সেতুর চেয়েও বড় যে সেতু
২৫ জুন ২০২৪ ১৩:৩৬
স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের মর্যাদা নানা আঙ্গিক ও মাত্রিকতায় বিশ্লেষণ হচ্ছে। এই বিশ্লেষণে একটি দেশের ঘুরে দাঁড়ানো ও একটি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরিতে উন্নয়নচিন্তার ব্যাপ্তি ও সাহসী কর্মযোগ মূল অনুষঙ্গের ভূমিকা রাখছে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আঁতুড়ঘর থেকে প্রদত্ত উপজীব্যতা স্বাক্ষ্য দেয়, পরাজিত মনস্কাম বাংলাদেশের মানুষের আচরণ বর্হিভূত, স্বভাববিরুদ্ধ। শত প্রতিকূলতার গন্ডি পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দুর্বার মনোকাঙ্খা বাংলাদেশকে এগিয়ে রেখেছে, রাখছে এবং ভবিষ্যতে এ যাত্রায় আরও বহুল প্রত্যাশিত অর্জন সংযুক্ত হবে। অবস্থান দৃঢ় হচ্ছে, হবে বাংলাদেশের এবং বৈশ্বিক পরিমন্ডলে বহুল চর্চিত ‘বাংলাদেশ পেরেছে’। বিদেশ নির্ভরতা একপাশে রেখে কিংবা উন্নয়ন বা দাতা সংস্থার কৌশলি আলাপন পরিহার করে নিজস্ব অর্থায়নে বাংলােদেশের গৌরবের উপজীব্য ‘পদ্মা সেতু’ বাংলাদেশকে সে বিরল উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণের সাথে জড়িত গল্পগুলো সুখকর নয়। সকল ষড়যন্ত্রের যন্ত্রকে বিকল করে দিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়চেতা মনোভাব ও মানুষের প্রতি আস্থার মমত্বমাখা বিশ্বাসী দৃষ্টিতে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর থেকে পরিপূর্ণ অবয়ব শেষ হয়েছে নিবিড় পর্যবেক্ষণ, পেশাগত দক্ষতা ও উন্নয়ন কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তির নিজস্বতা হিসেবে। ২৫ জুন, ২০২২ রচিত হয়েছে নতুন ইতিহাস, পরিচয়, সংযোগ, উন্নয়ন, এবং সমৃদ্ধির নতুন ফলক। যেখানে আনন্দাশ্রু জড়ো হয়েছিল এসে, পরিশ্রম-সংগ্রামের সংযুক্ত মিশ্রণে আমাদের পরিচয়ের বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নতুন মাত্রা পেয়েছিল। এ আনন্দ, এ জয়ের আদর্শিক মনোগাঁথা আজও অসীম।
নিকটবর্তী দেশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বাংলাদেশের এ অর্জনে ইতিবাচক দৃষ্টি প্রকাশ করেছিল এবং অভিনন্দন জানিয়েছিল। উন্নয়নের মহাযজ্ঞে নতুন উদ্ভাবিত প্রক্রিয়ায় উন্নয়ন কৌশলের নতুন গৃহিত প্রতিপাদ্য ছিল-দেশীয় অবস্থান, সম্পদ ও জন-অংশিদারিত্বের ভিত্তিতে উন্নয়ন সফলতার গল্প নির্মাণ করা এবং জনগণের প্রতি প্রদত্ত অঙ্গীকার পালনে দেশীয় উপকরণের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা। যা পদ্মা সেতু নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুসৃত। নিজস্বতায় নিজস্ব ভবিষ্যত নির্মাণ। উন্নয়নের এরূপ দার্শনিক ভিত্তির উজ্জ্বল উদাহরণ বাংলাদেশ অনুশীলন করতে পেরেছে। পরিচয়ে লেগেছে নতুনত্ব, পতাকার শক্তি বেড়েছে আরও বহুগুণ।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১টি জেলার মানুষের জন্য মুক্তির পায়রা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, পর্যটন, যোগাযোগসহ জীবনের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে উন্নয়ন অনুকূল ভূমিকা রেখে চলছে পদ্মা সেতু। দক্ষিণাঞ্চলের ৩ কোটি মানুষের জীবনে অভূতপূর্ব উন্নয়নের অন্যতম নিয়ামক এখন পদ্মা সেতু। আর্থিক অসংগতি ও বৈষম্যের কারণে পিছিয়ে থাকা দক্ষিণাঞ্চলের জনগোষ্ঠী সামাজিক স্তরবিন্যাসে নতুন স্থান করে নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে এই একটি সেতুর জন্যেই। শিক্ষা, চিকিৎসা, কর্মসংস্থান, সম্পর্ক, আন্তঃমেলবন্ধন, ও প্রকৃতিলব্ধ পরিবেশে জীবনাচরণ নতুন মেরুকরণে উদ্ভাসিত হচ্ছে- হবেও। প্রকৃতির কোল ঘেঁষে সৃষ্টি হচ্ছে জীবনগাঁথা যা অর্থনীতির সবুজ শিল্পায়ন।
গত দুই বছরে পদ্মা সেতু নিয়ে সামগ্রিক বিচার-বিশ্লেষণে নানারূপ সংযোজন উন্মোচিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের হাত ধরে এ অর্জন বাংলাদেশের। বাংলাদেশের উন্নয়ন কাঠামোতে পদ্মা সেতুর প্রভাব মোটাদাগে তিন শ্রেণিকরণে বিন্যস্ত করা যেতে পারে-
প্রথমত, সময়ের চলতি ব্যাপ্তিতে মানুষের উন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্যতম শর্ত হলো মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ। বিশেষ করে জীবনব্যবস্থার সাথে পরিচয়। জীবনব্যবস্থা আবর্তিত হয়- শিক্ষা, কর্মপ্রবাহ, সম্পর্ক, খাদ্যাভ্যাস, সাংস্কৃতিক উপকরণ, পোশাক শিষ্টাচার, ধর্মীয় অনুভূতি, সামাজিক বিশ্বাস ও লোকগাঁথার মতো বিষয়গুলোর সক্রিয় অনুশীলনের মাধ্যমে। পদ্মা সেতু একই দেশের মানুষকে নতুন করে পরিচিত করছে। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, ও দক্ষিণ- এই অঞ্চলের মানুষগুলোর মধ্যে তৈরি হয়েছে বন্ধুত্বের প্রগাঢ় আহবান ও নৈকট্য লাভের অফুরন্ত সুযোগ। যা শ্রেণীবিদ্রোহ ও বিদ্বেষ পরিহার করে সৃষ্টি করছে আস্থার নির্ভরশীলতা। যেখানে উন্নয়নে অংশীজনের সম্ভাবনা বাড়ন্ত বৃক্ষের মতো আগলে রাখছে এবং নিশ্চিত করছে সামাজিক প্রবৃদ্ধি।
দ্বিতীয়ত, ঈদ কিংবা অন্য উৎসবে গ্রামে ফিরতে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ এবং ফেরি সমাচার থেকে এক স্বস্তির মুক্তি মিলেছে। পদ্মার পাড় থেকে কুয়াকাটার সমুদ্র সৈকত পর্যন্ত টানা ২৪০ কিলোমিটার সড়ক থেকে ফেরি দূর হয়ে গেছে। আনন্দে বাড়ি ফেরা অর্থাৎ প্রান্তের সাথে যোগাযোগ, জন্মস্থানের সাথে জীবনের ক্রমাগত সাক্ষাৎ বাড়ছে। গ্রামীণ অর্থনীতি ও উন্নয়ন তরান্বিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় অর্থনীতিতে পদ্মা সেতু ২ শতাংশের বেশি অবদান রাখার পরিবেশ নিশ্চিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। আজকে দারিদ্রের কষাঘাতে যে মানুষটি কর্মহীন কিংবা কাজ করার মত কোনো কিছুর সন্ধান পাচ্ছেন না, তিনিও স্বপ্ন দেখছেন উৎপাদনের কিংবা কর্ম সম্ভাবনার। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন অর্থনেতিক জোন। রাস্তাঘাট, সেতু, সমুদ্রবন্দর। আর্থিক প্রবৃদ্ধি মানুষের অন্যান্য প্রবৃদ্ধিকে করছে গতিশীল।
তৃতীয়ত, উন্নয়নের অগ্রগামী পরিকল্পনায় বিদেশনির্ভরতা কিংবা দাতাসংস্থার প্রস্তাবনার পরিবর্তে নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতায় উন্নয়ন প্রকল্প সম্পন্ন করে জাতি হিসেবে সম্মান ও মর্যাদা যেমন বেড়েছে তেমনি নাগরিকের মনস্তত্বে দায়বোধের এক তাড়না তৈরি হয়েছে। সেখান থেকে উন্নয়নে অংশগ্রহণ, অবদান রাখা এবং উন্নয়নকৃত স্থাপনার সংরক্ষণে নিজস্ব তাগিদ মনোজগতে আপনাআপনিই তৈরি হয়েছে। পদ্মা সেতু এদেশের মানুষকে নতুন করে নাড়া দিয়েছে, এবং নিয়ত ভাবাচ্ছে ‘আমরাও পারি’। এ পারির যাত্রা শুরুতে রয়েছে, সমাপ্তির সীমারেখা অসীম ও অনন্ত। সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন ভাষা যেখানে শরীর ও মন বলছে, ‘এ সময় আমাদের, এ মুহুর্ত বাংলাদেশের’।
লেখক: কবি ও শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
সারাবাংলা/এসবিডিই