অন্তর্বর্তী সরকার: জনগণের প্রত্যাশা পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ
১৫ আগস্ট ২০২৪ ২০:৩৪
বাংলাদেশের এক ক্রান্তিকালে দায়িত্ব নেওয়া নতুন সরকারকে নিঃসন্দেহে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। দীর্ঘ শাসনে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে অকার্যকর হয়েছে, সেগুলোকে সংস্কার করে কার্যকর করার কাজটি সহজ নয়। তা ছাড়া এই সরকারের কাছে সব মহলের প্রত্যাশাও থাকবে অনেক বেশি। যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রাধান্য ঠিক করে তাঁরা সেই কাজগুলো নিশ্চয় করবেন। কিন্তু এই মুহূর্তে সরকারের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নেওয়া এবং পুলিশ ও প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ১৭ সদস্যের অন্তর্বর্তী সরকার শপথ গ্রহণের মাধ্যমে দায়িত্ব নিয়েছে যার মাধ্যমে দেশ এক অনিশ্চিত পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেল।এখন নতুন উদ্যমে তরুন প্রজন্মকে সাথে নিয়ে দেশ গঠনের পালা যদিও কাজটি কঠিন তবে অসম্ভব নয়।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক সরকারগুলোর মধ্যে একধরনের প্রবণতা দেখা যায়, ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছু দলীয়করণ করা হয়। দেখা যাচ্ছে গত সরকারের বিদায়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে আসীন অনুগত কর্মকর্তাদের অনেকেই বিদায় নিয়েছেন। অনেকে বিদায়ের অপেক্ষায় আছেন। এই পদগুলোতে যেন মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই নিয়োগ নিশ্চিত করা হয়। নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার আগেই কিছু নিয়োগ ও পরিবর্তন হয়েছে, যা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সব ক্ষেত্রেই নির্দলীয় লোকের অধিষ্ঠানই কাম্য। কিন্তু নির্দলীয় সৎলোক এখন কোথায় পাওয়া যাবে এটি প্রশ্নই রয়ে গেল। কারন সরকারী চাকুরেজীবিরা হলো প্রজাতন্ত্রের কর্চারী এবং সবধরনের রাজনীতি থেকে তারা প্রভাবমুক্ত থাকবে। বাস্তবতা হলো ক্ষমতার রাজনীতিতে টিকে থাকার জন্য সরকার তাদেরকে ব্যবহার করে এবং সরকার বদলের সাথে সাথে তাদের ভাগ্যের চাকাও ঘুরে দাঢ়ায় যা এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি।
আমাদের এই শ্রমঘন সমাজে জুতসই একটি কাজ খুঁজে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। নিজের যোগ্যতা, পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে পছন্দমতো চাকরি করা—মানুষের সারা জীবনের আকাঙ্ক্ষা। শিক্ষাজীবন থেকেই আমাদের সমাজের মানুষ ব্যস্ত থাকে ভবিষ্যতে কী কাজ করবে, কোন ধরনের চাকরি করবে, তা নিয়ে। সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি থাকে সরকারি কোনো উচ্চপদে চাকরির জন্য। সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা অথবা করপোরেশনে চাকরি করার ক্ষেত্রে অধিকতর মেধাবীরা প্রস্তুতি নিতে থাকে শিক্ষাজীবন থেকেই। এখানে দোষের কিছু নেই, নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তুলে কেউ যদি যথাযোগ্য চাকরি পায়, তখন সে তার মেধার বিকাশ ঘটাতে পারবে কর্মক্ষেত্রে, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্ত দীঘ সময় ধরে গনতান্ত্রিক সরকারের মধ্যে একনায়কত্ত, কাজ সৃষ্ঠিতে স্থবিরতা, কর্মসংন্থান বিহীন প্রবৃদ্ধি ও রাজনৈতিক দৌববিত্তায়ন যুব ছাত্র সমাজের মধ্যে ক্ষোবের সৃষ্টি করে যা থেকেই কোটা আন্দোলন ও সরকারের পট পরিবতর্ন। এখন যুবক আন্দোলন বেষ্টিত কেয়ার টেকারের উপর সাধারন জনগনের প্রত্যাশা অনেক এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রত্যাশা পূরন সহজ হবে বলে মনে হয় না। কারন আগে পরিবেশ সৃষ্ঠি, তারপর ইলেকশন, তারপর গনতন্ত্রের পুনজাগরন যা সময় সাপেক্ষ যা সরকারের আলাপ আলোচনা থেকে অনুধাবন করা যায়।
এখন প্রত্যাশার প্রশ্ন আসলেই প্রথমেই আসে জনগনের জীবন জীবিকা যা দীষ দিন ধরে স্থবির হয়ে আছে। নতুন অর্থবছরে দেশের সার্বিক অর্থনীতিকে প্রধান চারটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সামনে এগোতে হবে সরকাকে। এগুলো হচ্ছে- মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতিতে লাগাম টানা, ডলার সংকট মোকাবিলা করে বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখা, বিনিয়োগ বাড়াতে উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা এবং রাজস্ব আয় বাড়ানো। দেশে চলমান অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এসব খাতে লক্ষ্য অর্জন বেশ চ্যালেঞ্জিংযা বতর্মান তদারকি সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছ। এসবের পাশাপাশি আরও কিছু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে আইএমএফ-এর শর্তের বাস্তবায়ন এবং এর প্রভাব মোকাবিলা। বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ বাড়াতে আস্থার সঞ্চার করা, রেমিট্যান্স প্রবাহের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক থেকে ইতিবাচক অবস্থায় আনা। এছাড়া টাকা পাচার রোধ এবং হুন্ডির প্রভাব কমানো একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে রয়েছে। অর্থনৈতিক মন্দা, বিনিয়োগ হ্রাস, ডলার সংকট ও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতির কারণে আমদানি যেমন কমেছে, তেমনই সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের গতিও কম। ফলে সরকারের রাজস্ব আহরণও কম হচ্ছে। কয়েক বছর ধরে