আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার হোক
১৮ আগস্ট ২০২৪ ১৪:২১
আলফ্রেড সরেনকে যখন হত্যা করা হয় তখন তার একমাত্র সন্তান ঝর্ণা সরেনের বয়স ছিল সাড়ে তিন বছর। বর্তমানে বিবাহিত সংসারী ঝর্ণা সরেনের কাছে তার বাবার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। মাসী মরিয়ম হাঁসদা ঝর্ণাকে দেখাশোনা করেন। আলফ্রেড হত্যার পর ভূমি দখলদারদের কারণে আলফ্রেডের পরিবার গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়। তারপর রাজশাহীর তানোরের মথুরাপুর থেকে জয়পুরহাটের পাঁচবিবির মহিপুর, ঢাকার এক ব্যাপ্টিস্ট মিশন থেকে আবার রাজশাহীর মথুরাপুর। বিচারহীনতার যন্ত্রণা ও ক্ষোভ নিয়ে ২৪ বছর বাঙালি রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করেছে আলফ্রেডের পরিবার। কিন্তু কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থা এসব পাত্তাই দেয়নি। কারণ ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্বই আলফ্রেড সরেনদের ভূমি দখল করেছিল। স্থানীয় সরকার, বিচার ও আদালত সব ছিল তাদেরই দখলে। আদিবাসী ভূমি আন্দোলন সংগ্রামের এক জীবন্ত স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছেন আলফ্রেড। আলফ্রেডের মৃত্যুদিবসে আদিবাসী জনসংগঠন নানাভাবে সোচ্চার হয়েছে, আদিবাসী ভূমি দখলের অনিবার্য গণিতকে প্রশ্ন করেছে। নাট্যদল আরণ্যক এই ঘটনাকে উপজীব্য করে মঞ্চস্থ করেছে নাটক ‘রাঢ়াং’। কিন্তু নিদারণভাবে আলফ্রেডের গ্রাম থেকে দিনে দিনে আদিবাসীরা উদ্বাস্তু হয়েছেন। মেলেনি বিচার, সুরক্ষিত হয়নি ভূমির অধিকার। ছাত্র-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করেছে, বৈষম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার দাবি তুলেছে। জুলাই অভ্যুত্থান সর্বজনের ছিল, এখানে শাইখ আশহাবুল ইয়ামিনের রক্ত ঝরেছে, রক্ত ঝরেছে রিয়া গোপের, রক্ত ঝরেছে লিটন চন্দ্র হেমব্রমের। রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের ভেতর দিয়ে গঠিত অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে দেশ ও দশের দাবি অনেক। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থায় সংগঠিত সকল জুলুম ও নিপীড়নের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার আশ্বাস দিয়েছেন সরকার। সরকারের উপদেষ্টাদের অনেকেই আদিবাসী অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। আমরা আশা করবো অন্তবর্তীকালীন সরকার আলফ্রেড সরেন হত্যার বিচার শুরু করবে।
রক্তাক্ত ১৮ আগস্ট ২০০০
আলফ্রেডের জন্ম নওগাঁর মহাদেপুরের ভীমপুর গ্রামের এক সাঁওতাল কৃষক পরিবারে। মা ঠাকুররানী হাঁসদা এবং পিতা গায়না সরেন । ভীমপুরের প্রায় ৪৬০ বিঘা জমি নিয়ে সাঁওতাল ও প্রভাবশালী কিছু বাঙালিদের ভেতর এক ভূমি-বিবাদ তৈরী হয়। সাঁওতালেরা নিয়মতান্ত্রিকভাবে এইসব জমিতে আবাদ ও বসবাস করে আসছিলেন। এলাকার প্রাক্তন চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা হাতেম আলী সাঁওতালদের উচ্ছেদ শুরু করে। এই চক্রান্তে যুক্ত হন সীতেশ ভট্টাচার্য (গদাই লস্কর নামে পরিচিত)। তাদের মূল লক্ষ্য সাঁওতালদের ৪৬০ বিঘা আবাদী শস্যফলা জমিন। ভূমি সুরক্ষায় সাঁওতালদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলনে নামেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ভীমপুর ইউনিয়ন শাখার সভাপতি আলফ্রেড সরেন। ২০০০ সালের ১৮ আগস্ট হাতেম আলী ও সীতেশ ভট্টার্চাদের ভাড়াটে দল সশস্ত্র আক্রমন করে ভীমপুর সাঁওতাল গ্রামে। বাঙালিদের উচ্ছেদ আক্রমন ঠেকাতে আলফ্রেডের নেতৃত্বে জোৎস্না সরেন, রেবেকা সরেন, বিশ্বনাথ বেসরা, সুবল বেসরা, কমল সরেন, দেবেন সরেন, অনিল সরেন ও শ্রীমন্ত হেমব্রমরা গ্রামবাসীদের নিয়ে রুখে দাঁড়ান। আক্রমনকারীদের আঘাতে ৩২ বছর বয়সে নিহত হন আলফ্রেড সরেন। আহত ও জখমপ্রাপ্তরা দীর্ঘদিন চিকিৎসা নেন।
কী ঘটেছিল এক সপ্তাহ আগে?
২০০০ সনের ১৮ আগস্ট খুন হন আলফ্রেড। কিন্তু কী ঘটেছিল এর সাত দিন আগে? ২০০০ সনের ১১ আগস্ট দুপুরবেলা হাতেম আলীর নেতৃত্বে সীতেশ ভট্টাচার্যের ভাড়াটে বাহিনি ভীমপুর গ্রামে ঢুকে এলোপাথারি হামলা চালায়। মারাত্মক জখমপ্রাপ্ত হন বিশ্বনাথ বেসরা, আলফ্রেড সরেন, সুবল বেসরা ও শ্রীমন্ত হেমব্রম। সবাই মহাদেবপুর হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। বিশ্বনাথ বেসরাকে ভর্তি করাতে হয় রাজশাহী মেডিকেল কলেজে। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর জানতে পারেন আলফ্রেড খুন হয়েছে।
কী ঘটেছিল ১৯৮৭ সনে?
পিযূষ ভট্টাচার্য ও সীতেশ ভট্টাচার্য নওগাঁর এক ধনী পরিবার। তাদের মামাদের ফেলে যাওয়া অনেক জমিজমা একটা সময় ‘২নং খাস খতিয়ান’ হয়ে যায়! এইসব জমি নিজেদের দখলে রাখার নিমিত্তে তারা ভূমিহীন আদিবাসীদের ব্যবহার করেন। রাজশাহীর তানোরের মোহর গ্রামে থাকতেন গায়না সরেন, আলফ্রেডের বাবা। আদিবাসীদের বলা হয় ভীমপুরে গিয়ে চাষাবাদ করলে প্রতি পরিবারকে পাঁচ বিঘা করে জমি রেজিষ্ট্রি করে দেয়া হবে। ভীমপুরে এসে ১৩ সাঁওতাল পরিবার শুরু করেন চাষাবাদের এক কঠিন সংগ্রাম। পীযূষ ভট্টাচার্যদের কাছ থেকে পান ১২০ বিঘা বরেন্দ্রভূমি। ২০০০ সনের ১৮ আগস্টের আগেই মারা যান পীযূষ ভট্টাচার্য। হাতেম আলী সাঁওতালদের নামে বন্দোবস্ত করে দেয়া এই জমিন জবরদখলের এক নিদারুণ ষড়যন্ত্র করে যা ভাংচুর-হামলা-খুন-জখম পর্যন্ত গড়ায়। হাতেম আলী বিরুদ্ধে এলাকার হিন্দুদের আরো ৩২ বিঘা ও বলিহারে আদিবাসীদের ৭ বিঘা জমি জবরদখলের অভিযোগ আছে।
মামলা হয়েছিল, কিছু দিন পুলিশ পাহারাও ছিল
আলফ্রেড হত্যার পর ভীমপুরে প্রায় সাড়ে তিন বছর একটি অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প ছিল। আলফ্রেডের বোন রেবেকা সরেন বাদী হয়ে হত্যা ও জননিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা করেন। মহাদেবপুর থানা পুলিশ তদন্ত শেষে ৯১ জন আসামির নামে আদালতে চার্জশিট দাখিল করে। পুলিশ কয়েকজন আসামীকে গ্রেফতারও করে। নওগাঁ জেলা ও দায়রা জজ আদালতে ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য নেয়া হয়। মামলার প্রধান দুই আসামি সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান হাতেম আলী ও ব্যবসায়ী সীতেশ ভট্টাচার্যসহ ৬০ জন জননিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করলে হাইকোর্ট ৩ মাসের জন্য মামলাটির স্থগিতাদেশ করে। আদালত থেকে আসামিরা জামিনে বেরিয়ে আসে। মামলাটি পরে ঝুলে থাকে। আসামীরা হুমকী-ধামকি অব্যাহত রাখে। ২০০৩ সালে প্রায় সব আদিবাসীরাই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। ২০১৫ সনের ২৩ ডিসেম্বর আসামীরা আবারো আলফ্রেডের বড় ভাই ও তার স্ত্রীর উপর হামলা করে। মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নওগাঁ জেলা ও দায়রা আদালত ১২০ বিঘা জমির ভেতর ৬৩ বিঘা জমি আলফ্রেড সরেনসহ আদিবাসীদের অনুকূলে বন্দোবস্তী দেয়। কিন্তু সেই ৬৩ বিঘা জমির ভেতর ৩৩ বিঘাই আসামীরা আবারো জবরদখল করে রেখেছে। আদিবাসীরা মাত্র সাড়ে বত্রিশ বিঘা জমি কোনোমতে চাষাবাদ করতে পারছেন।
করুণ নিরুদ্দেশ
সারাদেশে জনসংখ্যা বাড়ে। কিন্তু ভীমপুর সাঁওতাল গ্রামে দিনে দিনে সাঁওতালদের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে কমতে থাকে। আলফ্রেড হত্যার আগ পর্যন্ত গ্রামে ১৬ পরিবার সাঁওতাল ছিল। এখন আছেন আট পরিবার। সুবল বেসরা, কমল সরেন, দেবেন সরেন, কমল সরেন, অনিল সরেন ও শ্রীমন্ত হেমব্রমের পরিবার গ্রাম ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। বর্তমানে ৮ পরিবার সাঁওতালসহ ৫ পরিবার বর্মণ, মালো ও বৈরাগী ১ পরিবার নিয়ে ১৬ পরিবার আদিবাসী আছেন ভীমপুর গ্রামে। অপেক্ষা করছেন ভূমি যন্ত্রণার দু:সহকাল কাটবে। বিচার হবে আলফ্রেড হত্যার।
রাষ্ট্রের সংস্কার প্রক্রিয়ায় আলফ্রেড সরেন থাকতে হবে
জুলাই অভ্যুত্থানের পর রাষ্ট্র সংস্কারে সরব এখন দেশ। এই সংস্কার প্রক্রিয়ায় আদিবাসী অধিকার ও ভূমি প্রসঙ্গ গুরুত্ব দিতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের জন্য একজন উপদেষ্টা নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু দেশে সমতল অঞ্চলের আদিবাসীদের জনসংখ্যা বেশি। পাহাড় আর সমতলের সংকট একরকম নয়। বঞ্চিত সমতলের জন একজন আদিবাসী উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া জরুরি। কারণ পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সমতলের আদিবাসীদের যন্ত্রণা বুঝবে না। প্রতিদিন দেশজুড়ে কমছে কৃষিজমি। চাষাবাদের জমিনের প্রায়টাই ভিন্ন কায়দায় দখল করে রাখছে বহুজাতিক কোম্পানি। যারা জমির বুক ও কলিজা থ্যাৎলে দিয়ে রাসায়নিক সার-বিষ-হাইব্রিড কী সংহারী বীজের ব্যবসা করে। ভূমির বুক ছিন্নভিন্ন করতে আরও সক্রিয় আছে বনবিভাগ, অধিগ্রহণ, অবকাঠামো নির্মাণ, নগরায়ণ। ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদ আদিবাসী ভূমিদখলকে বৈধদা দিয়েছে। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার আওয়াজকে জারি রাখতে হবে। আলফ্রেড সরেন প্রসঙ্গে নিশ্চুপ থেকে আবারো কর্তৃত্ববাদকে জায়েজ করা যাবে না।
লেখক: গবেষক ও লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই