দশম বাজেট, কেমন বাজেট?
৭ জুন ২০১৮ ১৫:৩৩
টানা ১০ বার বাজেট দেওয়ার বিরল এক কৃতিত্ব দেখালেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। তার এই দশ বছরে তিনি বাজেটের আকার বাড়িয়েছেন যা আজ বড় স্বপ্নের জায়গা তৈরি করেছে।
‘সমৃদ্ধ আগামীর পথযাত্রায় বাংলাদেশ’ নামে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। যে অর্থবছরটি চলে যাচ্ছে সেই অর্থবছরের মূল বাজেট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ৩ লাখ ৭১ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগামী বাজেটের আকার সংশোধিত বাজেট থেকে প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা বেশি। বাজেটে ব্যয় মেটাতে সরকারি অনুদানসহ আয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৩৩১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০১ কোটি টাকা। মোট ঘাটতি ১ লাখ ২১ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। সরকারের অর্থায়নে অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থা থেকে ঋণ ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ২২৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে যা আছে ৬০ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটের মোট আকার ধরা হয়েছে ১ লাখ ৭৯ হাজার ৬৬৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত অনুন্নয়ন বাজেটে ব্যয় ধরা হয়েছে ২ লাখ ৮২ হাজার ৪১৫ কোটি টাকা।
মোটা দাগে এটাই এবারের বাজেট। অর্থমন্ত্রীর এই দশ বছরে মানুষের মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গড় সরকারি হিসেবে প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে এবং স্বল্পন্নোত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হয়েছে। কিন্তু সব সূচকের এই ঊর্ধ্বগতির মাঝেই দৃশ্যমান হচ্ছে মানুষে মানুষে বৈষম্য বৃদ্ধি। ধনী আরও ধনী হয়েছে, আর গরিব হয়েছে আরও গরিব।
বড় বাজেট একদিকে বড় প্রত্যাশার জায়গা তৈরি করেছে, তেমনি বড় বাস্তবায়ন ব্যর্থতাও উপহার দিচ্ছে। বাজেট বাস্তবায়নের হার ক্রমেই কমছে। এখন বাজেট বাস্তবায়ন ৭৮-৮০ শতাংশে নেমে এসেছে। বরাবরের মতোই প্রস্তাবিত বাজেটের বড় বাস্তবতা আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য রক্ষা করা। নির্বাচনী বছরে ছাড় বাড়বে বিধায় আয়ের দিকটি কতটা সক্রিয় থাকবে তা দেখার বিষয়। প্রতি বছরই রাজস্ব আদায় তার লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেছ না।
একটি কঠিন সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে এই বছরের বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী। কারণ নির্বাচনী বছর। জনতুষ্টির কথা মাথায় রেখে জুলাই মাস থেকেই নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বড় ধরনের অর্থ ছাড় করতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কে। কারণ বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে আরও বেশি দৃশ্যমান করতে হবে। অন্যদিকে ব্যাংকিং খাতে বড় বড় কেলেংকারির মাঝে দাঁড়িয়ে তিনি বাজেট পেশ করলেন। এমন বাস্তবতার পরও মানুষের পকেট থেকে টাকা নিয়ে সরকারি রুগ্ন ব্যাংকগুলোতে তহবিল দিলেন তিনি।
একাধিকবার চেষ্টা করেও নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে পারেননি অর্থমন্ত্রী। ব্যবসায়ীদের প্রতিরোধ যেমন ছিল, তেমনি অর্থমন্ত্রী এই ক্ষেত্রে সরকার ও তার দল থেকেও প্রত্যাশা মতো সহযোগিতা পাননি। তবুও ভ্যাটকে প্রাধান্য দিয়েই তার রাজস্ব সংগ্রহের পথ ঠিক করলেন।
অর্থমন্ত্রী ৭.৮ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি নির্ধারিত করেছেন। বড় অংকের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য ভালো- তাতে সন্দেহ নেই। অনেকদিন ধরেই এই বড় প্রবৃদ্ধির ঘরে আমাদের বিচরণ। কিন্তু প্রবৃদ্ধির মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। বিদায়ী অর্থবছরে সরকারের দাবি করা ৭.৬৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সাথে একমত নয় বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ। প্রবৃদ্ধি হচ্ছে, অবকাঠামোয় ব্যয় বাড়ছে। কিন্তু কত টাকা ব্যায় করে, কত সময়ে কী পাচ্ছি আমরা সে এক বড় প্রশ্ন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকারও বেশি খরচ করার পর ফলাফল হলো এখন রাজধানী থেকে চট্টগ্রাম যেতে একদিন লেগে যায়। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দুই ঘণ্টার রাস্তা পার হতে ৬ ঘণ্টা লাগে। বড় প্রকল্প পদ্মাসেতুর খরচ ও সময় দু’টিই কেবল বেড়ে চলেছে। তাই বিষয়টা শুধু প্রকল্প করা নয়, প্রকল্পের ফলাফল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রবৃদ্ধি কি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে? না, সেখানেও সুখবর নেই। অনেকেই বলছেন এটা জবলেস গ্রোথ। কৃষি তার সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছেছে। জমি কমছে, তাই গ্রাম পর্যায়ে ছোট ছোট বাণিজ্য গড়ে উঠছে। এগুলো সবই ইতিবাচক। কিন্তু সামগ্রিকভাবে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি নেতিবাচক। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার শুধু বেড়েই চলেছে। আবার যারা শিক্ষিত তাদের শিক্ষার মান এমন এক জায়গায় গেছে যে, দেশীয় বড় কোম্পানিগুলো বড় পদগুলো পূরণ করছে বিদেশি কর্মী দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর এসব বিদেশি কর্মীর বেতন বাবদ প্রায় ৭০০ কোটি ডলার চলে যাচ্ছে বলা হিসাব পাওয়া যাচ্ছে।
আয় ব্যয়ের হিসাব বাদ দিলে, এই বাজেট বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের জন্য কতটা সুসংবাদ থাকবে তা দেখতে হবে। তালিকাভুক্ত আর্থিক করপোরেট কর হার কমেছে। এটুকুই আপাতত স্বস্তি। তবে তৈরি পোশাক খাতের করপোরেট কর হার ৩ শতাংশে। ক্ষুদে চাকরিজীবী ও স্বল্প আয়ের মানুষকে হতাশ করে ছোট ও পুরোনো অ্যাপার্টমেন্টের দাম বাড়ছে বাজেট প্রস্তাবনায়। ডিজিটাল সরকার ই-বাণিজ্যে ভ্যাটও বসিয়েছে।
ব্যাংকের কথা আগেই বলেছি। এ মুহুর্তে ব্যাংক সমূহ এমন নাজুক অবস্থায় আছে যে, ঋণ আবেদনে সাড়া দিতে পারছে না। ফলে ব্যক্তিখাতের ঋণ প্রবাহ কমেছে বড়ভাবেই। ফলে ব্যক্তিখাতে উৎপাদনশীলতা কমবে, কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বেসরকারি খাতের অনেক প্রতিষ্ঠানই প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়বে। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার কী উপায় করবেন অর্থমন্ত্রী তার কোন দিশা দেখা গেল না বাজেটে।
অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের কোনো দিক নির্দেশনা না পাওয়া গেলেও তিনি নিজে শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের কথা বলেছেন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ও স্বাধীন করার কথা বলেছেন। বলেছেন, আগামীতে নজর থাকবে সংস্কার ও প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়নের মাধ্যমে সম্পদ ও সেবায় আপামর জনগণের সহজ সুযোগ রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
লেখক: সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এডিটর-ইন-চিফ, সারাবাংলা ডটনেট