মুক্তিসংগ্রামের মহানায়ক মওলানা ভাসানী
১৭ নভেম্বর ২০২৪ ১৩:৩৬
উপমহাদেশ তথা বাংলার কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আজীবন গ্রাম-গঞ্জের সাধারন খেটে খাওয়া মানুষের নয়নমনি মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সারা জীবনই যার সংগ্রাম ছিল মেহনতির মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে। আজ ১৭ নভেম্বর মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর ৪৮তম মৃত্যুবার্ষিকী। ১৮৮০ সালে তৎকালীন পাবনার সিরাজগঞ্জের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেয়া মওলানা ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর চলে গেছেন না ফেরার দেশে। পিতা হাজি শরাফত আলী খান ছিলেন সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি।
অনেক নেতাদের নেতা মওলানা ভাসানী তথাকথিত প্রথাগত শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না, তিনি উচ্চতর ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। আধ্যাত্বিক শিক্ষায় তার অন্তর ছির পরিপূর্ণ। ভারতের ইসলামী শিক্ষার প্রাণকেন্দ্র দেওবন্দ মাদরাসার ছাত্র হয়েও তিনি ছিলেন মুক্তিকামী মানুষের নেতা। ব্রিটিশ উপনিবেশবাদবিরোধী প্রগতিশীল ধারার রাজনীতির ধারণ করে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সময়ের অগ্রগতির সাথে সাথে মওলানা ভাসানী সর্বভারতীয় রাজনীতি, জাতীয় কংগ্রেস দল, খিলাফত আন্দোলন এবং মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আন্দোলনেরও নেতাতে পরিনত হন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়েই শেষ করেননি তিনি, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর শাসকশ্রেনীর হাত থেকে গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছেন আওয়ামী মুসলীম লীগ যার পরবর্তী রুপ হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা্র মাত্র এক দশকেরও কম সময়ের মধ্যেই তিনি পাকিস্তানের একটি বিশেষ গোষ্ঠী ও শ্রেনীর রাজনীতি এবং শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রথমে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং তার কিছুদিন পরই পূর্ব বাংলার পূর্ণ সার্বভৌমত্ব দাবি করে এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নের বীজ বপিত করেছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্ব প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তানের ব্যর্থ শাসকগোষ্ঠী মুলিম লীগের পরাজয় ঘটিয়েছিলেন। আবার সেই যুক্তফ্রন্টের সরকারের বিরুদ্ধেও পূর্ব বাংলার জনগনের অধিকারের প্রশ্নে বিদ্রোহ করেছিলেন। আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে গঠন করেছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া এক প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ নিহত হলেও পাকিস্তান সরকার তাদের দেখতে না আসলে তিনি তার প্রতিবাদ জানান। স্বাধীনতা ছাড়া বাংলার মানুষের মুক্তি নাই। ভোটের বাক্সে লাথি মার, পূর্ব বাংলা স্বাধীন কর। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন বর্জন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। পাকিস্তানের অপশাসন ও শোষণ থেকে মুক্তির লক্ষ্যে তিনি বেছে নিয়েছিলেন স্বাধীনতার পথ।
৭০’র ঘূর্ণিদূর্গত বিধ্বস্ত দক্ষিণাঞ্চল ঘুরে এসে ভাসানী পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করলেন আবেগাপ্লুত হয়ে। তার বর্ণনা শুনে সভায় উপস্থিত সাহসী কবি ও সাংবাদিক সাংবাদিক শামসুর রাহমান লিখেছিলেন ‘সফেদ পাঞ্জাবী’ কবিতা। মওলানা ভাসানী নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। কিন্তু কেন বর্জন করলেন তা কখনও কেউ বলতে চায় না। তবে বিরুদ্ধে প্রচারের জন্য ‘ভোটের আগে ভাত চাই, নইলে এবার রক্ষা নেই’ স্লোগানের কথা বলেন অনেকেই।
সত্য তো বলেনই না বরং এক শ্রেনীর দালাল ও সুবিধাবাদী তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা অনেক সময় মওলানা ভাসানীকে ‘জনগণবিরোধী’ প্রমাণের জন্যই চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু, সত্যটা হলো, সামরিক শাসনের অবসান ঘটানোর বৃহত্তর স্বার্থে মওলানা ভাসানী চেয়েছিলেন ‘শেখ মুজিবুর রহমান’ নির্বাচনে পূর্ণ বিজয় লাভ করুক। অথচ এই সত্যটা বিরুদ্ধ প্রচারকারীরা স্বাভাবিক কারণেই চেপে যায়।
এ কথা দিবালোকের মত সত্য যে, মওলানা ভাসানীই পূর্ববঙ্গে মুসলিম লীগ রাজনীতির বিপরীতে প্রথম বিরোধিতা করে নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দিয়েছিলেন যার নাম পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ। এই কৃতিত্বময় নেতৃত্ব মওলানা ভাসানীর, এটা ইতিহাসের নির্মোহ সত্য, ইতিহাস তাই সাক্ষ্য দেয়। অথচ কেউ কেউ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে এই কৃতিত্ব দেবার চেষ্টা করেন। যারা এই চেষ্টা করেন তারা ভুলে যান ইতিহাস ও সময় সাক্ষ্য দেয়, আওয়ামী মুসলিম লীগ যখন গঠন হয় তখন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন করাচীতে ‘নেহরু হাউস’-এ বসবাস করছিলেন এবং তিনি গঠন করেছিলেন ‘জিন্না মুসলিম লীগ’।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে বিরোধী দলের যে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়, সেখানেই ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠিত হয় এবং মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন।
এখানে ইতিহাস বলে, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কমিটির তালিকা যখন করা হচ্ছিল তখন মওলানা ভাসানীর আদরের ‘মুজিবুর’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবি-দাওয়া নিয়ে সংগ্রাম করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে জেলে ছিলেন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টাঙ্গাইলের শামসুল হকের নাম লেখার পর যুগ্ম সম্পাদক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম লেখেন।
সে যাই হোক ১৯৭০ এর নির্বাচন মওলানা ভাসানী বর্জন করলেন যার ফলশ্রুতিতে সে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। কিন্তু, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ট দলকে ক্ষমতা হস্তান্তর করল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছিল। প্রতিবাদে মওলানা ভাসানী তার প্রিয় উত্তরসূরি বঙ্গবন্ধুর গণ-আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন।
২৫ মার্চের কালরাতে ঢাকাসহ পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল জায়গায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নৃশংস হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল। মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তখন মওলানা ভাসানী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এবং বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তখন মওলানা ভাসানী ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সমন্বয় কমিটির সভাপতি। নেতৃত্বের প্রশ্নে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী কখনও বঙ্গবন্ধুর প্রতিপক্ষের ভূমিকা গ্রহন করেন নাই। এটা দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, বঙ্গবন্ধুর জীবনে রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিকশিত হয়েছিল মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর স্নেহের ছায়ায়।
তার সুদীর্ঘ জীবনকালের সাম্রাজ্যবাদ সামন্তবাদ ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী ভূমিকা জীবন সায়াহ্নের কিছু ভূমিকা কারও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। এদেশের রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদকে চিনিয়েছেন মওলানা ভাসানী। সাম্প্রদায়িকতার আপসহীন ভূমিকা পালন করেন মওলানা ভাসানী, সমাজতন্ত্রকে এদেশের তরুণ সমাজের মধ্যে জনপ্রিয় করেছিলেন মওলানা ভাসানী।
মওলানা তার রাজনীতির জীবন শুরু করেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের আহ্বানে ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন দিয়ে। ব্রিটিশদের কারাগারে দশ মাস কাটিয়েছেন রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই। কংগ্রেসে বেশ কিছুকাল যুক্ত থাকলেও এক সময়ে কংগ্রেসই তাকে ছেড়ে যায়, তার বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রধান রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব ছিল জমিদার শ্রেণীর হাতে। জমিদারদের বড় অংশ সম্প্রদায়গতভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সাধারণ কৃষকরা তাদের হাতে নির্যাতিত হতেন। ভাসানী এই সাধারণ কৃষকের পক্ষে একের পর এক কর্মসূচি দেওয়ার কারণে কংগ্রেসের সঙ্গে তার স্থায়ী ছাড়াছাড়ি ঘটল ১৯৩৭ সালে। বহু জমিদার তাদের এলাকায় ভাসানীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেয়ার চেষ্টা চালায়। এরপর ভাসানী যোগ দেন মুসলিম লীগে।
সাধারণ কৃষকের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে যেমন কংগ্রেস ত্যাগ করেছেন, তেমনি আমলা-সামরিকতন্ত্র-জোতদারতন্ত্র আর বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের জাতিগত শোষণের বিরোধিতা করতে গিয়ে তিনি অনায়াসে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেছিলেন আওয়ামী লীগ গড়ে তুলতে। এই আওয়ামী লীগকে যখন কৃষকের স্বার্থরক্ষায় অগ্রণী মনে হয়নি, এবং সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে দলটিকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্বব্যবস্থার পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নে যখন তৎপর দেখা গেল, নিজের হাতে গড়া আওয়ামী লীগও ত্যাগ করে তিনি গড়লেন নতুন রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- ন্যাপ।