রাজস্ব আয় কম হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। এতে সরকারের ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনই কমেছে বিনিয়োগও। রাজস্ব আয় না বাড়ায় সরকারকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট থাকায় চাহিদা অনুযায়ী সরকারকে ঋণের জোগানও দিতে পারছে না। মূল্যস্ফীতি বাড়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ছাপানো টাকায়ও ঋণ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। ফলে সরকারের আর্থিক সংকট প্রকট হচ্ছে। এ সংকট কাটাতে সরকার বিভিন্ন সেবার মূল্য ও ফি বাড়াচ্ছে। এতে ভোক্তার ওপরও চাপ বাড়ছে। এই কাজের জন্যও অন্তর্বর্তী সরকারের অনেক সময় প্রয়োজন হবে। অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও যে বড় একটি জঞ্জাল সাফ করায় অন্তর্বর্তী সরকারকে হাত দিতে হবে তা হলো, দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং ঘটে যাওয়া দুর্নীতির বিচার। যার কয়েকটির প্রক্রিয়া সদ্য সাবেক সরকারের সময় শুরু হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল যতই দীর্ঘায়িত হোক না কেন, যেহেতু এটি কোনো নির্বাচিত সরকার নয়, সেহেতু শেষ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের বাধ্যবাধকতা তাদের রয়েছে। কাজেই একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো, সেই নির্বাচনে দেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মতো একটি রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি। এ জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো দেশে গণতান্ত্রিক বিধিবিধান ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, যা বিগত এক-দেড় দশকে একেবারে ভঙ্গুর অবস্থায় পৌঁছে গেছে। সুশাসনের অভাব, গণতন্ত্রহীনতা ও দুর্নীতি দেশে যে সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টি করেছে; ধর্মাধর্মের বিভেদের কারণে যে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সৃষ্টি হয়েছে, তার নিরসনও একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য জরুরি। এসব কাজ রাজনৈতিক সরকার করার মতো পরিবেশ দেশে কবে তৈরি হবে, সে বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কাজেই এর যতটা করা সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই করতে হবে। সে জন্য অবশ্যই তাদের সময় প্রয়োজন।
এরপর প্রসঙ্গটি হলো দেশে সরকার থাকলেও মূলত কোটা আন্দোলনের সমন্বয়কারীরাই দেশ পরিচালনায় প্রধান অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে বলে প্রতিয়মান। এখন প্রশ্ন উটেছে আন্দোলনকারী ছাত্ররা কবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ফেরত যাবে এবং সাভাবিক কাজ শুরু করবে? কারন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা ঝুলে আছে, বেশীরভাগ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানগন যেমন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল এরই মধ্যে আন্দোলনকারীদের চাপে পদত্যাগ করেছে বা পদত্যাগের পথে রয়েছে। ফলে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলুতে একধরসের প্রশাসনিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে যার সমাধান সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এখন সকল প্রতিষ্টানের প্রধানগন যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্টান প্রধান এই সকল গনপদত্যাগের তালিকায় রয়েছে, বিভিন্ন সংন্থার নাম পরিবতর্নের হিরিক পড়েছে যা ব্যয় বহূল ও সময় সাপেক্ষ। এখন প্রশ্ন উঠেছে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতারে রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে? খবরের কাগজে দেখলাম যুবক ছাত্রদের নিয়ে একটি নতুন দল ঘটনের পরিকল্পনা রয়েছে এবং পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতি তারা আর গ্রহন করবে না যা অতীতের শিক্ষা। আবার শুনাযাচ্ছে রাজনীতি এখন আর সহজ হবেনা এবং আন্দোলনকারী ছাত্ররা আর পুরানো খেলায় যেতে চাচ্ছে না যা জনগনের প্রত্যাশা।
তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের জন্য তাদের এ আন্দোলন থেকেও শিক্ষা নিতে হবে। যারা এ আন্দোলনে সমন্বয়ের ভূমিকা পালন করেন তারা যথার্থ অর্থেই মাথা ঠাণ্ডা রেখে প্রতিটি পদক্ষেপে সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছেন। কখনই আবেগতাড়িত হননি। তবে তাদের এ নেতৃত্ব প্রচেষ্টা এখানেই থেমে থাকা উচিত হবে না। তারা ইচ্ছা করলে সাধারণ ছাত্রছাত্রীর স্বার্থে ‘সাধারণ ছাত্র ফোরাম’ নামে তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে পারেন। পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এটাই বলব, তারা যেন কোনো প্রলোভনের কাছে নতি স্বীকার না করেন। পরিশেষে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন হচ্ছে, এটি একটি সফল সামাজিক আন্দোলন যেখানে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার পরিবার থেকে ছাত্ররা এর সঙ্গে সংযুক্ত হন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সরকারের কোটা নীতির সংস্কার। এ অর্থে আন্দোলনটির রাজনৈতিক তাৎপর্য অনস্বীকার্য। তাই অন্তবতি তদারকি সরকারকে এই বিষয়গুলো অনুধাবন করতে হবে তাদের মেয়াদকালে।
লেখক: গবেষক ও অর্থনীতিবিদ
সারাবাংলা/এসবিডিই
অন্তর্বর্তী সরকার: জনগণের প্রত্যাশা পূরণই বড় চ্যালেঞ্জ ড. মিহির কুমার রায় মত-দ্বিমত