিং রাষ্ট্রসমূহকে বিচ্ছিন্নতার অধিকার দিলেও কার্যত তা তত্ত্বকথা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়া ভেঙে গিয়ে ভাষাভিত্তিক, জাতিগোষ্ঠীভিত্তিক ও ধর্মভিত্তিক বৃহৎ ও ক্ষুদ্র রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে। ভারতীয় ফেডারেশন যে এখনও এক আছে তার প্রধান কারণ হচ্ছে দুটি। প্রথমত, ভারতবর্ষ বহুজাতিক বহুভাষিক দেশ হলেও তার রয়েছে কয়েক হাজার বছরের পুরনো অভিন্ন সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। দ্বিতীয়ত, ইতোমধ্যে ভারতীয়রা ত্রুটিপূর্ণ হলেও একটি কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য স্বাধীনতার সংগ্রাম গঠনেও তাদের রয়েছে এক সাধারণ ঐতিহ্য। ভারতীয়দের উদাহরণ নিয়েই আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠনের নানা প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে।
৬-দফার ভিত্তিতে প্রস্তাবিত পাকিস্তান ফেডারেশন বাস্তবে শান্তিপূর্ণ পথে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আর কিছু নয়। তাই পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধুকে জীবনের মতো নিশ্চিহ্ন করে দিতে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আশ্রয় নেয়। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু এই রাজনৈতিক দর্শনকে বাঙালির স্বাধীনতার লক্ষ্যে পরিচালিত করার জন্যই ৬-দফা কর্মসূচি উত্থাপন করেছিলেন। গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের মানস গঠনের কাজে ব্যবহার করা হয় ৬-দফাকে। এ কারণেই আগরতলা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে শেখ মুজিব পাকিস্তান ভেঙে দিতে প্রয়াসী হয়েছেন- এতবড় অভিযোগও জনগণের মাঝে হালে পানি পায়নি। জনগণ মুজিবের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে। আর মুজিব বেছে নেন আপসহীন সংগ্রামের পথ।
দ্বিতীয় দফায় সামরিক শাসন অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার কারণে আপোসের পথে অগ্রসর হয় এবং এলএফও দিয়ে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে বঙ্গবন্ধুও তার ৬-দফার ভিত্তিতে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নেন। একই সাথে তিনি উনসত্তরের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলকে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনে জনমানসকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। যা পরবর্তী সময়ে সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিতে বাংলাদেশের জনগণকে আর দ্বিধান্বিত করেনি। একাত্তরের ৭ মার্চের পর বাংলাদেশ ডি-ফ্যাক্টো স্বতন্ত্র রাষ্ট্র ও সরকার গঠনে তাই আর শেখ মুজিবকে বেশি বেগ পেতে হয়নি।
৬-দফার প্রণেতা ও উপস্থাপক শেখ মুজিব ও তার তরুণ অনুসারীরা একথা ভালোভাবেই জানতেন যে, ৬-দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান ফেডারেশন একটি অসম্ভব ও অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কোনোদিনই এটি মেনে নেবে না। ৬-দফাভিত্তিক ফেডারেশন মানেই শান্তিপূর্ণভাবে পাকিস্তানের বিভাজন ও এক-পাকিস্তানের মৃত্যু। ৬-দফার একটিও পাকিস্তানের ঐক্যের পক্ষে নয়। বরং প্রতিটি দফাই বাঙালির স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয়তা ও অবশ্যম্ভাবিতাকে তুলে ধরে। তাই পাকিস্তানিরা ৬-দফাকে বিচ্ছিন্নতার দলিল বললেও আমরা বলব ৬-দফা ছিল বাঙালির ম্যাগনাকার্টা ও স্বাধীনতা অর্জনের পথে এক প্রামাণ্য দলিল ও অনুঘটক।
লেখক: মন্ত্রী, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং ৭৫‘ পরবর্তী প্রতিরোধযোদ্ধা
সারাবাংলা/এসবিডিই
৬ দফা: বাঙালির ম্যাগনাকার্টা মত-দ্বিমত র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী