Monday 04 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে এর প্রয়োগযোগ্যতা

ড. মতিউর রহমান
৪ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪১

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা প্রাচীন দর্শনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সুপরিচিত দৃষ্টিভঙ্গি। এটি একটি এমন রাষ্ট্রের কল্পনা, যেখানে ন্যায়, সুশাসন এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানকে মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্লেটো বিশ্বাস করতেন যে সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তি ও শ্রেণি তাদের নির্ধারিত দায়িত্ব পালন করলে রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা সম্ভব। তার মতে, শাসকের গুণাবলির মধ্যে জ্ঞান ও নৈতিকতা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এবং তাই শাসক হিসেবে জ্ঞানী ও সুশিক্ষিত ব্যক্তি থাকা উচিত, যাকে তিনি “দার্শনিক রাজা” বলে উল্লেখ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে সুশাসন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন শ্রেণিবিন্যাসের ওপর জোর দেওয়া হয়। এই রাষ্ট্রে শাসক, সৈনিক ও উৎপাদক – এই তিন শ্রেণি তাদের নিজ নিজ ভূমিকা পালন করে থাকে। শাসক শ্রেণি সিদ্ধান্ত নেয় এবং রাষ্ট্রের নীতিমালা প্রণয়ন করে, সৈনিক শ্রেণি দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, এবং উৎপাদক শ্রেণি অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে। এই শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে প্লেটো রাষ্ট্রে ভারসাম্য ও সুস্থিরতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা হল একটি এমন সমাজ ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রের প্রতিটি শ্রেণি তাদের নির্ধারিত ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করে এবং সমাজের প্রতিটি অংশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্লেটোর মতে, এই আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য একটি নির্দিষ্ট শ্রেণিবিন্যাস প্রয়োজন, যেখানে শাসক, সৈনিক, এবং উৎপাদক শ্রেণি সমাজের ভারসাম্য বজায় রাখে।

প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার হল প্রতিটি ব্যক্তি ও শ্রেণির তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা। শাসক, সৈনিক, এবং উৎপাদক শ্রেণির মধ্যে যে নির্দিষ্ট দায়িত্ববন্টন রয়েছে, তা পালন করলে সামাজিক ভারসাম্য এবং শান্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। এই দৃষ্টিভঙ্গিতে, শাসকের উচিত রাষ্ট্র পরিচালনা করা, সৈনিকের উচিত নিরাপত্তা রক্ষা করা এবং উৎপাদক শ্রেণির উচিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া। প্রতিটি শ্রেণির মধ্যে এই দায়িত্ববোধ এবং দায়িত্বের সঠিক বণ্টনই সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ভিত্তি।

আদর্শ রাষ্ট্রে তিনটি প্রধান শ্রেণির কথা উল্লেখ করেছেন প্লেটো: শাসক, সৈনিক, এবং উৎপাদক। শাসক শ্রেণি রাষ্ট্র পরিচালনার নীতিমালা তৈরি করে এবং দার্শনিক শাসক বা জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে এই শ্রেণির মানুষ রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত নেয়। সৈনিক শ্রেণি রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং যুদ্ধের পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষার দায়িত্ব পালন করে। উৎপাদক শ্রেণি কৃষক, শিল্পী, এবং বণিকদের নিয়ে গঠিত, যারা মূলত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। এই শ্রেণিবিন্যাসের মাধ্যমে প্লেটো সমাজে ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।

প্লেটো মনে করতেন, আদর্শ রাষ্ট্রে শাসক হিসেবে দার্শনিক রাজা থাকা উচিত, যিনি জ্ঞানী, সুশিক্ষিত এবং নৈতিক গুণাবলিসম্পন্ন। দার্শনিক রাজা বা দর্শন শাসক এমন এক ব্যক্তি, যার নৈতিক জ্ঞান এবং ন্যায়বিচারের প্রতি গভীর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এই ধরনের শাসক, নিজের এবং জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করবে এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে প্রভাবিত হবে না। প্লেটোর দৃষ্টিতে, রাষ্ট্রের নেতৃত্ব প্রদানকারী ব্যক্তি যদি জ্ঞানী এবং ন্যায়পরায়ণ হয়, তবে সমাজে সত্যিকারের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।

