রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে
২৪ জুন ২০২৪ ১৫:৫৩
মিয়ানমার সৃষ্ট চলমান রোহিঙ্গা সংকট যতই দিন যাচ্ছে ততই বাংলাদেশের জন্য একটার পর একটা সমস্যা সৃষ্টি করে চলছে। ক্যাম্পের চলমান অপরাধ কার্যক্রম, মানব পাচার, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান, হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করাসহ নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের সামাজিক, পরিবেশ এবং নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করছে। এর সাথে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার প্রবনতা এবং এক শ্রেণির দেশের স্বার্থ বিরোধী, অসাধু মানুষের যোগসাজসে রোহিঙ্গারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভোটার তালিকায় যুক্ত হচ্ছে। তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশেও চলে যাচ্ছে যা আশঙ্কাজনক। কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর নিবন্ধিত রোহিঙ্গারা বিভিন্ন উপায়ে বাংলাদেশের ভোটার হচ্ছে এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পেয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সে জন্য নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষ থেকে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে বলা হলেও তা উপেক্ষা করে এই প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ইসি’ও এখন উদ্বিগ্ন। রোহিঙ্গারা চট্টগ্রাম অঞ্চল ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এই পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছে।
মিয়ানমারে অত্যাচারের শিকার এই রোহিঙ্গারা দীর্ঘ দিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে এবং তাদের দেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে তারা কোন আশার আলো দেখছে না বিধায় অনেকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থানীয়দের সাথে মিশে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য সুযোগ পেলেই বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে অন্য দেশে চলে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া বন্ধ করতে হলে স্থানীয় জনগণ এবং সমাজের সকল স্তরে দেশপ্রেম ও সচেতনতা বাড়ানো ছাড়া কোন বিকল্প নেই।
রোহিঙ্গাদের ভোটার হতে কেউ না কেউ সহযোগিতা করছে। কারণ, এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে জন্মসনদ ও চেয়ারম্যান-কাউন্সিলর কাছ থেকে নাগরিক সনদ নিতে হয়। তাদের কারা, কেন, কীভাবে জন্ম ও নাগরিক সনদ এবং এনআইডি কার্ড সরবরাহ করছে সেটা খুঁজে বের করতে তদন্ত করা জরুরি।
রোহিঙ্গাদের এনআইডি কার্ড সরবরাহ করছে সে বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে ইসি। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায়, এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি এবং কিছু প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধির যোগসাজশে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রোহিঙ্গারা ভোটার হচ্ছে। সিন্ডিকেটটি রোহিঙ্গাদের জন্য ভোটার হতে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরির ব্যবস্থা করে। ইসির পক্ষ থেকে চট্টগ্রামের বিশেষ ৩২ এলাকা ছাড়াও সারাদেশে রোহিঙ্গাদের ভোটার না করার ব্যাপারে কঠোর নজরদারির নির্দেশ দেয়া হয়। রোহিঙ্গারা নির্দেশনার বাইরের এলাকা থেকে বাংলাদেশি পরিচয়ে এখন ভোটার হচ্ছে, এতে তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের ভোটার করতে এক থেকে দেড় লাখ টাকার লেনদেন হচ্ছে বলে জানা যায়। রোহিঙ্গাদের এই অবৈধ সুযোগ দিয়ে সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতরা প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, যা উদ্বেগজনক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব ঘটনায় জড়িত অপরাধী ব্যক্তিদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসছে।
ভোটার তালিকা প্রথমবার হালনাগাদের সময় সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজেলার ৫০ হাজার রোহিঙ্গা ভোটার শনাক্ত হয়। উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের পর ৪২ হাজার রোহিঙ্গা ভোটারের নিবন্ধন বাতিল করা হয়। রোহিঙ্গারা যাতে ভোটার হতে না পারে সে বিষয়ে সতর্কতা জারির পাশাপাশি রোহিঙ্গা শনাক্ত করতে এখন দুটি ডাটাবেজ ব্যবহার করা হচ্ছে। যারাই নতুন ভোটার হচ্ছে তারা রোহিঙ্গা কি না তা শনাক্ত করতে ১১ লাখ ২২ হাজার নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের ডাটা চেক করে সেখানে রোহিঙ্গা হিসাবে নো ম্যাচিং আসার পর ইসির ডাটাবেজ চেক করে নো ম্যাচিং আসলেই নতুন ভোটার হিসাবে কেন্দ্রীয় সার্ভারে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।
২০২৩ সালের ২৭ আগস্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে জন্মনিবন্ধন, ভোটার আইডি ও পাসপোর্ট করতে সহযোগিতা করায় একটি মামলার চার্জশিট অনুমোদন দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। বাংলাদেশ সরকার, ‘জন্মসদন, এনআইডি ও পাসপোর্ট করতে রোহিঙ্গাদের যারা সহায়তা করছে তাদেরকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে এবং ইতোমধ্যে যারা এগুলো সংগ্রহ করেছে তা বাতিল করারও নির্দেশ দিয়েছে। রোহিঙ্গারা যেভাবে এই দেশের নাগরিক হয়ে যাচ্ছে তাতে স্থানীয়রা আতঙ্কিত। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশি পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করছে স্থানীয় কিছু মানুষ এবং রোহিঙ্গা দালালদের সিন্ডিকেট। এরা অর্থের বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরবরাহ করে। ওই সিন্ডিকেটের শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান নেটওয়ার্ক থাকায় পুলিশি যাচাই-বাছাইকরণসহ অন্যান্য প্রক্রিয়ায় এসব অনিয়ম শনাক্ত করা কঠিন।
১৯৭৫ সালের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নিতে রাজি হয়েছিল সৌদি সরকার। বাংলাদেশ থেকে বেশ কিছু রোহিঙ্গা তখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে সৌদি আরব যায়। বাংলাদেশের পাসপোর্টে সৌদি আরবে থাকা ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা তৈরি করেছে দেশটি। তাদের পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় সৌদি সরকার বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট নবায়ন করার জন্য জানায়। বাংলাদেশ সরকার সৌদি আরবে থাকা ওই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গার পাসপোর্ট নবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সারা দেশে কত রোহিঙ্গাকে ভোটার করা হয়েছে তদন্ত করে তার তালিকা দাখিলের নির্দেশ দিয়েছে হাইকোর্ট। ৮ আগস্টের মধ্যে এ তালিকা দাখিলের জন্য নির্বাচন কমিশন, স্থানীয় সরকার সচিব, কক্সবাজারের ডিসিসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান প্রক্রিয়ার সঙ্গে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের কয়েকজন জনপ্রতিনিধির সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়ার পর তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।
রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন নিশ্চিত করার পাশাপাশি নিয়মিত মনিটরিং এবং হালনাগাদ করা জরুরী। এটি একটি চলমান গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া এবং রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের পূর্ব পর্যন্ত এটা চালিয়ে যেতে হবে। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গারা মিশে গেলে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিবে এবং তা কখনো কাম্য নয়। স্থানীয় কর্মকর্তাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন এবং তাদের সংখ্যা হালনাগাদ রাখা তাদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার সুবিধার্থে প্রশাসন বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত করে। এই চলমান প্রক্রিয়া রোহিঙ্গাদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রথম পদক্ষেপ এবং এই রেজিস্ট্রেশন কার্ডের মাধ্যমে তাদের থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। বর্তমানে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে প্রতিদিন গড়ে ১০০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। ইউএনএইচসিআর-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দুই লাখের বেশি পরিবারের ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৩০৬ জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোতে বসবাস করছে। মাঠকর্মীরা নিয়মিত ক্যাম্পে গিয়ে রেকর্ড হালনাগাদ রাখেন এবং রোহিঙ্গা পরিবারগুলোও প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের পরিবারের সদস্য নিবন্ধন হালনাগাদ করে। বিশাল এই জনগোষ্ঠীকে সহায়তা দিতে ধারাবাহিক নিবন্ধন এবং তা হালনাগাদ করা অপরিহার্য।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব বিষয়ক অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনের সকল স্তরে এ বিষয়ে সচেতনতা ও জবাবদিহিতার ব্যবস্থা থাকলে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে থাকবে। রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের পাসপোর্ট তৈরিতে সহায়তাকারী সিন্ডিকেট চিহ্নিত করে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। হাইকোর্টের এই উদ্যোগে এই অনিয়মের সাথে জড়িতরা সতর্ক হবে। রোহিঙ্গাদের সাধারণ জনগণের সঙ্গে মিশে যাওয়ার ঝুঁকি এড়াতে একটা ডাটাবেজের মাধ্যমে হালনাগাদ নিশ্চিত করতে হবে। অনেক স্থানীয় ব্যক্তি রোহিঙ্গাদের চোরাচালানের কাজে ব্যবহার করছে। একাজে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। বাংলাদেশ সরকার তাদের আইনের আওতায় আনার উদ্যোগ নিচ্ছে। অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে বিলাসী জীবন যাপন করছে। তারা মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে না। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার জন্য প্রেষণা চলমান রাখতে হবে। জাতিসংঘ ও সাহায্য সংস্থাগুলোকে এ ব্যাপারে উদ্যোগী হতে হবে।
বাংলাদেশ একটা জনবহুল দেশ। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক বিবেচনায় বাংলাদেশ আশ্রয় দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল এই সংকট টেনে নেয়া সম্ভব না। রোহিঙ্গা সংকট দীর্ঘায়িত হওয়ার কারণে ও প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না হওয়ায় সৃষ্ট সমস্যা যেন বাংলাদেশের জন্য বোঝা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোহিঙ্গারা যাতে বাংলাদেশের জনস্রোতে মিশে যেতে না পারে সে বিষয়ে বাংলাদেশের নাগরিক, জনপ্রতিনিধি, বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারিকে একজন সচেতন দেশপ্রেমিকের দায়িত্ব পালন করতে হবে। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই এই সংকটের একমাত্র সমাধান বিধায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সবাইকে আন্তরিকতার সাথে দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য কার্যকরী ব্যবস্থা নিতে হবে।
লেখক: এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল এবং মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক
সারাবাংলা/এসবিডিই
ব্রি. জে. হাসান মো. শামসুদ্দীন (অব.) মত-দ্বিমত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব নেয়ার প্রবণতা বন্ধ করতে হবে