Friday 27 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বিচারকদের বদলি-পদায়নে বৈষম্যহীন নীতি জরুরি

বিশ্বনাথ মন্ডল
২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১৮:৪৭

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়স ৫৩ বছর পেরিয়ে গেলেও জনগণের আজন্ম লালিত একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের স্বপ্ন অপূর্ণই রয়ে গেছে। স্বাধীন বিচার বিভাগই পারে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নকে প্রতিরোধ করতে এবং বিচারপ্রার্থী মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘব করতে। ঐতিহাসিক মাজদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগ থেকে যে ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল সেগুলোর মাত্র কয়েকটি পরিবর্তিত আকারে বাস্তবায়িত হলেও অধিকাংশই অদ্যাবধি বাস্তবায়িত হয়নি। কোন দেশের উন্নয়ন ও কৃতিত্ব পরিমাপ করার সর্বোত্তম মাপকাঠি হচ্ছে তার বিচার বিভাগের দক্ষতা ও যোগ্যতা। রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত স্বাধীন ও স্বকীয় বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের কাঠামোগত সংস্কার আবশ্যক।

বিজ্ঞাপন

মাননীয় প্রধান বিচারপতি আপনি আমাদের অভিভাবক। বিচার ব্যবস্থায় বিদ্যমান সমস্যা সম্পর্কে আপনি সম্যকভাবে অবগত আছেন। আমরা আপনার মূল্যবান দিক নির্দেশনা অনুসরণ করে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যেতে চাই। আমরা প্রস্তুত আরও স্বল্পতম সময়ে মানুষকে ন্যায় বিচার দিতে। আমরা চাই আমাদের বিচারিক সেবা প্রদানের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়োজনীয় কাঠামোগত সংস্কার।

দেশের এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে অন্তবর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছে বিচার রিভাগকেও সেই সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার জন্য আমি চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ পদমর্যাদার বিচারকদের পক্ষ থেকে কিছু দাবি প্রধান বিচারপতি ও আইন উপদেষ্টার সদয় বিবেচনার জন্য উপস্থাপন করছি:

১। জেলা পর্যায়ের বিচারকদের পদায়ন ও বদলির ক্ষেত্রে বৈষম্যহীন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের দাবি জানাই।

২। বিভিন্ন আইনে উল্লেখিত আদালত ও ট্রাইব্যুনালগুলোর জন্য বিচারক ও সহায়ক কর্মচারীর পদসহ পৃথক আদালত সৃজন করতে হবে এবং দেশের জনসংখ্যা ও মামলার সংখ্যানুপাতে বিচারকের সংখ্যা যুক্তিসঙ্গত হারে বৃদ্ধি করতে হবে। বিদ্যমান শূন্য পদে পদোন্নতির মাধ্যমে বিচারক নিয়োগে অপ্রত্যাশিত বিলম্ব পরিহার করতে হবে।

৩। সকল পর্যায়ের বিচারকদের সার্বক্ষণিক নিরাপত্তা সুবিধাসহ পৃথক আবাসন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

৪। জেলা আদালতগুলোতে মামলা পরিচালনায় শৃঙ্খল্য আনয়ন ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রবর্তন করতে হনে এবং বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে উক্ত সরকারি আইন কর্মকর্তাদের নিয়োগের দাবি জানাচ্ছি।

বিজ্ঞাপন

৫। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিচার বিভাগ। দেশের মোট বাজেটে বিচার বিভাগের জন্য বরাদ্দ থাকে মাত্র ০.৩ শতাংশ যা অত্যন্ত অপ্রতুল। বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ এবং প্রতিটি আদালতের বিপরীতে পৃথক বাজেট বরাদ্দের ব্যবস্থা করা সময়ের দাবী।

৬। ফৌজদারী মামলার স্বচ্ছ-নিরপেক্ষ তদন্ত ও কম সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির স্বার্থে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণে বিশেষায়িত তদন্তকারী সংস্থা এবং আদালত প্রাঙ্গণ ও বিচারকদের নিরাপত্তাসহ আদালতের আদেশ কার্যকর করার উদ্দেশ্যে বিচার বিভাগের অধীনে বিশেষ ফোর্স গঠনেরও দাবি জানাচ্ছি।

৭। ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার সহজীকরণ ও জনসাধারণের দোরগোড়ায় বিচারিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলার জন্য পৃথক পৃথক আদালত নিশ্চিত করতে হবে এবং নতুন উপজেলা সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজনীয় সুবিধাসহ একটি করে দেওয়ানি ও ফৌজদারী আদালত স্থাপন করতে হবে।

৮। বিচারকদের কাজের ধরণ ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সকল পর্যায়ের বিজ্ঞ বিচারকদের জন্য পরিবহন সুবিধা নিশ্চিত করার দাবি জানাচ্ছি।

৯। বিচারকদের বেতন বৈষম্য দূরীকরণের জন্য বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ সংক্রান্ত মাজদার হোসেন মামলাটির সূত্রপাত হয়েছিল। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়- বিচারকরা আজও বেতন বৈষম্যের শিকার। মাজদার হোসেন মামলায় আপিল বিভাগ থেকে প্রদত্ত নির্দেশনার আলোকে বিচারকদের মূল বেতনের ১০০ শতাংশ হারে বিচারিক ভাতা প্রদানের দাবি জানাচ্ছি।

১০। বিচারকদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা সংক্রান্ত উচ্চ আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি প্রত্যাশা করি।

১১। শত বছরের পুরাতন আইনগুলো বর্তমান সময়ের নিরিখে সংস্কার করে যুগোপযোগী করতে হবে। আইন সংস্কার ও নতুন আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের সাথে পরামর্শ গ্রহণের ব্যবস্থা রাখা হলে বহু ত্রুটি বিচ্যুতি দূরীভূত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।

অনেক রক্তের বিনিময়ে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুবর্ণ সুযোগ আমরা পেয়েছি তা কোনভাবেই ব্যর্থ হতে পারে না। প্রধান বিচারপতি ও আইন উপদেষ্টার সঠিক দিক নির্দেশনায় আমরা এমন এক বিচার ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখি যেখানে বিচার ব্যবস্থায় জনগণের আশা-আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটবে।

[বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির অভিভাষণ প্রদান অনুষ্ঠানে নওগাঁর চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের বক্তব্য]

লেখক: চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নওগাঁ

সারাবাংলা/এজেডএস

বিচারকদের বদলি-পদায়নে বৈষম্যহীন নীতি প্রণয়ন জরুরি বিশ্বনাথ মন্ডল

বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর