তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল
১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৮:২১
প্রবাসের জীবন যেন এক বিশাল শূন্যতার সমুদ্র। প্রতিদিন ভোরের আলো গড়িয়ে এসে মনে করিয়ে দেয়, আজও দিনটি একইভাবে কাটবে। সেই শূন্যতায় মাঝে মাঝে কিছু সুর ভেসে আসে, মনের গহীনে আঘাত করে। মীরা দেব বর্মনের ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই, বাংলাদেশের ঢোল’ গানটি যেন সেই শূন্যতায় ঢেউ তোলে। প্রবাসী জীবনের ক্লান্ত দৃষ্টিতে এই গান এক অন্য রকম আবেগের সূচনা করে। প্রতিটি ঢোলের শব্দ যেন বাংলার মাটির প্রতি এক অবিচ্ছেদ্য টান।
‘তাকডুম তাকডুম বাজাই’—এই সুর আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ঢোলের প্রতিটি ধ্বনি মাতৃভূমির কাছে ডেকে নিয়ে যায়। ঢোলের শব্দ যখন আমাদের কানে আসে, মনে হয় যেন আমরা আমাদের শিকড়ে ফিরে যাচ্ছি। সেই শিকড়, যেখান থেকে আমাদের অস্তিত্বের জন্ম। ‘বাংলা জনম দিলা আমারে’—এই পংক্তির মধ্যে নিহিত রয়েছে আমাদের জাতিগত পরিচয় এবং আবেগের গভীরতা। আমরা যেখানে থাকি না কেন, আমাদের রক্তে বাঙালির সুর সঞ্চারিত হয়।
এটি সত্যি যে প্রবাস জীবনের অনেক কঠিন বাস্তবতা আমাদের তাড়না করে। কিন্তু যখন এই গানটি বেজে ওঠে, তখন সেই কঠোরতা কিছুটা দুর্বল হয়ে যায়। ‘তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল’—এই বাক্যটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা যতদূরেই থাকি, মা-বাংলার কোলে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে চিরকাল থাকবে।
প্রবাসী জীবন মানেই এক ধরনের বিচ্ছিন্নতা। এখানে এসে অনেক কিছুই আমাদের কাছে নতুন। কিন্তু গানটির ‘বাজে ঢোল নরম গরম তালেতে’ পংক্তি আমাদের মনকে নিয়ে যায় বাংলার উৎসবের আনন্দে। ঢোলের বাজনা যেন আমাদের জীবনের অনেক আনন্দের মুহূর্তকে ফিরিয়ে আনে। আমাদের জীবনযাপন যখন একঘেয়ে হয়ে যায়, তখন এই গান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যারা দূরে আছি, তারা একেবারে বিচ্ছিন্ন নই। ঢোলের এই সুর আমাদেরকে যেন ফিরে নিয়ে যায় আমাদের স্মৃতির রথে।
এখন ভাবি, ‘মা-পুত্রের এ বাঁধন ছাড়ার সাধ্য কারো নাই’—এটি আমাদের মায়ের প্রতি সেই অমোঘ টানকে চিত্রিত করে। আমরা জানি, যে কোনো কিছুতেই আমাদের মা-বাংলার কোলে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অমর। ‘সব ভুলে যাই’—এই পংক্তিটি প্রবাসে আমাদের মনে পড়া গানের প্রতিধ্বনি। তবে, সুরের মাধ্যমে আমরা মনে করি, এই ভুলে যাওয়ার মাঝে মা-বাংলার কোলটি আমাদের মনের আঙ্গিনায় চিরকাল বেঁচে থাকবে।
এই সুর আমাদেরকে সতত স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘বাংলাদেশের ঢোল’—আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক, আমাদের সংস্কৃতির মূল। ঢোলের প্রতিটি তাল যেন সেই বাংলার ছন্দ, যা আমাদের ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করে। ঢোলের সুরে যখন আমরা একত্রিত হই, তখন আমাদের হৃদয়ের গহনে আমাদের মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসার অমলিন স্রোত প্রবাহিত হতে থাকে।
এখন আমাদের জীবনে, যেখানে আমরা প্রবাসে বসবাস করি, সেখানে সুরের সঙ্গে আমাদের পরিচয়ের রূপায়ণ ঘটে। ‘বাজে ঢোল নরম গরম তালেতে’—এই পংক্তির সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়ে ওঠে আরও গভীর। আমরা যখন গানটি শুনি, তখন অনুভব করি, ঢোলের সুরে আমাদের শিকড়ের টান আমাদের মনের মাঝে প্রতিধ্বনিত হয়। সেই সুর যেন আমাদের আবেগের মাঝে ভেসে ওঠে, আমাদের পরিচয়ের প্রমাণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রবাসের কঠিন বাস্তবতার মধ্যে এই সুর আমাদের শিকড়ের দিকে নিয়ে যায়, যেখানে আমরা জীবনের প্রাণ খুঁজে পাই। কিন্তু সেই খুঁজে পাওয়ার প্রক্রিয়া যেন কিছুটা বিষণ্ণ, কিছুটা কষ্টমিশ্রিত। কারণ, এই সুর আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, আমরা আজ দূরে, প্রিয় দেশের বাইরে। আমাদের হৃদয়ে বাঁধা এই সুর যেন আমাদের শিকড়ে ফেরার আহ্বান।
এখন আমরা ভাবি, ‘বিসর্জনের ব্যাথা ভোলায়’—এটি আমাদের সেই হতাশার মুখোমুখি করে। আমরা কখনো কখনো আমাদের প্রিয় দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। আমাদের শিকড় ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, কিন্তু সেই শিকড়ের প্রতি আমাদের ভালোবাসা কখনো মরে না। প্রবাসের জীবনে এই গান যেন আমাদের আত্মাকে পুনরায় জাগ্রত করে। ঢোলের প্রতিধ্বনি যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা কোথাও না কোথাও এই শিকড়ের মধ্যেই জড়িত।
প্রবাসে থাকা আমাদের এক ধরনের প্রতীক হয়ে ওঠে। ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই’—এটি একটি সংগীত, কিন্তু এর মধ্য দিয়ে আমাদের জীবনের কথা প্রতিফলিত হয়। আমরা যারা প্রবাসে আছি, তারা যেন সুরের মধ্যে আমাদের দেশের প্রতি এক অকৃত্রিম ভালোবাসা খুঁজে পাই। ঢোলের প্রতিটি তাল যেন আমাদের হৃদয়ের গভীরে প্রবাহিত হতে থাকে।
‘সব ভুলে যাই’—এটি শুধুমাত্র একটি শব্দ নয়, এটি আমাদের প্রবাস জীবনের অনুভূতি। আমরা অনেক কিছু ভুলতে চাইলেও, আমাদের মাতৃভূমির প্রতি সেই ভালোবাসা, সেই আকাঙ্ক্ষা কখনো ভুলতে পারি না। এই গান আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যেখানেই থাকি, আমাদের হৃদয়ে একটি জ্বলন্ত আশা বিরাজমান।
এভাবে, মীরা দেব বর্মনের ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই’ গানটি আমাদের সত্তার গভীরে প্রবাহিত হতে থাকে। এটি আমাদের প্রবাসী জীবনের অন্যতম প্রেরণা। ঢোলের সুর আমাদের শিকড়ের সাথে চিরদিনের জন্য জুড়ে রাখে, আমাদের মনে করিয়ে দেয়, আমরা যারা দূরে, তারা কোনোদিনই শিকড় থেকে বিচ্ছিন্ন নই, কারণ সেই সুর আমাদের মনের গভীরে অমলিন হয়ে থাকে।
এই গান আমাদের হৃদয়ে এক নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি করে। এটি প্রবাসের গ্লানি, নিঃসঙ্গতা এবং হতাশা ভুলিয়ে দেয়। ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই’—এই সুরের মাঝে আমরা খুঁজে পাই বাঙালির ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মূলভিত্তি। আমাদের মাতৃভূমির প্রতি যে অমোঘ আকর্ষণ, সেটিই এই গানের প্রতিটি শব্দে প্রতিফলিত হয়।
প্রবাসে থাকলেও আমাদের হৃদয়ে ঢোলের সুর ভেসে বেড়ায়। যেন এক গভীর আকাঙ্ক্ষা, যার কোনো শেষ নেই। গানটির মধ্যে মিশে থাকা বিষণ্ণতা প্রবাস জীবনের সেই অপূর্ণতার গল্প বলে, যেখানে স্মৃতি ও বাস্তবতা মিশে যায়, কিন্তু তার পরেও সেই সুর আমাদের বাঁচিয়ে রাখে, স্বপ্ন দেখায়।
এইভাবেই, প্রবাসের জীবনে গানটি আমাদের অনুভূতিকে প্রকাশ করে। ‘বাংলাদেশের ঢোল’—এটি শুধু একটি সংগীত নয়, এটি আমাদের আত্মার পরিচয়। মীরা দেব বর্মনের এই গান শুধুমাত্র এক প্রবাসী বাঙালির হৃদয়ের গভীরে পৌঁছায় না, বরং তা আমাদের শিকড়ের প্রতি ভালোবাসা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।
প্রবাসে দেশের প্রতি আকুতি, শিকড়ের প্রতি টান, এবং মাতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা যেন আমাদের জীবনের মূল ভিত্তি। ‘তাকডুম তাকডুম বাজাই’—এই সুরের মাধ্যমে আমরা আমাদের শিকড়ের প্রতি সম্মান জানাই। আমাদের জীবনের প্রতিটি ধাপের সঙ্গে এই সুরের প্রতিটি শব্দ মিশে থাকে। ঢোলের তালে তালে, আমরা যেন আমাদের পরিচয়ের মূলে ফিরে যাই। প্রবাসের দিনগুলোতে এই গান আমাদেরকে এক ধরনের সান্ত্বনা দেয়, আমাদের মনের গভীরে বাংলার স্রোতধারা বয়ে আনে।
লেখক: যুক্তরাজ্য প্রবাসী, ছোটকাগজ ‘শব্দপাঠ’ সম্পাদক
সারাবাংলা/এসবিডিই