আদর্শের ছায়ায় পুনর্জন্ম
১৩ আগস্ট ২০২৪ ১৬:২৭
আওয়ামী লীগ পুনরায় ফিরে আসবে, এটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের আশাবাদ। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আওয়ামী লীগ আসলে কোথায় গেছে? দল হিসেবে তো আওয়ামী লীগ পালায়নি, তাহলে কেন এই ফিরে আসার কথা উঠছে? এর অর্থ এই যে, আওয়ামী লীগ একটি ব্যক্তি-নির্ভর দল, যেখানে আদর্শের কোনো বালাই নেই। একজন ব্যক্তির জন্য কোনো আদর্শের মৃত্যু হতে পারে না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, ব্যক্তিপূজার কারণে আওয়ামী লীগ তার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়েছিল? ব্যক্তির প্রস্থানে আদর্শকে পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব নয়। তাই ফিরে আসার জন্য এত হাপিত্যেশের প্রয়োজন নেই; বরং দলের আদর্শকে আকড়ে ধরলেই দল স্বাভাবিকভাবেই জনগণের সমর্থন পাবে।
আওয়ামী লীগের আদর্শ অন্যান্য দলের চেয়ে কিছুটা ব্যতিক্রমী। সেই আদর্শের ওপর ভিত্তি করে তারা যদি জনগণের কাছে যায়, তাহলে জনগণ তাদের বিমুখ করবে না। কারণ, অন্যান্য দলগুলোর মধ্যে অনেকেই আওয়ামী লীগের আদর্শকে নিজেদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। যখন মানুষ আসল আদর্শের সন্ধান পায়, তখন তারা নকল আদর্শের পেছনে ছুটবে কেন? অতীতে আওয়ামী লীগ আদর্শের পেছনে ছিল এবং সে কারণেই জনগণ তাদের সমর্থন করেছিল। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তিপূজা ও ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ দলের সেই শক্তিশালী আদর্শকে দুর্বল করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগে আদর্শ ছিল এবং আছে। দলটি জনগণের কল্যাণে কাজ করেছে এবং সেই কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ জনগণ তাদের ক্ষমতায় এনেছে। তবে ব্যক্তিপূজার কারণে তারা আদর্শকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। যখন সব ক্ষমতা একটি ব্যক্তির মধ্যে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন সেই দলটির পরিণতি হয় যা, আওয়ামী লীগের তা হয়েছে। দলের এই বেহাল দশা সেই সত্যের সাক্ষ্য দেয়। আওয়ামী লীগ এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে তাদের প্রত্যেক নেতা ও কর্মী এই অবস্থার জন্য দায়ী। তারা কেউই এই করুণ পরিণতির দায় এড়াতে পারে না।
নিজেদের গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দাবি করলেই কেউ গণতান্ত্রিক হয়ে যায় না। আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মী তাদের মূর্খতার পরিচয় দিয়েছে, যখন তারা নেত্রীর একগুঁয়েমি, জেদ, এবং অহংকার দেখেও চুপ ছিল। একটি দলের নেতারা যদি নিজেদের আদর্শের চেয়ে ব্যক্তিকে বেশি প্রাধান্য দেয়, তাহলে সেই দল ধ্বংসের পথে যায়। ঈশ্বরেরও সীমাবদ্ধতা থাকে, কিন্তু আওয়ামী লীগের দলীয় প্রধান এমন ক্ষমতার চর্চা করেছেন, যা তাকে ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী করে তুলেছিল। তার পতন ছিল অনিবার্য, কারণ তিনি নিজেকে ঈশ্বরের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগের জন্য এখন সবচেয়ে ভালো হবে যদি তারা শেখ হাসিনার পতনের জন্য আর আফসোস না করে, বরং তাকে বিদায় জানিয়ে নতুনভাবে শুরু করে। শেখ হাসিনা যদি ফিরে আসেন, তাহলে তা দলের জন্য শোভন হবে না। একজন পতিত স্বৈরাচারী আবার নেতৃত্বে ফিরে আসলে সেই দলের প্রতি জনগণের আস্থা আর থাকে না। শেখ হাসিনার ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গেছে; মানুষ তাকে স্মরণ করবে পতিত এরশাদ বা খালেদার মতো স্বৈরাচারী নেত্রী হিসেবে। এই বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে দলকে নতুন করে সাজাতে হবে।
শেখ হাসিনার প্রস্থান যদি আওয়ামী লীগেরও প্রস্থান হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে ধরে নিতে হবে আওয়ামী লীগ কখনোই প্রকৃত অর্থে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এই প্রেক্ষাপটে, আওয়ামী লীগের সামনে একটি বিরাট সুযোগ এসেছে; তারা পরিবারতন্ত্রের বিপরীতে সম্পূর্ণ নতুন কিছু করে দেখাতে পারে। দল কোনো ব্যক্তির জমিদারি নয়; উত্তরাধিকার সূত্রে ক্ষমতা বিতরণ করা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। শেখ হাসিনার পর তার পুত্র জয়ের নেতৃত্ব গ্রহণের তোড়জোড় দেখে মনে হচ্ছে, সেও তার মায়ের মতো মূর্খ। এক মূর্খের পরিবর্তে অন্য মূর্খ দলের দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারে না।
জয়কে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আনার অর্থই হবে দলের আত্মহত্যা করা। নেতৃত্বহীন দলে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি হয়, কিন্তু সেই শূন্যতা পূরণে শুধু পরিবারের দিকে তাকালে হয় না। বাইরের যোগ্য ব্যক্তিদেরও সুযোগ দিতে হয়, তবেই দল গণতান্ত্রিক হবে। জয় যদি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আসে, তবে তা হবে পুরো দলের অস্তিত্বের জন্য হুমকি। আওয়ামী লীগের উচিত হবে স্বৈরাচারের সাথে সব রকমের সম্পর্ক অস্বীকার করা। শেখ হাসিনা অতীত; আওয়ামী লীগকে ভবিষ্যতের খুঁজে এখনই পরিশুদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আওয়ামী লীগ যদি সত্যিই টিকে থাকতে চায়, তবে পরিবারতন্ত্র থেকে বেরিয়ে এসে নতুন নেতৃত্ব খুঁজে বের করতে হবে, যারা দলের আদর্শকে পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে। অন্যথায়, আওয়ামী লীগ সত্যিই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। দলের সামনে থাকা এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে তারা আবার জনগণের আস্থা অর্জন করতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলি,কি ভাবে আদর্শ ধরে রখতে হয় তার প্রমাণ কাদের সিদ্দিকী। যিনি ভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা। বহুবার শেখ হাসিনার সমালোচনার শিকার হয়েছেন। যদিও তিনি সবসময় শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন, শেখ হাসিনা প্রতিটি সুযোগে তাকে অপমান করার চেষ্টা করেছেন। এই পরিস্থিতির জন্য আমি নিজেও কাদের সিদ্দিকীকে অনেকবার কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেছি। তার শেখ হাসিনার প্রতি সদিচ্ছা এবং আদর্শিক পরামর্শগুলো তখন আমার কাছে রাজনৈতিক ভুল মনে হয়েছিল।
তবে, সময়ের সাথে সাথে আমি উপলব্ধি করেছি যে, প্রকৃত মুজিবপ্রেমী ও আওয়ামী লীগের আদর্শপ্রেমী আসলে কাদের সিদ্দিকীই। তিনি যখনই শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে দেখেছেন, তখনই তাকে সঠিক পথে ফিরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তাকে বুঝতে না পেরে বরং অপমান করেছেন, তার কথা উপেক্ষা করেছেন।
শেখ হাসিনার এই ধরনের আচরণের পরেও, কাদের সিদ্দিকী নিজের আদর্শিক অবস্থান থেকে কখনো পিছু হটেননি। তিনি দৃঢ়ভাবে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে শেখ হাসিনাকে সঠিক পথের নির্দেশনা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আজ যখন দেখি অনেকেই শেখ হাসিনার চারপাশ থেকে সরে যাচ্ছেন, তখন কাদের সিদ্দিকীর সেই নীতিগত অবস্থান এবং অটল বিশ্বাস প্রকৃত মুজিবপ্রেমীর পরিচায়ক হয়ে উঠেছে।
কাদের সিদ্দিকী প্রমাণ করেছেন যে, তার সমালোচনা বা শেখ হাসিনার অপমান তাকে ভেঙে দিতে পারেনি; বরং তার মুজিবপ্রেম এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি তার নিবেদন আরও মজবুত হয়েছে। তিনি শুধু বঙ্গবন্ধুর নামেই নয়, তার আদর্শকেও গভীরভাবে ধারণ করেছেন, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। এটাই বুঝিয়েছে যে, আমার পূর্বের সমালোচনা হয়তো সঠিক ছিল না। আসল মুজিবপ্রেমী তো কাদের সিদ্দিকী, যিনি সত্যিকার অর্থে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে জীবনের পথে অনুসরণ করেছেন।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই