Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাম ফিলিস্তিন, নিরীক্ষণ ও নৈতিক প্রশ্ন

আসাদুজ্জামান বুলবুল
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:০২

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি মন্তব্য সামাজিক আলোচনার জন্ম দিয়েছে: “মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতে তোমরা ফিলিস্তিনে ইহুদিদের দখলদার বলো, সেই একই মনস্তত্ত্বের ভিত্তিতে আমি পাহাড়ে বাঙালিদের দখলদার বলি।” এই মন্তব্যটি আমাদের সামাজিক বাস্তবতা এবং রাজনৈতিক সংকটের একটি সংকেত। ফিলিস্তিনের অবস্থা ও পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি তুলনা করার আগে, আমাদের উভয় অঞ্চলের পরিস্থিতি বুঝতে হবে।

বিজ্ঞাপন

ফিলিস্তিনের সমস্যা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের প্রতিষ্ঠার পর শুরু হয়। এর ফলে লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের ভূমি হারায় এবং আজ তারা শরণার্থীর মর্যাদায় জীবন কাটাচ্ছে। সেখানে মানবাধিকারের অবস্থা চরম অবনতি হয়েছে। ফিলিস্তিনিরা নাগরিক সুবিধা, শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে বঞ্চিত।

সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, গাজায় ইসরায়েলি হামলার ফলে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। এই হামলাগুলির মধ্যে অনেক শিশু এবং নারীর মৃত্যু ঘটছে, যা একটি মানবিক সংকটের চিত্র তুলে ধরে। মানবাধিকার সংস্থাগুলির প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, ফিলিস্তিনিরা এমন এক পরিস্থিতির শিকার যেখানে তাদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

অন্যদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ ভিন্ন,বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামের উপজাতিরা দেশের সকল নাগরিক সুবিধা ভোগ করে যা তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করে। ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হয়, যা উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারকাজ পরিচালনা করে। এই পরিষদে উপজাতীয়দের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে, যা তাদের নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে, উপজাতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সুবিধা রয়েছে, যা তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করে এবং শিক্ষার মান উন্নত করে। সরকারি চাকরিতেও তাদের জন্য কোটা ব্যবস্থা রয়েছে, যা তাদের চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি করে এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।

বিজ্ঞাপন

ভূমি মালিকানা অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়েছে, যা তাদের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে।
উপজাতীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা এবং অন্যান্য সামাজিক সেবাও উন্নত করা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এছাড়া, তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ এবং প্রচারের জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় বজায় রাখতে সহায়তা করে।

পার্বত্য চট্টগ্রাম যেন আরেক ফিলিস্তিন এই মন্তব্যটি যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে আমাদের প্রশ্ন করতে হবে—ফিলিস্তিনিদের পরিস্থিতি কি পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের মতো? বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনের পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল এবং মানবিক দিক থেকে ভয়াবহ। ফিলিস্তিনিরা রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে বঞ্চিত, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণ বাংলাদেশের নাগরিক। তাদের অধিকারের সুরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের জাতীয় নীতিমালা আছে।

ফিলিস্তিনের সংকট মূলত আন্তর্জাতিক এবং রাজনৈতিক। সেখানে ধর্মীয় ও জাতীয় পরিচয়ের সমস্যা রয়েছে, যা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। অপর দিকে, পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার উৎস দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অব্যবস্থাপনা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের।

এখন প্রশ্ন হলো, এই সমস্যা সমাধানের জন্য আমাদের কী করতে হবে? সময় এসেছে, আমাদের মানবিক দায়বদ্ধতা গ্রহণ করার। আমরা যদি আমাদের সমাজে শান্তি এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে চাই, তবে কিছু নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশের পার্বত্য সমস্যা সমাধানে প্রথমত, পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি। চুক্তির আওতায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতিশ্রুত বিভিন্ন সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে, যেমন ভূমি মালিকানা, স্থানীয় সরকার পরিষদের ক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প প্রত্যাহার। দ্বিতীয়ত, স্থানীয় জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক উন্নত করতে হবে এবং তাদের অভিযোগ ও সমস্যাগুলো গুরুত্ব সহকারে সমাধান করতে হবে। তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, যাতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী উন্নত জীবনযাপন করতে পারে এবং তাদের মধ্যে সন্ত্রাসী কার্যকলাপের প্রবণতা কমে আসে। সবশেষে, সুশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে, যাতে চাঁদাবাজি ও সশস্ত্র সংঘাত বন্ধ হয় এবং একটি স্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়।

বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রামে ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট) এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (পিসিজেএসএস) মধ্যে বিভক্তি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা পাহাড়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট করছে। এই দুটি সংগঠনের মধ্যে বিভক্তি ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বিভিন্ন কারণে সংঘাত ও সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে।

প্রথমত, অধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ। ইউপিডিএফ এবং পিসিজেএসএস উভয়েই পার্বত্য অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চায়। এই কারণে তারা প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র হামলা চালায়, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করে।

দ্বিতীয়ত, চাঁদাবাজি ও অর্থনৈতিক স্বার্থ। এই দুটি সংগঠনই চাঁদাবাজির মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়, যা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

তৃতীয়ত, রাজনৈতিক ও আদর্শিক বিভেদ। ইউপিডিএফ এবং পিসিজেএসএস-এর মধ্যে রাজনৈতিক ও আদর্শিক মতপার্থক্য রয়েছে। এই মতপার্থক্য তাদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি করে এবং পার্বত্য অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়ায়।

চতুর্থত,সশস্ত্র সংঘর্ষ ও হত্যাকাণ্ড। এই দুটি সংগঠনের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ প্রায়ই ঘটে, যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে। হত্যাকাণ্ড ও পাল্টা হত্যাকাণ্ডের ফলে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে।

এই কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি ও শৃঙ্খলা নষ্ট হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এই সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন একটি সমন্বিত ও কার্যকরী উদ্যোগ, যা সকল পক্ষের মধ্যে আস্থা ও সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে।

সুতরাং, ফিলিস্তিন ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে তুলনা করার সময় আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করতে হবে। এই দুই অঞ্চলের সমস্যার গঠন ও প্রকৃতি আলাদা। শান্তি ও ন্যায়ের পথে চলার জন্য আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, সহানুভূতি, সমঝোতা এবং সহযোগিতার মাধ্যমে কেবল আমরা একটি কল্যাণকর সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

যুক্তরাষ্ট্রের আর্মির হিউম্যান টেরেইন সিস্টেম (HTS) একটি অত্যাধুনিক মডেল যা সামরিক বাহিনীকে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট বুঝতে সহায়তা করে। এই মডেলটি ব্যবহার করে বাংলাদেশ আর্মি পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

প্রথমত, HTS মডেলটি স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ভাষা, এবং সামাজিক কাঠামো সম্পর্কে গভীর জ্ঞান প্রদান করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন আদিবাসী গোষ্ঠী বসবাস করে, যাদের নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা রয়েছে। এই মডেল ব্যবহার করে বাংলাদেশ আর্মি এই জনগোষ্ঠীর সাথে আরও কার্যকরভাবে যোগাযোগ করতে পারবে, যা তাদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হবে।

দ্বিতীয়ত, মডেলটি স্থানীয় অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে সহায়তা করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা রয়েছে, যেমন ভূমি বিরোধ, দারিদ্র্য, এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার অভাব। এই মডেল ব্যবহার করে বাংলাদেশ আর্মি এই সমস্যাগুলি চিহ্নিত করতে এবং সমাধানের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে।

তৃতীয়ত, HTS মডেলটি সামরিক বাহিনীকে স্থানীয় জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে সহায়তা করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সময় সামরিক বাহিনীর সাথে স্থানীয় জনগণের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। মডেলটি ব্যবহার করে বাংলাদেশ আর্মি স্থানীয় জনগণের সাথে সম্পর্ক উন্নত করতে এবং তাদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হতে পারে।

সবশেষে, HTS মডেলটি সামরিক বাহিনীকে স্থানীয় জনগণের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে সহায়তা করে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক সময় সামরিক বাহিনীর সাথে স্থানীয় জনগণের সম্পর্ক উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে ওঠে। HTS মডেল ব্যবহার করে বাংলাদেশ আর্মি স্থানীয় জনগণের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং তাদের আস্থা অর্জনে সহায়ক হতে পারে।

আমাদের উচিত একে অপরের প্রতি সমঝোতা ও সহানুভূতির মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসা, এবং সমাজের সমস্যা সমাধানে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করা।

লেখক: কলামিস্ট

সারাবাংলা/এজেডএস

আসাদুজ্জামান বুলবুল পার্বত্য চট্টগ্রাম বনাম ফিলিস্তিন

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

শরৎ বাংলাদেশের কোমল স্নিগ্ধ এক ঋতু
২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৭:৫৪

সম্পর্কিত খবর