ঈদ কড়চা
১৬ জুন ২০২৪ ১৮:৩৪
ঈদ লইয়া বিশেষ কিছু লিখিবার নাই। তবে ইহা আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক ও ব্যাক্তি জীবনকে যারপরনাই আনন্দে উদ্বেলিত করিয়া থাকে। ইহার ধর্মীয় ও সামাজিক প্রেক্ষিত দুই হইলেও উদ্দেশ্য কিন্তু অভিন্ন। ছোটবেলা হইতেই দেখিয়া-শুনিয়া-বুঝিয়া আসিতেছি যে ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই বেশুমার খুশি। আমাদের জীবনে এইরূপ খুশীর ঝলক, আনন্দের লহর প্রতিবছর দুই বার আসে। আমরা অধীর আগ্রহে উহার জন্য অপেক্ষা করি, পরিকল্পিনা করি আর সেই দুই দিন আনন্দে মাতোয়ারা হইয়া যাই। ঈদের আনন্দ উদযাপন আর খুশি ভাগাভাগি করিয়া লইবার রীতিতে পরিবর্তন আসিলেও মূল নীতিতে রকমফের হয় নাই।
রমাযানের একমাস সিয়াম সাধনার পর যে ঈদ আসে উহাকে আমরা আদর করিয়া ছোট ঈদ বলিয়া চিহ্নিত করিয়া লইয়াছি। আর ইহার দুই মাস দশ দিন পর যে ঈদ আসে উহাকে বড় ঈদ বলিয়া সম্বোধন করিয়া থাকি। প্রকৃতপক্ষে এইরূপ নাম চিহ্নিত করণের কোন দলিল নাই। কেন ছোট আর কেনইবা বড় বলিয়া চিহ্নিত করিয়া থাকি উহার আনুষ্ঠানিক কোন ব্যাখ্যা কোথাও আছে কি-না জানিনা। তবে রমাযানের পর যে ঈদ উহাতে খরচাপাতি তুলনামূলক কম বিধায় উহাকে ছোট আর অপরটিতে কোরবানীর আবশ্যকতা থাকায় খরচের পরিমাণ বেশি হওয়ায় বড় নামে অভিহিত করিয়া থাকি। বলাবাহুল্য, উভয় ঈদের নামাযের নিয়ম ও পদ্ধতি একইরূপ।
ছোটবেলার ঈদ রঙ্গীন ছিলো। এরকম একটা নষ্টালজিয়া সর্বকালেই সবার মধ্যে কাজ করিয়া থাকে। যাহা কিছু পুরাতন তাহাই স্বর্ণসম মনে হইয়া থাকে। এজন্যই বলা হইয়া থাকে ‘ওল্ড ইজ গোল্ড’। ছোটদের কাছে ঈদ মানে সীমাহীন খুশির অজানা রাজ্য। কী থুইয়া কী করিলে খুশির ম্যাক্সিমাইজেশন হইবে উহা লইয়া ছোটদের কল্পনা, প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হইলেও দিনশেষে আশা না পুরিলো জাতীয় বেদনা থাকিয়াই যাইত। পক্ষান্তরে বড়দের কাছে ঈদ সমান্তরাল ভাবে আনন্দের ও কর্তব্যের। প্রজন্ম হইতে প্রজন্ম ধরিয়া এইরূপ ধারা চলিয়া আসিতেছে। বর্তমান আধুনিক, ডিজিটাল সমাজ ব্যাবস্থাপনায় ঈদের ক্ষেত্রেও আনন্দের পাশাপাশি নানারূপ উপসর্গকে সাথে লইয়া চলিতে হয়। সমাজের মানুষের রুচি-অভ্যাস-পছন্দ পরিবর্তনের সাথে সাথে ঈদের আঞ্জাম-আয়োজনেও নানা রঙ্গ যুক্ত হইয়াছে। বিশেষত কোরবানীর ঈদকে লইয়া এইরূপ ক্যারিকেচার বেশি হইয়া থাকে। আজ ইহারই কিছু লইয়া আলোচনা করিব।
ঈদের প্রথম কর্ম হইলো যার যার সাধ্যমত বাজার সদাই করা। ইহার ভিতরে নাইবা গেলাম। বাজারের যা অবস্থা তাহাতে সবাই লবেজান। রমাযানের ঈদে সালাত, যাকাত, ফিতরা ও আদর-আপ্যায়নের বাহিরে বাড়তি আনুষ্ঠানিকতা হইলো সেলামি ও দান-খয়রাত। ইহাতে বিশেষ কোন সমস্যা হয় না। তবে যত সমস্যা গিয়া পড়ে কোরবানির ঈদের উপর। কোরবানির জন্য হালাল উপার্জনের বিনিময়ে সাধ্যানুযায়ী নিখুঁত পশু ক্রয় একটি অন্যতম আবশ্যকীয় কাজ। ইহার মত জটিল ও দুরুহ কাজ আর দ্বিতীয়টি নাই। পশুর হাটের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখিলেই হাল ছাড়িয়া দিতে মন চায়। নানা রঙ্গের নানা সাইজের দেশি-বিদেশি পশুর বাম্পার স্টকের সহিত ইহার উচ্চমূল্য ক্রেতা হিসাবে বেশিরভাগ লোককেই হতাশাগ্রস্ত করিয়া তুলে। নগর জীবনে ইহা ক্রয়ের ঝক্কিও বিবিধ। ইহাকে দেখাশোনা করিবার ব্যবস্থা ও ইহার খায়-খাদ্যের সঠিক সময়ে সঠিকভাবে যোগান দেওয়াও খুব কষ্টকর। ইহার ব্যবস্থা করা গেলেও কসাইয়ের কাজ যাহারা করিবে তাহাদের সামলাইবার কঠিন দায়িত্ব মাথাব্যাথার অন্যতম কারণ হইয়া দাঁড়ায়। আগে হইতেই ইহাদের ঠিক করিয়া না রাখিলে ঈদের দিন চাকু হাতে ঘুরা শিক্ষানবিশ কসাইদের পাল্লায় পড়িলে নিজে কোরবানি হইয়া যাইবার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হইয়া যাইবে। বলাচলে সামাজিক চাপের শুরু গরু ক্রয় হইতেই আরম্ভ হইয়া থাকে। কাহার গরু, কি সাইজের, দেশি না বিদেশী, কোনটার দাম কত, ঠকা হইয়াছে নাকি জিতা হইয়াছে এই নিয়া পরস্পরের কথা চালাচালি চলিতেই থাকে। ইহার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় ঘরের লোকেরাও বিমর্ষ বা হর্ষোৎফুল্ল হইয়া উঠে। ত্যাগের মহিমা অনেকাংশেই ম্লান হইয়া “প্রদর্শন অহং” প্রস্ফুটিত হইয়া উঠে। সামাজিক স্ট্যাটাস বলিয়াও তো একটা কথা আছে!
কসাইরা মনুষ্য পদবাচ্যের হইলেও নামের কারণেই হোক বা ছোট বেলা হইতে অভিজ্ঞতা লব্ধ জ্ঞানের কারণেই হোক তাহাদেরকে খুব সুবিধার বলিয়া মানিয়া লইতে পারা যায় না। বাস্তবেও তাহাদের কর্মতৎপরতা তদ্রুপ। ইহাদের পাল্লায় জীবনে একাধিকবার পড়েন নাই এমন বাঙ্গালী মুসলমান খুব কমই পাওয়া যাইবে। একে তো তাহাদের সহিত মজুরির দফারফা করা দুরুহ ব্যাপার। কাজ শুরুর আগে যেমন তেমন কাজ চলাকালে ও শেষে তাহাদের আচার-আচরণ ও দাবী প্রেসার উঠিবার পক্ষে যথেষ্ট। কথার তুবড়িতে ইহারা এক গরু খাড়ার উপর দুম করিয়া নিমিষেই মাটিতে ফালাইয়া কাটিয়া-কুটিয়া ঘন্টা খানেকের মধ্যে উহার মাংস হাঁড়িতে চড়াইবার মত ব্যবস্থা করিয়া দিবে বলিয়া যতই বাগাড়ম্বর করুক বাস্তব চিত্র উহার বিপরীত। একমাত্র পেশাদার কসাই ছাড়া এইরূপ করিৎকর্মা পাওয়া দুষ্কর। পেশাদার কসাইয়ের খায়-খরচ অনেক। আর অপেশাদার অথচ অভিজ্ঞদের লইয়া কাজে কিছুটা হাল্কা বোধ হয়। তবে সেই ক্ষেত্রে অন্য যাতনা রহিয়াছে। ইহারা কর্মে শ্লথ আর হাতিয়ার চালনায় কিছুটা অদক্ষ হইয়া থাকে। এইগুলাকে উপেক্ষা করা গেলেও বিপত্তি বাধে উহাদের ব্যবহৃত অপর্যাপ্ত ছুরি, চাকু ও তাহার ভোঁতা দশা লইয়া। অথচ আগের দিন তাহারা বড় গলায় এই বিষয়ে নির্ভার থাকার অভয় দিয়া গিয়াছিল। আরো হতাশার বিষয় হইলো চুক্তিবদ্ধ চারজন কসাইকে গরু জবেহ করার সময় উপস্থিত পাওয়া গেলেও কিছু পরেই চোখের নিমিষে ইহাদের মধ্য হইতে দুই জন গায়েব হইয়া যায়। প্রশ্ন করিলে একবার জানা যায় তাহারা নাস্তা করিতে গিয়াছে। আরেকবার জবাব পাওয়া যায় ধারালো ও শক্তপোক্ত হাতিয়ার আনিতে গিয়াছে। আসলে তাহারা গিয়াছে আরেক গরু কাটাকাটি করিতে। উচ্চবাচ্য করিয়া লাভ নাই। বেশি চিল্লাচিল্লি করিলে একজন বিড়ি ফুঁকিতে ফুঁকিতে আসিয়া হাত লাগাইবে। আপনি মন্দের ভালো জ্ঞানে একটু অন্যমনস্ক হইয়াছেন। অমনি আরেকজন গায়েব হইয়া যাইবে। দিন শেষে যে লাউ সেই কদু। এই প্রকারের রাগারাগির মধ্যেই প্রায় মধ্যাহ্নের সময় মাংসের চালান লইয়া বাসায় ভাগাভাগির উদ্দেশ্যে ঝটপট বসিয়া পড়া ভিন্ন আর কোন জরুরি কাজ নাই। ইহার মধ্যেই বিভিন্ন প্রকার সামাজিক চাপ শুরু হইয়া যায়।
ঈদের দিনের চিত্র আপামর মানুষের প্রায় একই রকম হইয়া থাকে। গিন্নীর কাছে তাহার এক বান্ধবীর ফোন আসিলো। ইনাইয়া বিনাইয়া যাহা বলিলো তাহা দিয়াশলাই কাঠিতে অগ্নি সংযোগ করিবার মত। কুরবানির মাংস দিয়া তাহাদের দুপুরের খাবার শেষ। তাহারা এখন যাইতেছে পদ্মা সেতু দেখিতে। দূর সম্পর্কের শ্যালিকা ফোন করিয়া স্ত্রীর নিকট আলগা নছীহত করিলো যে, ফি বছর এত ঝক্কি না লইয়া পেশাদার কসাইয়ের হাতে ছাড়িয়া দিলেই তো ল্যাঠা চুকিয়া যায়। তাহাদেরও রান্না শেষ, খাওয়া শেষ। এখন বিকালে বাইরে ঘুরাঘুরির জন্য বিশ্রাম লইতেছে। হাজারে তিন শ’ টাকার বিনিময়ে এই আয়েস। গিন্নীও এইরূপ ফোনে বিরক্ত। এরি মধ্যে এক কলিগের ফোন আসিলো। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাহার কসাই না আসায় উপস্থিত শিক্ষানবিশ কসাই দিয়া কাজ করাইতে গিয়া সে বেজায় বিপদে পড়িয়াছে। ইহারা ছুরি, কাঁচি চালাইতে জানে না। চামড়া কাটিয়া কুটিয়া বিনাশ করিয়াছে। অনভ্যস্ত হাতে ভুরি গালাইয়া ফেলিয়াছে। অনেক কষ্ট করিয়া দুপুর একটা নাগাদ এক ঠ্যাং সাইজ করিয়াছে মাত্র। বাকিটা আল্লাহ মালুম।
এরিমধ্যে গিন্নী বাসায় তলব করিয়াছে। ফিরিয়া আসিয়া দেখি আমার কসাই গ্রুপের বয়োজ্যেষ্ঠ এক জন মুখে বিড়ি ঠেলিয়া স্লো মোশনে মাংস কাটিতেছে। বাকীরা কোথায়? ইহার সঠিক উত্তর পাওয়া গেল না। পরে জানা গেল, কাছের আরো তিন গরুর দায়িত্ব তাহারা লইয়াছে। একটিতে মালিক ও কসাইয়ের মধ্যে প্রায় হাতাহাতির অবস্থা হইয়াছে। তাই এখান হইতে তিনজন সেখানে গিয়া বাড়তি হাত লাগাইয়াছে। বিপত্তির এখানেই শেষ না। গিন্নী ফোনে জানাইলেন আমাদের এক আত্মীয় লোক মারফত তাহাদের কুরবানির মাংস সৌজন্য উপহার হিসাবে পাঠাইয়াছে। বিনিময়ে তাহাদেরকেও তো কিছু দিতে হয়। না হইলে মাংসের পোটলা লইয়া পরে অতদূরে কে যাইবে?
ইত্যকার নানারূপ ক্যারিক্যাচারে মূল পর্ব শেষ হইলেও ভাগাভাগি ও বিতরণ পর্বে হইলো আরেক ঝক্কির। নগর জীবনে বাড়তি সাহায্যকারী না থাকিলে এই যন্ত্রণার শেষ নাই। এত কিছু শেষে শরীর না চলিলেও কর্তব্যের শেষ নাই। ইহাতেই আনন্দ, ইহাতেই সুখ। এই এই করিয়াই জীবন চলিয়া যাইতেছে। বাপ-দাদাদেরও গিয়াছে। উত্তরাধিকারদের কীরূপে যাইবে বলিতে পারিতেছি না। এরি মধ্যে এক ব্যাচমেট ফোন করিলো। জানিতে পারিলাম ঈদের এই আনন্দঘন দিনে তাহারা সপরিবারে দুবাইয়ে ভ্রমণ করিতেছে। গাঁটের পয়সা থাকিলে অনেক কিছুই করিতে মনে চায়। ইহাতে ঝক্কি ঝামেলা নাই। উপরন্তু মৌজ-মাস্তি অফুরান। বিদেশী ফ্লেভার চমৎকার।
ঈদ আনন্দের আর ত্যাগের, সৌহার্দ্যের আর ভাতৃত্ববোধ সুদৃঢ় করণের। সর্বোপরি ইবাদতের। কুরবানির শিক্ষা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ইহার মাসলা, মাসায়েল, হাদীস-কোরআনের তাৎপর্য, ব্যাখ্যা, শানে নুযুল আমরা কেউই কম জানি না। অথচ আনন্দটুকু লইয়াই আমাদের যত আয়োজন। তাই কুরবানি সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে পালনীয় হইয়া উঠিয়াছে। ত্যাগের বিষয়টি আর দশ খাতে পয়সা খরচের মত হইয়া দাঁড়াইয়াছে। সৌহার্দ্য স্থাপন আর ভাতৃত্ববোধ দৃঢ়করণের বিষয়টি আমরা আর মামুদের মধ্যে ব্র্যাকেটাবদ্ধ করিয়া ফেলিয়াছি। ফেসবুক আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাহা দেখিতেছি উহা বাইরের দিক। ভিতরের কর্কটাক্রান্ত অবস্থা দেখিবার উপার নাই। সূর্যোদয় হইতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ভেজাল খাইয়া, ভেজাল দেখিয়া, ভেজাল দিয়া আমাদের হৃদয়-মন এন্টিবডি হইয়া গিয়াছে। হায়ার ডোজেও কাজ হইতেছে না। সবাই নিজেকে লইয়া ব্যস্ত। সময় কোথায় আর্ট ফিল্ম দেখিবার? এরিমধ্যে এক ক্ষমতাবানের দূর সম্পর্কীয় আত্মীয় ফোন করিয়া জানাইলো যে তাহার সেই আংগুল ফুলিয়া কলাগাছ হইয়া যাওয়া আত্মীয় কুরবানির একাধিক গরু কিনিবার জন্য হাঁটে গিয়াছিলো। কিনিয়া আসিবার সময় এক তাগড়া ষাড় পিছন দিক হইতে তাড়িয়া আসিয়া তাহার বাম পায়ে গুঁতা মারিয়াছে। ইহাতে তাহার হাড় ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। চিকিৎসার্থে তিনি এখন হাসপাতালের বেডে এক ঠ্যাং উঁচুতে বাঁধিয়া শুইয়া শুইয়া সরকারি সেমাই খাইতেছেন। যিনি ফোন করিয়াছেন তিনি যে ইহাতে বেজায় মজা পাইতেছেন তাহা বিলক্ষণ টের পাইলাম। হাসিতে হাসিতে আটখান হইয়া বলিলেন, “চিনিলো কেমনে”? ঈদ রঙ্গ বলিয়া কথা।
লেখক: অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা
সারাবাংলা/এসবিডিই