সুইস ব্যাংক এখন আর পছন্দের গন্তব্য নয়
৫ জুলাই ২০২৪ ১৭:১২
গোপনে অর্থ গচ্ছিত রাখার জন্য বহুদিনের খ্যাতি সুইজারল্যান্ডের। কঠোরভাবে গ্রাহকদের নাম-পরিচয় গোপন রাখে সুইস ব্যাংকগুলো। যে কারণে প্রচলিত বিশ্বাস, অবৈধ আয়, আয়কর ফাঁকি দিয়ে জমানো টাকা জমা রাখা হয় সুইস ব্যাংকে।
১৯৩৪ সালের সুইস ব্যাংকিং অ্যাক্ট অনুযায়ী সুইস ব্যাংকগুলির জন্য কোন অ্যাকাউন্টধারীর নাম প্রকাশ করা যাবে না। ডাক্তার এবং রোগী বা আইনজীবী এবং তাদের ক্লায়েন্টদের মধ্যে গোপণীয়তা সুরক্ষার মতো এই সুরক্ষাগুলো হল প্রাথমিক কারণ, যে সুইস ব্যাংক হিসাবগুলো বিশ্বজুড়ে ধনী ব্যাংকিং গ্রাহকদের কাছে এত জনপ্রিয়।
অর্থপাচার ও মানি লন্ডারিং শুধু বাংলাদেশ নয়, এটি বিশ্বব্যাপী সমস্যা। এখন এটি বিশ্বব্যাপী হুুমকি হয়ে উঠছে। জাতিসংঘের মাদকদ্রব্য ও অপরাধ সংক্রান্ত কার্যালয় (ইউএনওডিসি) অনুসারে, প্রতিবছর বিশ্বে পাঁচার হচ্ছে ৭৫ হাজার ৪৭২ কোটি ডলার। এটি প্রতিবছর বৈশ্বিক জিডিপির ২ শতাংশ থেকে ৫ শতাংশের সমান। পাশাপাশি ডিজিটাল লেনদেনের কারণেও বেড়েছে অর্থ পাচারের ঘটনা।
সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্টের কিছু সুবিধা হল নি¤œস্তরের আর্থিক ঝুঁকি এবং উচ্চস্তরের গোপনীয়তা। সুইস অর্থনীতি খুবই স্থিতিশীল বলে জানা গেছে এবং দেশটি কিছু সময়ের জন্য কোন বড় সংঘাতের অংশ ছিল না। তদুপরি সুইস ব্যাংকগুলির উচ্চ মূলধনের প্রয়োজনীয়তা এবং শক্তিশালী আমানতকারী সুরক্ষা রয়েছে, যা আমানতকে আর্থিক সংকট এবং দ্বন্দ্ব থেকে রক্ষা করে। সুইস ফ্রাঙ্কে রাখা অ্যাকাউন্টগুলি অল্প পরিমাণে সুদ পাবে, কিন্তু তাদের সুইস উইথহোল্ডিং ট্যাক্সও দিতে হবে। এই কারণে বেশিরভাগ বিদেশী অ্যাকাউন্টধারীদের অন্যমুদ্রায় তাদের সুইস ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। উল্লেখ্য যে, ২০০৬ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। কীভাবে এই বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হয়েছে এর কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই। তবে গ্লোবাল ফিক্সড ইনকাম রিয়েলাইজেশন (জিএফআইআর) এর মতে বিদেশ থেকে পণ্য আমদানি মূল্য কম দেখানো, হুন্ডি ও ভিওআইপি ব্যবসার মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হচ্ছে। টাকা পাচারে বিশ্বের ৩০ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। সংস্থাটির কাছে তথ্য রয়েছে, বাংলাদেশের মোট বাণিজ্যের প্রায় ২০ শতাংশই নানা পন্থায় পাচার হয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা বেড়েই চলছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পাচারের ঘটনা বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। মূলত ব্যাংক লেনদেন, হুুন্ডি ও মোবাইল ব্যাংক এবং গেমিং বেটিংয়ের মাধ্যমেই এসব ঘটনা ঘটছে। অর্থ পাচার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য মোতাবেক, সুইস ব্যাংকের বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শাখা আছে। ফলে যে কোনো দেশে সুইস ব্যাংকের শাখায় বাংলাদেশী কোনো ব্যক্তি অ্যাকাউন্টে টাকা জমা করলে সেটা কেন্দ্রীয়ভাবে সুইস ব্যাংকের হিসাবে গণনায় আসে। কোনো বাংলাদেশী সুইস ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সেটি তাদের এসেটে দেখাবে। রপ্তানি সময় হিসাব নিস্পত্তি না হলে সেগুলো সুইস ব্যাংকের নষ্ট অ্যাকাউন্টে দেখানো হয়। তবে সুইস ব্যাংকের কাছে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কোন তথ্য দেয় না।
সুইস আইন বলে যে, আমানতকারীর অনুমতি ব্যতীত ব্যাংক কোনও অ্যাকাউন্ট (এমনকি তার অস্তিত্ব) সম্পর্কিত কোনও তথ্য প্রকাশ করতে পারে না। তথ্য প্রকাশের একমাত্র উপায় হল যদি কোনো সরকারি সংস্থা বলে যে, একজন আমানতকারী কোনো অপরাধমূলক কাজ বা অন্য কোনো আর্থিক সমস্যায় (যেমন, দেউলিয়া হওয়া বিবাহ বিচ্ছেদ বা উত্তরাধিকার) জড়িত। তদুপরি সুইস অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং প্রবিধানগুলি আমানতকারীদের তাদের অ্যাকাউন্টে যে তহবিল রাখছে তার উৎস সম্পর্কে প্রমাণ সরবরাহ করতে হবে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা আবার আলোচনায়। নির্দিষ্ট গ্রাহকের তথ্য না দিলেও এক দশক ধরে বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক। তাতেই উঠে এসেছে এসব তথ্য। তবে প্রায় এক দশক ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশীদের আমানত বৃদ্ধির হার হুুট করে তা কমছে কেন, এর ব্যাখ্যা নেই ওই প্রতিবেদনে।
সুইস ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২০ সালে বাংলাদেশের আমানতকারীদের টাকার অঙ্ক ৫৬ কোটি ২৯ লাখ থেকে লাফ দিয়ে ২০২১ সালে ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁতে দাঁড়ায়। এতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় শীর্ষ আমানতকারী দেশ হিসাবে স্বীকৃতি পায় বাংলাদেশ। এরপর ২০২২ সালে অস্বাভাবিক গতিতে কমে আমানত দাঁড়ায় ৫ কোটি ৫২ লাখ ফ্রাঁতে। আর ২০২৩ সালে নেমে আসে ১ কোটি ৭৭ লাখে। প্রতি সুইস ফ্রাঁ ১৩২ টাকা করে ধরলে দেশী মুদ্রায় এর পরিমাণ দাঁড়ায় ২৩৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ ২০২৩ সালে সুইস ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশীদের অ্যাকাউন্টে প্রায় ৬৫ শতাংশ অর্থ কমেছে। অবাক করার মতো বিষয় হলো যে ২০২১ সাল ও ২০২২ সালে এই দুই বছরে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের আমানত কমেছে প্রায় সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা।
প্রশ্ন হচ্ছে, শীর্ষ আমানতকারী দেশের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত দেশটির আমানত কী এমন কারণে শ্লথ হয়ে গেল পরবর্তী বছরই? ধারণা করা হচ্ছে, সুইজারল্যান্ডে গোপনীয়তা কমতে থাকায় বাংলাদেশীসহ অনেক দেশের ধনীরাই এখন অবৈধ টাকা জমা রাখার জন্য ট্যাক্স হেভেন দেশগুলোর দিকে ঝুঁকছেন।
এটা ঠিক যে, অর্থ পাচারকারীদের কয়েকটি কারণে সুইস ব্যাংকের আকর্ষণ কমছে। প্রথমত আন্তর্জাতিক চাপে সুইস ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পৃথিবীর দেশভিত্তিক আমানতের হিসাব প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে যারা সত্যিকার অর্থে পাচারকৃত টাকার তথ্য গোপন রাখতে চায় তারা এখন আর সুইস ব্যাংককে প্রাধান্য দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, সুইস ব্যাংকের প্রতিবেশী দেশগুলো আরও বেশি সুযোগ সুবিধা দিচ্ছে পাচারের অর্থ নেওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে পাচারকৃত অর্থ যে দেশে ব্যবসা বাণিজ্য গড়ে তোলা ও সম্পদের মালিকানা অর্জনের সুবিধা আছে সেখানে চলে যাচ্ছে।
সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক ২০ জুন ২০২৪ প্রকাশিত রিপোর্টে দেখা যায়, দ্বিতীয়বারের মতো সুদের হার কমিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির চাপ কমানোর লক্ষ্যে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার নীতিগত হার ২৫ বেসিস পয়েন্ট কমিয়ে ১ দশমিক ২৫ শতাংশ কার্যকর করেছে।
অর্থনীতিবিদ ও অর্থ পাচার সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তথ্য প্রযুক্তির সুবাদে বিকল্প গন্তব্যে পাড়ি দিচ্ছে পাচারের অর্থ। যেখানে শুধু ব্যাংকে টাকা রাখাই নয়, সংশ্লিষ্ট দেশের পাসপোর্ট প্রাপ্তি, সম্পদের (বাড়ি-ঘর) মালিকানা অর্জন এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় সুবিধা ফেলে রাখছে না। এসব অর্থের বিনিময়ে গড়ে তুলছে বিনিয়োগের সা¤্রাজ্য। এসব দেশের মধ্যে ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, কেমান আইল্যান্ড, বারমুডা, দুবাই, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের মতো উন্নত দেশগুলোতে নিয়ে যাচ্ছেন।
বর্তমানে সবচেয়ে কাছের গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশীদের পছন্দের শীর্ষে আছে দুবাই ও সিঙ্গাপুর। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডের রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ে অর্থপাচার এবং বিনিয়োগ করা হয়। তবে সুইস ব্যাংকে বিদেশী গ্রাহকদের অর্থ জমার তালিকায় শীর্ষে রয়েছে যুক্তরাজ্য। সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে ব্রিটিশ নাগরিকদের ২৫৪ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ রয়েছে। এরপরই ৭১ বিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ নিয়ে তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আর ফ্রান্স রয়েছে এই তালিকায় তৃতীয় স্থানে। সুইস ব্যাংকে দেশটির নাগরিকদের প্রায় ৬৪ বিলিয়ন ফ্রাঁ রয়েছে। ওই তিন দেশের পর শীর্ষ দশ দেশের তালিকায় আছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, জার্মানি , হংকং, সিঙ্গাপুর, লুক্সেমবার্গ এবং গার্নসি।
বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যে অর্থ পাচার হয় তা দেশে থাকলে প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হতো। দারিদ্র্যের হার শূন্যে নেমে আসত। তাই পাচার বন্ধে বা প্রতিরোধ করতে কঠোর নীতিমালা প্রনয়ণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বন্ধ করতে হবে দেশে অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের পথ।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক
সারাবাংলা/এজেডএস