প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তার মতে, শিক্ষা হল আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের মূখ্য মাধ্যম, যা ব্যক্তির নৈতিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলি বিকাশে সহায়ক। প্লেটোর শিক্ষা ব্যবস্থায় নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক শিক্ষার মাধ্যমে শাসক এবং সৈনিক শ্রেণির মানুষদের আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়। এই শিক্ষা ব্যক্তিগত এবং সামাজিক ন্যায়বোধের বিকাশ ঘটায়, যা রাষ্ট্র পরিচালনায় সহায়ক।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে সমানাধিকারের কথা বলা হয়েছে। তার মতে, নারীরা পুরুষদের মতোই শিক্ষালাভ এবং কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সুযোগ পাবে। দার্শনিক শাসক থেকে সৈনিক পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে নারীদের অধিকার এবং যোগ্যতার ভিত্তিতে স্থান দেওয়ার কথা বলেন প্লেটো। পরিবার প্রসঙ্গে, তিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি ও পারিবারিক বন্ধন কমিয়ে রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা বাড়ানোর কথা উল্লেখ করেছেন। তার দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে, রাষ্ট্রের সেবাই সর্বোচ্চ দায়িত্ব হওয়া উচিত, যা একে একটি সমন্বিত, শক্তিশালী ও সংহত সমাজে পরিণত করবে।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা প্রাচীন হলেও এর বিভিন্ন দিক বাংলাদেশের বর্তমান রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্রে নৈতিক ও জ্ঞানসম্পন্ন শাসক, শ্রেণি ভিত্তিক সমাজ কাঠামো, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা, এবং নারী ও পরিবারের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় এই ধারণার প্রয়োগযোগ্যতা নিয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে কিছু ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জ থাকলেও উন্নয়নের জন্য উপকারী হতে পারে।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রে দার্শনিক রাজা বা জ্ঞানী শাসকের প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়েছে, যিনি ন্যায়বোধ ও জ্ঞানসম্পন্ন এবং নৈতিক মূল্যবোধে দৃঢ়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ ধরনের নেতৃত্ব গড়ে তোলা একটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে। রাজনৈতিক অঙ্গনে সুশিক্ষিত ও নৈতিক নেতৃত্বের অভাব এবং ক্ষমতা অর্জনে স্বার্থপরতা ও প্রতিযোগিতার কারণে আদর্শ নেতৃত্ব গঠনের পথে অনেক বাধা দেখা যায়। যদিও কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষিত এবং বিবেকবান নেতা দেখা যায়, তবে তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং রাজনৈতিক শিক্ষায় মনোযোগ বাড়ানো এ ক্ষেত্রে প্রয়োজন।

প্লেটো তার আদর্শ রাষ্ট্রে শ্রেণি ভিত্তিক সমাজ কাঠামোর কথা বলেছেন, যেখানে শাসক, সৈনিক, এবং উৎপাদক শ্রেণি আছে। বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে এই শ্রেণিবিন্যাস পুরোপুরি বাস্তবায়নযোগ্য না হলেও, কিছু অংশে এর প্রয়োগ সম্ভাব্য। উদাহরণস্বরূপ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, নিরাপত্তা বাহিনী এবং সাধারণ জনগণ—এই তিনটি শ্রেণি এ দেশের সমাজে দেখা যায়। তবে প্লেটোর মতো কঠোর শ্রেণিবিন্যাস প্রয়োগ করা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই চ্যালেঞ্জিং এবং অপ্রয়োজনীয় হতে পারে। বরং দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে দক্ষতা ও সুশাসনের ওপর জোর দিয়ে শ্রেণিবিন্যাসের ধারণাটি অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।

প্লেটোর মতে, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রতিটি শ্রেণির নিজ নিজ দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হলেও, ন্যায়বিচার এখনো পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, এবং প্রশাসনিক দুর্বলতার কারণে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবু সুশাসনের জন্য স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, এবং সঠিক দায়িত্ববণ্টনের ওপর জোর দিয়ে প্লেটোর ন্যায়বিচারের ধারণা প্রয়োগযোগ্য হতে পারে।

প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্রে শিক্ষার লক্ষ্য হলো নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক গুণাবলির বিকাশ। বাংলাদেশে শিক্ষানীতিতে একাধিক সংস্কার আনা হয়েছে, তবে এখনো নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধে শিক্ষার্থীদের গড়ে তোলার বিষয়টি পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। নৈতিক এবং দক্ষ নেতৃত্ব তৈরির জন্য শিক্ষানীতিতে আরও পরিবর্তন প্রয়োজন। প্লেটোর শিক্ষাদর্শ অনুসারে নৈতিক মূল্যবোধ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশকে গুরুত্ব দিয়ে শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন করলে দেশের সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে।

প্লেটো নারীর সমানাধিকার এবং কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের কথা বলেছেন, যা বর্তমান বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের উন্নতি সত্ত্বেও সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানা বাধা এখনো নারীদের পথ রুদ্ধ করে। তবে প্লেটোর দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নারীদের সমানাধিকার এবং ক্ষমতায়নের চর্চা আরও সুদৃঢ় করার জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরে সমর্থন জরুরি। পরিবারের প্রতি দায়িত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করে নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে আদর্শ রাষ্ট্রের এই ধারণা বাস্তবায়িত হতে পারে।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের বিভিন্ন ধারণা বাংলাদেশের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক কাঠামোতে বিভিন্ন রূপে প্রাসঙ্গিক হলেও এর পূর্ণ বাস্তবায়ন চ্যালেঞ্জিং। তবে ন্যায়, সুশাসন, এবং শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে এবং নারীর ক্ষমতায়নের দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাটি ধারণাগতভাবে যথেষ্ট প্রগতিশীল হলেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবায়ন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ এবং সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে পারে। দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো আদর্শ রাষ্ট্রের এ ধারণার সঠিক প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক পরিবেশ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করে। আদর্শ রাষ্ট্রের জন্য দরকার কঠোর নৈতিক ও মূল্যবোধসম্পন্ন নেতৃত্ব এবং সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা, যা বিদ্যমান পরিস্থিতিতে অর্জন করা বেশ কষ্টসাধ্য। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা এবং স্বার্থপরতা প্লেটোর নৈতিক নেতৃত্বের ধারণার পরিপন্থী। এছাড়া, সামাজিক বৈষম্য, শ্রেণিসংঘাত, এবং বিভিন্ন ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বাধাও এই ধারণা বাস্তবায়নের পথে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দেয়।

প্লেটোর মতে, আদর্শ রাষ্ট্রে শাসক হতে হবে জ্ঞানী ও সুশিক্ষিত দর্শন শাসক বা দার্শনিক রাজা, যিনি নৈতিকতা ও প্রজ্ঞায় সমৃদ্ধ। তবে আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতা জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে চলে আসে, যা দর্শন শাসক বা দার্শনিক রাজার ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জনগণের চাহিদা, আকাঙ্ক্ষা এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণেই নেতৃত্বের গুণাবলিতে ব্যক্তিগত নৈতিকতা এবং প্রজ্ঞার পরিবর্তে রাজনৈতিক কৌশল ও জনমত প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। এছাড়া, একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় দার্শনিক শাসক ধারণা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের বাধা ও প্রথাগত নির্বাচনী পদ্ধতি একটি বড় সীমাবদ্ধতা হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক অস্থিরতা আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণার বাস্তবায়নে একটি বড় প্রতিবন্ধক। ঘন ঘন রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতা দেশের স্থিতিশীলতাকে নষ্ট করে এবং ন্যায়বিচার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে। সামাজিক অস্থিরতা, যেমন ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত, শ্রেণি বৈষম্য এবং আর্থিক অসমতা আদর্শ রাষ্ট্রের নীতিগুলোর সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ।

সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের জন্য দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রয়োজন, যা আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণার পথে একটি বড় সীমাবদ্ধতা হিসেবে দেখা যায়। এই সীমাবদ্ধতাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রচলিত অপ্রাসঙ্গিক এবং অযাচিত প্রভাব, যা ন্যায় ও সুশাসনের প্রতিষ্ঠায় বাঁধা সৃষ্টি করে। তাই, প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা প্রয়োগে সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করতে প্রয়োজন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নের জন্য নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও কিছু সম্ভাব্য সমাধান এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। দেশের রাজনীতি ও সমাজব্যবস্থায় নৈতিক শিক্ষা এবং যোগ্য নেতৃত্বের বিকাশে এসব পদক্ষেপ সহায়ক হতে পারে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সচেতনতা বৃদ্ধি এবং শিক্ষিত নেতৃত্ব তৈরি করার মাধ্যমে আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাকে বাস্তবায়নের পথে এগোনো সম্ভব।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্লেটোর দার্শনিক শাসকের আদর্শ অনুসারে নৈতিক ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতৃত্ব তৈরির জন্য শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নৈতিক শিক্ষা, সমাজবিজ্ঞান, এবং নেতৃত্ব বিকাশমূলক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম নৈতিকতা, সততা এবং জনকল্যাণে উৎসাহিত হয়। শিক্ষার মাধ্যমে নৈতিকতা ও প্রজ্ঞার বিকাশ ঘটলে ভবিষ্যতে যোগ্য নেতাদের নেতৃত্বে আদর্শ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।

জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে যাতে তারা তাদের নাগরিক অধিকার সম্পর্কে জানে এবং সুশাসনের জন্য দাবিদার হয়ে ওঠে। গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনসম্পৃক্ততা বাড়ানো যেতে পারে। এর মাধ্যমে জনগণ কেবল সঠিক নেতৃত্বকে বেছে নিতেই উৎসাহিত হবে না, বরং নেতৃত্বের প্রতি তাদের জবাবদিহিতাও বৃদ্ধি পাবে। এতে সুশাসনের প্রতিষ্ঠা সহজ হবে এবং আদর্শ রাষ্ট্রের লক্ষ্যে এগোনো সম্ভব হবে।

রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্লেটোর দার্শনিক শাসকের আদর্শ অনুসারে জ্ঞান, নৈতিকতা ও প্রজ্ঞার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলেও সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও নৈতিক নেতৃত্ব উন্নয়নে প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা, যেখানে তারা সমাজের সেবা ও কল্যাণে উৎসাহী হয়ে উঠবে। এছাড়া, তরুণদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলি ও জনকল্যাণমুখী চিন্তাধারার বিকাশ ঘটানোর উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে, যা ভবিষ্যতে একজন দার্শনিক শাসক তৈরিতে সহায়ক হতে পারে।

এসব উদ্যোগের মাধ্যমে প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণার কিছু মৌলিক নীতিকে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে আংশিকভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে সুশাসন এবং নৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা সম্ভব।

প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণা একটি অনন্য রাজনৈতিক দর্শন, যা ন্যায়, সুশাসন এবং সামাজিক ভারসাম্যের প্রতিষ্ঠায় গুরুত্ব দেয়। তার অনুসারে, একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠন করতে হলে সমাজের প্রত্যেক শ্রেণিরই নিজস্ব দায়িত্ব পালনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্লেটোর এই দৃষ্টিভঙ্গি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, যেখানে বর্তমান রাজনৈতিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার জন্য নৈতিক নেতৃত্ব ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্লেটোর দর্শন থেকে আমরা শিখতে পারি যে, কেবলমাত্র রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন নয়, বরং একটি নৈতিক ও জ্ঞানী নেতৃত্ব তৈরির মাধ্যমেই আমরা আদর্শ রাষ্ট্রের দিকে এগিয়ে যেতে পারি। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন এনে নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির উন্নয়ন করা হলে, বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানে এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে সহায়তা করবে।

সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে ন্যায়, সুশাসন, এবং সামাজিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত জোরালো। প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের ধারণাকে সামনে রেখে যদি আমরা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোকে পুনর্বিন্যাস করতে পারি, তবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ, এবং ন্যায়পরায়ণ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হবে। সুতরাং, প্লেটোর দর্শনের প্রতি আমাদের সচেতনতা ও প্রয়োগের প্রচেষ্টা একটি সুস্থ ও সুশাসিত সমাজ গঠনে অপরিহার্য।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এসবিডিই

ড. মতিউর রহমান প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে এর প্রয়োগযোগ্যতা মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর