দুর্যোগে জাগ্রত মানবিকতার সুর
২৫ আগস্ট ২০২৪ ১৫:৪৩
বাংলাদেশে যখনই কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সংকট দেখা দেয়, তখন আমরা এক অভূতপূর্ব মানবিকতার জাগরণ প্রত্যক্ষ করি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে, নিজেদের সর্বস্ব দিয়ে অন্যের জীবন রক্ষায় লিপ্ত হয়। এটি আমাদের জাতির এক অনন্য দিক, যা আমাদের গর্বিত করে তোলে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এই মানবিকতার প্রকাশ বেশিরভাগ সময়েই ক্ষণস্থায়ী। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমরা আবারও স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা, এবং অসহিষ্ণুতার গহ্বরে ডুবে যাই। এই বৈপরীত্য আমাদের সমাজের গভীরে লুকিয়ে থাকা নৈতিক দুর্বলতার পরিচায়ক।
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর, ঢাকার জগন্নাথ হলের মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আমাদের মানবিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। একটি ছাত্রাবাসের ছাদ ধসে পড়লে ৪০ জন ছাত্রের মৃত্যু হয় এবং অসংখ্য আহত ছাত্রের সাহায্যে হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসে। রক্তের প্রয়োজন মেটাতে সাধারণ মানুষ দলে দলে হাসপাতালে গিয়ে রক্ত দান করে। তখনও প্রাইভেট হাসপাতালগুলো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পুরোপুরি চালু হয়নি, কিন্তু সেই সংকটময় মুহূর্তে তারা নিজেদের লাভের কথা ভুলে আহতদের জন্য বিছানা উন্মুক্ত করে দেয়। ছাত্রদের মধ্যে অধিকাংশই সনাতন ধর্মাবলম্বী হলেও সাহায্যকারীরা কোনো ধর্মের ভেদাভেদ না করে কেবলমাত্র আহত মানুষকে দেখতে পেয়েছিল এবং তাদের সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।
এমন উদাহরণ আমাদের ইতিহাসে আরও রয়েছে। ২০০৭ সালে, ঘূর্ণিঝড় সিডর যখন বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে, কয়েক হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। শত শত মানুষ তাদের জীবন, সম্পদ এবং নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। আবারও, ২০০৯ সালে যখন ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানে, শত শত মানুষের মৃত্যু ঘটে এবং হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। তখনও আমরা দেখি, কিভাবে সাধারণ মানুষ নিজের সর্বস্ব দিয়ে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে অন্যদের রক্ষা করতে ছুটে আসে। আরও আগের ১৯৮৫ সালের সন্দ্বীপ, হাতিয়া এবং উরির চর ঘূর্ণিঝড়ের সময়ও হাজার হাজার মানুষ তাদের সর্বস্ব দিয়ে অন্যদের সাহায্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই সময়ে মায়েরা তাদের হাতের সোনার চুড়ি খুলে ত্রাণ তহবিলে দিয়েছেন, বাবারা বেতনের পুরো টাকা বানভাসিদের সাহায্যার্থে উৎসর্গ করেছেন।
কিন্তু দুর্যোগের পরে যখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে, তখন সেই মানবিকতার উত্তাপ কি আমাদের মধ্যে থাকে? আমরা কি সেই একই আন্তরিকতা, সহমর্মিতা এবং উদারতা ধরে রাখতে পারি? দুর্ভাগ্যবশত, উত্তরটি হলো—না। দুর্যোগের সময় যে জাতি মানবিকতার মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠে, সেই একই জাতি পরবর্তীতে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় সহিংসতায় লিপ্ত হয়। একদিকে আমরা দুর্যোগের সময় একে অপরের জন্য সর্বস্ব বিলিয়ে দিই, অন্যদিকে স্বাভাবিক সময়ে আমরা নিজেদের স্বার্থে অন্যকে শোষণ করি, নির্যাতন করি, এমনকি হত্যা পর্যন্ত করি। এই বৈপরীত্য আমাদের সমাজের এক গভীর অসঙ্গতি।
উদাহরণস্বরূপ, আমরা দেখতে পাই যে দুর্যোগের সময় যিনি নিজের সর্বস্ব দিয়ে অন্যকে সাহায্য করেন, সেই একই ব্যক্তি পরে ঘুষের মাধ্যমে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করেন। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী কিংবা সমাজের নেতারা দুর্যোগের সময় সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, কিন্তু পরে তারা নিজেদের সুবিধার জন্য সাধারণ মানুষের স্বার্থকে উপেক্ষা করেন। দুর্যোগের সময় আমরা একে অপরকে বাঁচানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি, কিন্তু সংকট কেটে গেলে আমরা একে অপরের প্রতি অবিশ্বাস, বিদ্বেষ এবং শত্রুতা পোষণ করি।
এমনকি আমরা নিজেদের সমাজেও প্রতিনিয়ত এই বৈপরীত্যের উদাহরণ দেখতে পাই। আমরা নিরস্ত্র ব্যক্তির বুকে নির্দ্বিধায় গুলি চালিয়ে দিই এবং এমনকি আমাদের নিরাপত্তা দিতে এগিয়ে আসা পুলিশ সদস্যদেরও পিটিয়ে হত্যা করি এবং তাদের লাশ ব্রিজে ঝুলিয়ে রাখি। ধর্মের নামেও আমরা একে অপরের প্রতি সহিংসতা প্রদর্শন করি, যেখানে দুর্যোগের সময় আমরা ধর্ম, জাত, বর্ণের উর্ধ্বে উঠে একে অপরকে সাহায্য করেছিলাম।
এই বৈপরীত্যের মূল কারণ হতে পারে আমাদের শিক্ষার অভাব, নৈতিকতার দুর্বলতা অথবা সমাজের প্রচলিত নিয়মকানুন। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা একদিকে শিশুদের মানবিকতার শিক্ষা দেয়, কিন্তু সেই শিক্ষা কি সত্যিই তাদের জীবনে প্রভাব ফেলে? আমাদের সমাজের নৈতিক ভিত্তি কি যথেষ্ট শক্তিশালী? কেন আমরা দুর্যোগের সময় মানবিক হতে পারি, অথচ স্বাভাবিক সময়ে সেই মানবিকতা বজায় রাখতে ব্যর্থ হই? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গেলে আমরা দেখতে পাব, আমাদের মানবিকতা অনেকটাই খণ্ডিত; তা মুহূর্তের প্রয়োজনেই প্রকাশ পায়, কিন্তু তা স্থায়ী রূপ ধারণ করতে পারে না।
আরও গভীরে দেখলে বোঝা যায়, আমাদের সামাজিক কাঠামো এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও এই বৈপরীত্যের জন্য দায়ী। দুর্যোগের সময় সমাজের প্রত্যেকটি মানুষ নিজেকে সামগ্রিকভাবে দেখতে শিখে, কিন্তু সেই দুর্যোগ কেটে গেলে তারা নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক বিভাজন আমাদের মানবিকতাকে নষ্ট করে দেয়। যখন একজন ব্যক্তি অর্থনৈতিকভাবে স্থিতিশীল থাকেন, তখন তিনি অন্যের দুর্দশার প্রতি কম সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠেন। একইভাবে, রাজনীতি যখন ক্ষমতার লড়াইয়ে পরিণত হয়, তখন নৈতিকতার মান কমে যায় এবং মানুষের মধ্যে সহানুভূতির অভাব দেখা দেয়।
এই বৈপরীত্য থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আমাদের সমাজকে নতুনভাবে ভাবতে হবে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে, যাতে তা শুধুমাত্র মুহূর্তিক মানবিকতায় নয়, বরং স্থায়ী মানবিকতার ভিত্তি স্থাপন করে। আমাদের নৈতিকতা এবং সমাজের মূল্যবোধকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে, যাতে তারা দুর্যোগের সময় যেমন শক্তিশালী থাকে, তেমনি স্বাভাবিক সময়েও সেই মান বজায় রাখতে পারে। আমাদের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোকে আরও ন্যায়সঙ্গত এবং মানবিক করতে হবে, যাতে তা সামাজিক সংহতির ভিত্তি স্থাপন করে।
আমরা যদি সত্যিই মানবিক হতে চাই, তবে আমাদের এই বৈপরীত্য থেকে মুক্তি পেতে হবে। আমাদের শিক্ষা ও নৈতিকতার ভিত্তিকে শক্তিশালী করতে হবে, যাতে মানবিকতা শুধু দুর্যোগের সময় নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। দুর্যোগ আমাদের জাগিয়ে তুললেও, আমাদের নৈতিকতা ও মানবিকতার স্থায়ী রূপের জন্য আমাদের মনোভাব, আচরণ এবং সমাজের কাঠামোকে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। আমাদের জাতির ইতিহাস এবং সংস্কৃতি এমন যে, আমরা যদি চাই, তবে এই বৈপরীত্যের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারি এবং একটি সত্যিকারের মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে পারি। এজন্য প্রয়োজন সঠিক দিকনির্দেশনা, সাহসিকতা এবং একত্রিত প্রচেষ্টা।
সমাজের প্রতিটি স্তরে মানবিকতার প্রচলন করতে হবে, যাতে তা কেবল দুর্যোগের সময় নয়, বরং প্রতিদিনের জীবনে আমাদের পথপ্রদর্শক হয়। এই বৈপরীত্যের অবসানই হতে পারে আমাদের জাতির সত্যিকারের উন্নয়নের পথ, যেখানে প্রতিটি মানুষ একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে, এবং সমাজে শোষণ, নির্যাতন এবং বিদ্বেষের স্থান থাকবে না।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই