Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক পুঁজির ভূমিকা

ড. মতিউর রহমান
২৯ আগস্ট ২০২৪ ১৫:৩২

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ একটি নিয়মিত ও অনিবার্য ঘটনা। ভৌগোলিক অবস্থান এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ প্রায়ই বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, খরা, নদীভাঙনসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হয়। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলোর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হওয়া সম্ভব না হলেও, তাদের মোকাবিলায় সামাজিক পুঁজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সামাজিক পুঁজি বলতে এখানে সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক বিশ্বাস, সহযোগিতা, নেটওয়ার্ক ও সম্পর্ককে বোঝানো হয়, যা দুর্যোগের সময় মানুষকে সহযোগিতা করে এবং পুনর্বাসনে সহায়তা করে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলাদেশে বারবার ঘটে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, খরা প্রভৃতি দুর্যোগের কারণে কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে, এবং দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এই দুর্যোগগুলোর প্রভাবে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে যায়, এবং অনেক ক্ষেত্রে জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাবকে কমানোর জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তবে দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক পুঁজির ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, কারণ প্রাথমিকভাবে এই সামাজিক নেটওয়ার্ক ও সহযোগিতাই মানুষকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করে এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে পুনর্বাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সামাজিক পুঁজি বলতে সাধারণত এমন একটি সম্পদকে বোঝানো হয়, যা সমাজের মধ্যে বিদ্যমান নেটওয়ার্ক, সম্পর্ক, সহযোগিতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে গঠিত হয়। সামাজিক পুঁজি এমন একটি কাঠামো, যা মানুষের মধ্যে যোগাযোগ এবং সহযোগিতার সম্পর্ককে শক্তিশালী করে। সামাজিক পুঁজির মধ্যে পারিবারিক সম্পর্ক, বন্ধুতা, প্রতিবেশীদের সহযোগিতা, এবং সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান নেটওয়ার্কগুলো অন্তর্ভুক্ত।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে সরকারি ও বেসরকারি সাহায্যের পর্যাপ্ততা সবসময়ই সীমিত, সেখানে সামাজিক পুঁজি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। দুর্যোগের সময় সামাজিক পুঁজি মানুষকে তাত্ক্ষণিক সহায়তা প্রদান করে, যার ফলে তারা দ্রুত সাড়া দিতে পারে এবং নিজেদের রক্ষা করতে পারে।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক পুঁজির ভূমিকা বহুমাত্রিক। দুর্যোগের পূর্বে, দুর্যোগ চলাকালীন এবং দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে সামাজিক পুঁজির কার্যকারিতা ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।

সামাজিক পুঁজি প্রাকৃতিক দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলে, সামাজিক নেটওয়ার্ক ও সম্পর্কের মাধ্যমে মানুষ দ্রুত তথ্য আদানপ্রদান করতে পারে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ঘূর্ণিঝড় বা বন্যার পূর্বাভাস পেলে গ্রামের মানুষ পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুরক্ষিত স্থানে সরিয়ে নিতে সাহায্য করে। স্থানীয়ভাবে সংগঠিত স্বেচ্ছাসেবক দলগুলো দুর্যোগের পূর্বে জনগণকে সচেতন করে তোলে এবং প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণে সহায়তা করে।

দুর্যোগ চলাকালীন সময়ে সামাজিক পুঁজি সরাসরি সহায়তার ভূমিকা পালন করে। গ্রামীণ এলাকাগুলোতে, যেখানে সরকারি সহায়তা পৌঁছাতে সময় লাগে, সেখানে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো সবচেয়ে বড় সুরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ, বন্যার সময় প্রতিবেশীরা পরস্পরকে সাহায্য করে উঁচু স্থানে যেতে, খাবার ও পানীয় জল সংগ্রহ করতে এবং সাময়িক আশ্রয় খুঁজে নিতে।
দুর্যোগের পর সামাজিক পুঁজি পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় প্রধান ভূমিকা পালন করে। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো পরস্পরকে সাহায্য করে ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে এবং নতুনভাবে জীবন শুরু করতে। ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণে সাহায্য, পুনরায় কৃষিকাজ শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান, এবং নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি—এইসব ক্ষেত্রে সামাজিক পুঁজি অপরিহার্য।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক পুঁজির কার্যকারিতা বেশ কয়েকটি প্রেক্ষাপটে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। বিভিন্ন দুর্যোগের সময় এবং পরে সামাজিক নেটওয়ার্ক ও সম্পর্কের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যে সহযোগিতা ও পারস্পরিক সহায়তার মানসিকতা দেখা গেছে, তা উল্লেখযোগ্য। নিচে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো।

বাংলাদেশে প্রায় প্রতি বছরই বন্যা ঘটে এবং এতে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার সময় সামাজিক পুঁজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় সম্প্রদায়গুলো পরস্পরের সাহায্যে দ্রুত বন্যাপ্রবণ এলাকা থেকে সরে যায় এবং উঁচু স্থানে আশ্রয় নেয়। বন্যার পানি কমার পর, ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণে স্থানীয় মানুষরা পরস্পরকে সাহায্য করে। এছাড়াও, সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে খাদ্য, পানি, এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বিতরণ সহজ হয়।

বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়ের সময়, বিশেষ করে উপকূলীয় এলাকাগুলোতে, সামাজিক পুঁজির ভূমিকা অগ্রগণ্য। স্থানীয় মানুষরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সাইক্লোন শেল্টারে আশ্রয় নেয়, যা তাদের জীবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করে। ঘূর্ণিঝড়ের পরে, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পুনর্গঠনে সামাজিক নেটওয়ার্কগুলো প্রাথমিকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।

যদিও সামাজিক পুঁজি প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য সহায়তা প্রদান করে, এর কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে সামাজিক পুঁজির অভাব দুর্যোগ মোকাবিলার প্রক্রিয়াকে জটিল করে তোলে। এছাড়া, দুর্যোগের কারণে সমাজের বিভিন্ন স্তরে অসমতা ও বিভেদ সৃষ্টি হতে পারে, যা সামাজিক পুঁজির কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

দুর্যোগের সময় সমাজের বিভিন্ন অংশে অসাম্যের কারণে সামাজিক পুঁজির কার্যকারিতা ভিন্ন হতে পারে। দরিদ্র জনগোষ্ঠী, নারী, শিশু, এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক পুঁজির সুবিধা সীমিত হতে পারে, কারণ তারা সামাজিক নেটওয়ার্কের মূলধারার বাইরে থাকতে পারে। এই ধরনের অসাম্য দুর্যোগের প্রভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে আরও দুর্বল করে তুলতে পারে।

শহরকেন্দ্রিক নগরায়ণের কারণে গ্রামীণ এলাকার অনেক মানুষ শহরে স্থানান্তরিত হচ্ছে, যার ফলে সামাজিক সম্পর্কগুলো দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনশীল সামাজিক সম্পর্কের কারণে সামাজিক পুঁজির উপর নির্ভরশীলতা কমে যাচ্ছে এবং দুর্যোগ মোকাবিলার সময় নেটওয়ার্ক ও সহযোগিতার অভাব দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক পুঁজির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দুর্যোগের পূর্বপ্রস্তুতি, দুর্যোগ চলাকালীন সহায়তা, এবং দুর্যোগ পরবর্তী পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে সামাজিক পুঁজি প্রাথমিক সহায়তার উৎস হিসেবে কাজ করে।

তবে, সামাজিক পুঁজির কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে সমাজের সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ও সহযোগিতা জরুরি। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় নেতাদেরও এই সামাজিক পুঁজির উন্নয়নে অবদান রাখা উচিত, যাতে সমাজের সব সদস্য দুর্যোগ মোকাবিলায় সমানভাবে সক্ষম হয়।

দুর্যোগ মোকাবিলায় সামাজিক পুঁজি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ এবং সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই উদ্যোগগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষতিকর প্রভাবকে অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে এবং সমাজের সার্বিক সহনশীলতা বৃদ্ধি পাবে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মতিউর রহমান প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা মত-দ্বিমত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর