Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পুনঃবার জাতির পিতার মৃত্যু

আবু মকসুদ
১৯ আগস্ট ২০২৪ ১৬:৫৭

নূরুর রহমান নোমান ভাই, একজন অগ্রজপ্রতিম ব্যক্তিত্ব, বর্তমানে যুক্তরাজ্যের নিউক্যাসেলে বসবাস করছেন। শিল্প ও সাহিত্য জগতের সমঝদার হিসেবে তিনি সুপরিচিত। কৈশোর এবং যৌবনে তিনি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন এবং বহু সাহিত্যিক কাজ প্রকাশ করেছেন। রাজনীতি সচেতন এই মানুষটির জীবন বাম বলয়ের আদর্শে আবৃত। উদীচী, ছাত্র ইউনিয়ন এবং কমিউনিস্ট পার্টির ভাবধারা তার জীবনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। তিনি এসব আদর্শের মাধ্যমে জীবনকে লালন ও পালন করেছেন।

বিজ্ঞাপন

যদিও তিনি আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন, তবে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে তার অবস্থান দৃঢ় ও আপোষহীন। তার কাছে বঙ্গবন্ধু এমন একটি নাম, যা বাংলাদেশ নামের সমার্থক। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশকে কল্পনা করতেও পারেন না। আমিও নোমান ভাইয়ের মতো ভাবি, যদিও আমি কখনো কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলাম না। আমি যেমন আওয়ামী লীগের সদস্য ছিলাম না, তেমনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও হইনি।

বিজ্ঞাপন

আমার পরিবারের প্রভাব কিছুটা বামপন্থী ছিল, বড় ভাই উদীচির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে আমি সেই পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। তবে আমার নিজের রাজনৈতিক ধারা কখনো কোনো নির্দিষ্ট দলের সঙ্গে মেলেনি। তারপরও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আওয়ামী লীগকে আমি কিছুটা পছন্দ করতাম। এদিক থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর প্রতি আমারও অগাধ শ্রদ্ধা ছিল এবং আছে। তার আদর্শকে আমি বাংলাদেশের সমার্থক হিসেবে দেখি। শুধু বাংলাদেশই নয়, বাঙালির স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু নামটি একটি আদর্শ। এ কারণে, নোমান ভাইয়ের সঙ্গে আমার মতবিরোধ তেমন হয়নি, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুর প্রশ্নে। আমরা দুজনই এখানে একমত।

সম্প্রতি ফেসবুকে একটি পোস্টের পরিপ্রেক্ষিতে নোমান ভাইয়ের একটি মন্তব্য নজরে আসে, যেখানে তিনি লিখেছেন, “দুর্ভাগা পিতা, কন্যার হাতেই পিতার দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটলো!”—এই মন্তব্যটি বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা সংক্রান্ত। নোমান ভাইয়ের বক্তব্যের মূলভাব হলো, শেখ হাসিনার কারণেই বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় মৃত্যু হয়েছে।

এই বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য আমাদের কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে। শেখ হাসিনা কি সত্যিই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন? তার শাসনামলের দিকে তাকালে কিছু বেদনাদায়ক বাস্তবতা আমাদের সামনে উঠে আসে।

দেশত্যাগ কিংবা পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত পরাজয় হতে পারতো তার, কিন্তু আমাদের মতো অসংখ্য মানুষের কাছে তার পতন একটি বৃহৎ প্রভাব ফেলেছে। আমরা যে শব্দগুলো নিয়ে বাঁচতাম—বাঙালি, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ—সেগুলো এখন বিবর্ণ, কারণ শেখ হাসিনা তার স্বৈরাচারী শাসনে এগুলোকে প্রশ্নবিদ্ধ এবং ক্ষতিগ্রস্ত করেছেন। তিনি নিজে শুধু ধ্বংস হননি, বরং এই আদর্শগুলোকেও ধ্বংস করেছেন। স্বৈরাচারী শাসনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা আমাদের শেষ অবলম্বনটুকুও কেড়ে নিয়েছেন।

শেখ হাসিনার শাসনামলে আমাদের যে আদর্শগুলো ছিল, তার ওপর আঘাত এসেছে। বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিলেন, তখন তার মূল উদ্দেশ্য ছিল একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠন করা। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনে গণতন্ত্রের অবক্ষয়, বিরোধী মতের দমন, এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর নিয়ন্ত্রণের মতো নানা অভিযোগ উঠে এসেছে। এসব ঘটনায় বঙ্গবন্ধুর আদর্শের প্রতি ভরসা হারানোর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

আমি বলেছিলাম, শেখ হাসিনা তার পিতাকে শেষ সম্মানটুকু জানাতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর বিশালত্ব রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নিজের হাতে পিতাকে দ্বিতীয়বার দাফন করেছেন। অনেকেই হয়তো এই কথার সঙ্গে দ্বিমত করবেন। তারা বলবেন, পিতার প্রতি কন্যার দরদ বাইরের কারো চেয়ে কম হতে পারে না। এটি কি ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ’ হয়ে যাবে?

শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন। তার যতটুকু অর্জন, সবটুকুই বঙ্গবন্ধুর নামের আড়ালে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেই নামের মর্যাদা রাখতে ব্যর্থ হয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর যে আদর্শ ছিল, শেখ হাসিনা সেই আদর্শ থেকে শত সহস্র মাইল দূরে চলে গেছেন। তাই পিতার প্রতি কন্যার প্রেম আদর্শের মাপকাঠিতে কতটুকু মাপা যায়, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

পিতাকে অস্বীকার করার ইতিহাস নতুন নয়। বহুবার আমরা দেখেছি, পিতার আদর্শকে ব্যবহার করে কেবল নিজের স্বার্থসিদ্ধি করা হয়েছে। শেখ হাসিনার ক্ষেত্রেও কি তাই ঘটেছে? তার শাসনামলের দিকে তাকালে এ ধারণা অমূলক নয়। বঙ্গবন্ধু যে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আদর্শের ভিত্তিতে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, শেখ হাসিনার শাসনে সেই আদর্শ থেকে বিচ্যুতির উদাহরণ আমরা দেখতে পাই।

বঙ্গবন্ধু স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি সমৃদ্ধ, গণতান্ত্রিক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ সমাজের। তার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল বাঙালির স্বাধীনতা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সকলের অধিকার রক্ষা করতে হবে এবং সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে সমান মর্যাদা দিতে হবে। তিনি কখনোই অনুগত শাসক বা স্বৈরশাসকের ভূমিকা পালন করেননি। বরং তিনি ছিলেন জনগণের প্রতিনিধি, যিনি জনগণের স্বার্থে কাজ করেছিলেন।

এর বিপরীতে, শেখ হাসিনার শাসনে আমরা গণতন্ত্রের অবক্ষয়, বিরোধী মতের প্রতি সহিষ্ণুতা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের বহু উদাহরণ দেখতে পেয়েছি। শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালানো, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ, এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের দমনপীড়ন—এগুলো সবই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

শেখ হাসিনার শাসনে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর যে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে, তা বঙ্গবন্ধুর ন্যায় বিচারের আদর্শের পরিপন্থী। তার আদর্শ ছিল জনগণের সুরক্ষা, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতি। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনামলে এসব মৌলিক নীতির ওপর যে আঘাত এসেছে, তা সত্যিই বেদনাদায়ক।

যদি আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গঠনের লক্ষ্যে শেখ হাসিনার প্রচেষ্টাকে মূল্যায়ন করি, তবে দেখা যাবে যে, যদিও কিছু উন্নয়ন সাধিত হয়েছে, কিন্তু এসব উন্নয়ন মানবাধিকারের প্রতি নিষ্ঠা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাবের কারণে অম্লান হয়ে গেছে। বাংলাদেশকে পৃথিবীর মানচিত্রে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা হলেও, মানুষের মৌলিক অধিকার ও সমতার প্রশ্নে যে অবক্ষয় ঘটেছে, তা শেখ হাসিনার শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ক হিসেবে রয়ে গেছে।

নোমান ভাই যখন বলেন, ‘কন্যার হাতেই পিতার দ্বিতীয় মৃত্যু ঘটলো’, এটি একটি শক্তিশালী বক্তব্য। শেখ হাসিনা জেনে শুনে পিতাকে অস্বীকার করেছেন, তার আদর্শকে নিজ হাতে দাফন করে দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ রক্ষার জন্য তার প্রচেষ্টার অভাব সত্যিই স্পষ্ট।

শেষ পর্যন্ত, আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে যে, একজন কন্যা যখন তার পিতার আদর্শ থেকে বিচ্যুত হন, তখন তা শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাসঘাতকতার পরিচায়ক নয়, বরং একটি বৃহৎ আদর্শগত সংকটেরও ইঙ্গিত দেয়। শেখ হাসিনার শাসনের দ্বারা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের যে ক্ষতি হয়েছে, তা আমাদের চিন্তায় স্থান পাবে, কারণ এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক চেতনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আমরা আশা করি, আগামী দিনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আদর্শকে পুনরুজ্জীবিত করবে এবং সমাজকে ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের পথে পরিচালিত করবে। শুধুমাত্র তত্ত্ব নয়, বাস্তব জীবনের প্রেক্ষাপটে আদর্শের অনুসরণ ও বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা উচিত। নইলে, আমাদের মহান নেতার স্মৃতি শুধু এক ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকবে, আদর্শের কৌলিন্যও হারাবে।

লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক

সারাবাংলা/এসবিডিই

আবু মকসুদ জাতির পিতার মৃত্যু পুনঃবার মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর