‘জাতি মারিবার মন্ত্রণা’
৪ জুন ২০১৮ ১৬:৩৯
।। এরশাদুল আলম প্রিন্স ।।
‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’— ১৮৫৯ সালে প্যারীচাঁদ মিত্রের লেখা একটি উপন্যাস। এই উপন্যাসের মাধ্যমেই তিনি প্রথম টেকচাঁদ ঠাকুর নামে বাংলা সাহিত্যে আবির্ভূত হন। উপন্যাসটির মাধ্যমে আমরা ১৬০ বছর আগের কলকাতার শিক্ষিত বাঙালিদের, বিশেষত পুরুষদের মাদকময় জীবনের একটা চিত্র খুঁজে পাই। সেই সাথে একটি সমাজ কীভাবে মাদকের ছোবলে ধীরে ধীরে লয়প্রাপ্ত হয়, তার একটি ব্যঙ্গচিত্র ওই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন প্যারীচাঁদ। দুই খণ্ডের ওই উপন্যাসের অধ্যায় ১০টি। কয়েকটি অধ্যায়ের শিরোনাম আজও প্রাসঙ্গিক— ‘মদ খাওয়া বাড়িতেছে, মাতাল নানারূপী’, ‘মদে মত্ত হইলে ঘোর বিপদ ঘটে’, ‘নেশাতেই সর্বনাশ’, ‘জাতি মারিবার মন্ত্রণা’ ইত্যাদি। এই লেখার শিরোনাম তার উপন্যাস থেকেই নেয়া।
দেড়শ’ বছরে ভারতবর্ষের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু বোধ করি মাদকের ব্যবহার বেড়েছে বৈ কমেনি। মাদক আজ আমাদের এই বঙ্গভূমিতে একটি ‘জাতি মারিবার মন্ত্রণা’ হিসেবে দেখা দিয়েছে। এ প্রেক্ষাপটেই সরকার মাদকের বিরুদ্ধে শুরু করেছে অভিযান, যারা স্লোগান— ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’। এই অভিযানে গত ১৫ মে থেকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ শতাধিক লোক নিহত হয়েছে।
দেশে মাদকাসক্তি বা মাদকের ব্যবহার বহুগুণ বেড়ে গেছে। দেশের তরুণ ও যুব সমাজ মাদকের ভয়াবহ ছোবলে দিশেহারা। শহর বা গ্রাম, অভিজাত এলাকা বা বস্তি, ধনী বা গরিব— মাদক গ্রাস করেনি, এমন কোনো এলাকা নেই, এমন কোনো গোষ্ঠী নেই।
একসময় মাদকসেবীদের কাছে হেরোইন খুবই জনপ্রিয় ছিল। এরপর বহুদিন নেশার জগতে গাঁজার রাজত্ব চলেছে। দুই দশক আগেও দেশে গাঁজার রাজত্ব ছিল। গাঁজা এখনও আছে, তবে তার একচেটিয়া রাজত্বে খানিক ভাটা পড়েছে। গাঁজার পর আসে ফেনসিডিল। গাঁজা ও ফেনসিডিল যৌথভাবে অনেক দিন রাজত্ব করেছে। সবকিছু ছাড়িয়ে মাদক সাম্রাজ্য গত এক দশক ধরে ইয়াবার দখলে।
দেশে ইয়াবার উত্থান-বাণিজ্য-বিপণন-বিতরণ ও একে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে অবদান রাখার জন্য অনেকে বিভিন্ন খেতাবও পেয়েছেন। কেউ হয়েছেন ইয়াবা সম্রাট, ইয়াবা বাবা, গডফাদার কিংবা গডমাদার; আবার কেউ হয়েছেন ইয়াবা সুন্দরী। এসব ইয়াবা প্রমুখরা দেশে ইয়াবার প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে নানা ভূমিকা পালন করেছেন। গাঁজা, ফেনসিডিল বা অন্য কোনো মাদকের জন্য এমন খেতাবের নজির নেই। ইয়াবাকে সহজলভ্য করার জন্য জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড, এমনকি মৌজাকেন্দ্রিক সিন্ডিকেটও গড়ে তুলেছেন ওইসব ইয়াবা প্রমুখরা।
ইয়াবাসেবী তো বটেই, সাধারণ এলাকাবাসীও এলাকার ইয়াবা ডিলারকে চেনেন। এমনকি ইয়াবার আখড়া কোথায়, তাও কারো অজানা নয়। যদিও ক্ষেত্রবিশেষে আমাদের সদাশয় পুলিশের কাছে এসব তথ্য বরাবরের মতোই ছিল অজ্ঞাত! তবে, সম্প্রতি এসবের তথ্যে হালনাগাদ হয়েছে পুলিশ। আর তাই দেশের ব্যবসায়ীরা সবাই আজ আইনের আওতায় আসুক আর নাই আসুক, বন্দুকের আওতায় চলে এসেছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় এ অধিদপ্তর। এছাড়া মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে আইন আছে, বিধিমালা আছে, আছে অধিদপ্তর। দেশে মাদকদ্রব্য সংশ্লিষ্ট প্রায় ডজন খানেক আইন আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে— মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ (লাইসেন্স ও পারমিট ফিস) বিধিমালা, ২০১৪; অ্যালকোহল কন্ট্রোল (লাইসেন্স ফি) বিধিমালা, ১৯৯১; বেসরকারি ড্রাগ আসক্তি কাউন্সেলিং, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কন্ট্রোল বিধিমালা, ২০০৫; ১৯৯১ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা, ১৯৯৯; জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড তহবিল বিধিমালা, ২০০১ এবং সর্বোপরি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০ ইত্যাদি। সব আইনেরই রয়েছে আলাদা আলাদা এখতিয়ার।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের অধীনে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড নামে একটি বোর্ডও গঠন করা হয়েছে। সরকারের ১১ জন মন্ত্রী ওই বোর্ডের সম্মানিত সদস্য। এছাড়া আছেন একাধিক সচিব ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এই বোর্ডের দায়িত্ব ও কর্তব্য ব্যাপক। আইন বলছে, মাদকদ্রব্যের ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া রোধের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন করা এই বোর্ডের দায়িত্ব।
এছাড়া মাদকদ্রব্য সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ ও এর উৎপাদন, সরবরাহ, ব্যবহার ও নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন, চিকিৎসা ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন তথা জনসাধারণকে সচেতন করা এই বোর্ডের দায়িত্ব। কিন্তু সারাবছর এই আইনের তেমন কোনো কার্যকারিতা আমরা লক্ষ করি না। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য এই বোর্ডের তেমন কোনো বিশদ কর্মপরিকল্পনা আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। হলে দেশে মাদকের এই ভয়াবহ বিস্তার হতো বলে মনে হয় না। মন্ত্র ছেড়ে যন্ত্র ধরার কৌশল হাতে নিতে হতো না।
একথা ঠিক যে আইন দিয়ে নেশা রোধ করা যায় না, মাদকের নেশা তো নয়ই। খোদ মাদবদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ীই দেশে গত আট বছরে ইয়াবার ব্যবহার বেড়েছে ক্ষেত্র বিশেষে শতগুণ। পুরনো মাদকসেবীদের সাথে যোগ হয়েছে নতুনরা। ফলে দেশে ইয়াবার এই বিস্তার। সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী হওয়ায় দেশের সর্বত্রই এটি ছড়িয়ে পড়েছে। দামও হাতের নাগালে থাকায় সব পরিবারের তরুণ-তরুণীরাই এটি কিনতে পারে। আর ইয়াবা সুন্দরী ও গডমাদাররা তো আমাদের আশপাশেই আছেন।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে ‘ইয়াবা’র জগতেও। মোবাইলে ও অনলাইনেও ইয়াবা সরবরাহ করা হয়। আছে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। ফলে, ইয়াবা আজ উচ্চবিত্ত তরুণ-তরুণীদের নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে শহুরে নিম্নমধ্যবিত্ত, শ্রমিক-দিনমজুর, বস্তিবাসী এমনকি রোহিঙ্গাদের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে। মোড়ের পানের দোকানেও এখন ইয়াবা পাওয়া যায়!
দেশের এই অপ্রতিরোধ্য মাদক নেটওয়ার্কের পেছনে রয়েছে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোর মাদক ব্যবসায়ী, আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়া চক্র ও দেশীয় মাদক ব্যবসায়ী। এটি একটি চক্র। এখানে মাদকসেবীরা শুধুই কাস্টমার বা ভোক্তামাত্র (কনজ্যুমার)। সীমান্তের ওপারেই ভারত ও মিয়ানমার মাদকের আখড়া খুলে বসেছে। হালাল গরু আর হারাম মাদক দুই-ই আসছে সীমান্ত পার হয়ে— জল ও স্থল পথে। এছাড়া আমাদের সীমান্তবর্তী দরিদ্র লোকদের একটি অংশ জীবিকার কারণে এই মাদক ব্যবসার অংশীদার হয়েছে। তাই সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বাড়াতে হবে, অবৈধ বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে এবং সীমান্তবর্তী দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান আমাদের দেশেই প্রথম নয়। কলম্বিয়ায় গত ২০ বছরে মাদকবিরোধী অভিযানে ৪ লাখেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। ব্রাজিল ১৯৭০ সাল থেকে মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে এবং ২০১৪ সালে সেখানকার পুলিশ ৩ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প মাদকের বিরুদ্ধে নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। ফিলিপাইনে প্রতিদিন প্রায় ৪০ জনকে হত্যা করা হচ্ছে। কিন্তু এসব তথ্য আমাদের দেশের সাম্প্রতিক বন্দুকযুদ্ধকে জায়েজ করে না। বরং এত হত্যাকাণ্ডের পরও যে ওই সব দেশে মাদকবিরোধী অভিযান সফলতা লাভ করতে পারেনি, সেটাই প্রমাণিত হয়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘মাদক ব্যবসায়ীরা যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আমি যখন যা ধরি, ভালো করেই ধরি। জানেন তো।’ আমরা তা জানি, মানিও। মাদকের নির্মূল হোক— এটা মাদকসেবীরাও চায়। তারাও মাদকের হাত থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু মাদক বন্ধ করার জন্য আমাদের সব অস্ত্র ও মন্ত্রকেই কি আমরা কাজে লাগিয়েছি ও তাতে ব্যর্থ হয়েছি? তবে কি মৃত্যুতেই আমাদের একমাত্র মুক্তি? মানুষ মারার এ ব্রহ্মাস্ত্রই কি মাদক নির্মূলের একমাত্র মন্ত্র? এবং এত কিছুর পরও আমরা অবশেষে মাদকমুক্ত হতে পারব তো?
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট
সারাবাংলা/টিআর