মহামান্য রাষ্ট্র, কান পেতে শুনুন
২ জুন ২০১৮ ১৩:০০
প্রিয় রাষ্ট্র,
‘বাবা শব্দটা আমার কাছে খুব স্পর্শকাতর। যেকোন বাচ্চার কাছেই তাই। আমি সিঙ্গেল মাদার ফ্যামিলির মেয়ে বলে আদিখ্যেতা একটু বেশি।
আজ একরামুলের অডিও শুনে আমি অঝোরে কাঁদছিলাম। “তুমি কাঁদতেছ কেন আব্বু?” এই কথাটা শুনে কান্নার বেগ প্রবল হলো। আমি স্পর্শ করতে পারছিলাম একজন মেয়ের উৎকণ্ঠা আর পিতৃত্বের হাহাকার। একরামুল জানতেন আর কখনো তিনি ফিরতে পারবেন না কন্যাদের কাছে। একরামুল জানতেন তার মেয়েগুলো কিছুক্ষণ পরে পিতাহারা হতে যাচ্ছে। একরামুলের স্ত্রী জানতেন আর কখনোই তিনি তার বরের সাথে কথা বলতে পারবেন না এজন্যেই বলছিলেন “আল্লাহ আরি একবার কথা কইতে দাও খোদা…” “কিন্তু ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে ঐ ভদ্রপল্লীতে, এখানে তাহাঁকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।” যায় নি তো শেষ পর্যন্ত। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ইয়াবা-ঈশ্বর এখন সৌদিতে। তাই অহেতুক আর্তনাদ ভারী করে তোলে মোবাইলের এ পাশকে। লোড করা পিস্তলের গুলির পরে “আমার জামাই কিছু করে নাই যে, কমিশনার কিছু করে নাই যে, আপনারা উনাকে কেন মারতেছেন … ” – ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আমরা আরেকবার মারা পড়ি আমাদের অসহায়ত্ব নিয়ে।
সুপ্রিয় রাষ্ট্র, যতটা আল্লাদ নিয়ে নেতা ঘোষণা করেন, “যদি নিরীহ কেউ মারা যায় তাহলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।” সেই ব্যবস্থাটুকু একটু আগে নেয়া হলে পিতাহারা হতে হত না মেয়েদুটোকে। আর্তনাদে আর্তনাদে ভারী হত না চারপাশ। ও পাশে পিতা করুণ মৃত্যুযন্ত্রণা আর এপাশে মায়ের কান্নায় এতো স্বাভাবিক মৃত্যু মেনে নেয়াটাও সম্ভব হত না হয়তো!
মহামান্য রাষ্ট্র, যাদের ট্যাক্সের টাকায় চলেন আপনি নিজে, সেই মানুষগুলোকে ওদেরই ট্যাক্সের টাকায় কেনা গুলি দিয়ে বিনীত মেরে ফেলা হচ্ছে। আপনি মহামান্য, আপনাকে অমান্য করার স্পর্ধা দেখানোর সাথে সাথে আমার জন্যেও বরাদ্দ হয়ে যেতে পারে একটা গুলি, যার খোলস আপনার লোকজন খুঁজতে পারে মৃত্যু নিশ্চিত করার পরে। ঠাণ্ডা মাথার খুনের প্রমাণ তো রাখা যাবে না। লাশের মাথার কাছে বরঞ্চ ফেলে রাখা হতে পারে কয়েক হাজার ইয়াবার প্যাকেট, গুলি ভর্তি আগ্নেয়াস্ত্র রাখা হতে পারে পকেটে। যাতে স্পষ্ট বলা যায় “বন্দুক যুদ্ধে নিহত”।
মাননীয় রাষ্ট্র, এই রাষ্ট্র যন্ত্রটিকে সচল রাখার জন্যে যদি একজন ইয়াবার ঈশ্বর দরকার হয়, তার ইয়াবা কেনার জন্যে দরকার কয়েক হাজার ক্রেতা আর তাদের পকেটের টাকা। এই টাকাটা টুপ করে নিজ পকেটে পুরে আপনি আমাদের নিরীহ লাশ উপহার দিতেই পারেন। লাশটা যে পাচ্ছি সেটাও ভাগ্যি! চাইলেই গুম করে ফেলতে পারতেন আপনি। সে ক্ষমতা আপনার আছে জানি।
নির্বিকার রাষ্ট্র, যতটা নির্বিকার থাকলে আপনাকে নাড়ানো না যায় তার চাইতেও নির্বিকার হয়ে যাই গুলির শব্দগুলো শুনে। “আমার জামাই বিনা দোষী, আপনেরা উনাকে কেন মারতেছেন?….” “আব্বু…” শুনে আমরা বরফ শীতল হয়ে যাই। আমাদের দুর্বিনীত ক্রোধের রঙ ফিকে হয়ে আসে। আমরা টের পাই বুকের কাছে নিজের শিশুকে চেপে ধরে আদর করে ভাবছি এটাই বুঝি শেষ আদর।
“আব্বু…” বলে মেয়ের ওরকম ডাকছাড়া চিৎকার শুনেও যে আব্বু আসে না। “আমি (মিটিং থেকে) চইলা আসব আম্মা” বলে পিতার লাশ আসে। আমরা ততোধিক নির্বিকার হয়ে জানতে পারি লাশেরাও এখন মিটিং করে!
বেশি ভাববেন না, রাষ্ট্র। সাফ বলে দিন এগুলো সব বিচ্ছিন্ন ঘটনা। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় আমাদের এসব মেনে নিতে হবে।
শুধু রোজকার মিটিং-এ দেখা হলেই কানের কাছে ফিসফিসিয়ে প্রিয় নেতাকে বলে দেবেন – “প্রকৃতি সর্বোৎকৃষ্ট দর্পণ”।
[এই কলামে তুলে ধরা সকল মত লেখকের নিজের]
সারাবাংলা/এমএম