‘মজলুম জননেতা’ হিসেবে পরিচিত মওলানা ভাসানীকে প্রথাগত ক্ষমতার রাজনীতি কোনও দিনই আকর্ষণ করে নাই। তিনি গ্রাম-গঞ্জের কৃষককুল কিংবা শহর-নগরের ব্যাপক শ্রমিক শ্রেণি ও অন্যান্য মেহনতি মানুষের অর্থনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য এ দেশের প্রেক্ষাপটে অনেক পথের সন্ধান করেছেন। ‘কৃষক-শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের রাজ’ প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। বস্তুবাদী রাজনৈতিক জগতে আধ্যাত্মিকতার সমন্বয় ঘটাতে চেয়েছেন। সে কারণে জীবনের শেষ দিকে ইসলামী সমাজতন্ত্রের রূপরেখা প্রণয়নে অত্যন্ত তৎপর হয়ে উঠেছিলেন।
সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন আপসহীন। আফ্রো-এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার কোটি কোটি মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে সোচ্চার ছিলেন মওলানা ভাসানী। সে কারণে জনগন তাকে আফ্রো-এশিয়া, লাতিন আমেরিকার শোষিত, নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষের নেতা বলেই মনে করে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন মওলানা ভাসানীর রাজনীতি ছিল তার সমকালীন যুগের তুলনায় খুব বেশী অগ্রসর। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ববাংলার গণমানুষের ভাগ্যের কোনও পরিবর্তন ঘটবে না বলেই দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন তিনি। আর সেই কারণেই তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাজপথে গণ-অসন্তোষ প্রকাশ এবং সর্বোপরি গণ-অভ্যুত্থানের পথ। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে ৫৪’র যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন কিংবা বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ এবং পাকিস্তানের স্বৈরশাসক আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ৬৯’র গণ-অভ্যুত্থানে মওলানা ভাসানীর অগ্নিগর্ভ আন্দোলনের স্বরূপ প্রত্যক্ষ করেছিল বিশ্ববাসী।
আর সে কারণে ১৯৬৯’র গণ-আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তাদের কভারে (প্রচ্ছদে) মওলানা ভাসানীকে তুলে ধরেছিল ‘প্রফেট অব ভায়োলেন্স’ (প্রচণ্ড বিক্ষোভ কিংবা সহিংসতার নবী) হিসেবে। আর ২০০৪ সালে অর্থাৎ তার মৃত্যুর বহু পরে তাকে সর্বকালের অষ্টম শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে বিবিসি।
উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মওলানা ভাসানীকে চিত্রিত করেছে উপমহাদেশের রাজনৈতিক বিক্ষোভ ও বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের অগ্নিপুরুষ হিসেবে। আবার কোন কোন বিশ্লেষকগন তাকে আখ্যায়িত করেছেন একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিক হিসেবে। ব্রিটিশ শাসনামলে আসামে বাঙালিদের অধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসন ও উপনিবেশবাদ, সামন্তবাদ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী হয়ে উঠেন আন্দোলনের প্রতীক। জীবনের প্রায় অর্ধেক সময় তিনি ভারতে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি ফ্যাসিবাদী সরকারের বন্দিশালায় কাটিয়েছেন। কিন্তু কখনওই গণমাণুষের এই ‘মজলুম জননেতা’ মেহনতি ও ভুখা-নাঙা মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে কারও সঙ্গে আপস করেননি।
এ বাংলার স্বাধীনতা ছিল মওলানা ভাসানীর আজন্ম লালিত স্বপ্ন। তাই মওলানা ভাসানীর বুকে একটি স্থায়ী আসন গড়ে নিয়েছিলেন সংগ্রামী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে যখনই জনতার এই দুই অবিসংবাদিত নেতা মিলিত হয়েছেন, তখনই দেখা গেছে বঙ্গবন্ধুকে তার পিতৃতুল্য এই বর্ষীয়ান নেতাকে জড়িয়ে ধরে তার বুকে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মাথা রেখেছেন। যা ছিল এক বিরল দৃশ্য।
মওলানা ভাসানী প্রায়ই এবং জীবনে শেষ প্রান্তে কখনও কখনও প্রকাশ্য সভায় নির্দ্বিধায় বলতেন, পাকিস্তান ও পরবর্তী সময়ে তার আধাডজন সেক্রেটারির মধ্যে (দলের সাধারণ সম্পাদক) শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সবচেয়ে যোগ্য ও কর্মক্ষম, মাঠপর্যায়ে জনগণের সাথে যার সম্পর্ক ছিল। বঙ্গবন্ধু তার জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও এ প্রবীণ নেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন এবং তার দেখাশোনার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য একটা সুবিধাবাদী গোষ্ঠী সকল সময়ই মওলানা ভাসানীকে একান্তভাবেই তাদের নিজস্ব সম্পদ হিসাবে কুক্ষিগত করে রাখার চেষ্টা করতেন। নানা সুবিধাবাদি গোষ্ঠী মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে অনেকভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছে তার জীবনসায়াহ্নে এমনকি তার মৃত্যুর পরও। যার ফলশ্রুততে এ মহান নেতার সঠিক মূল্যায়ন হয়নি কখনও। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী মত একজন জাতীয় নেতার জন্ম কিংবা মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয় না জাতীয়ভাবে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক ও লজ্জাজনক।
মওলানা আজকের বাংলাদেশে কতখানি প্রাসঙ্গিক? নূরুল কবীরের লেখা ‘রেড মাওলানা’ কিংবা সৈয়দ আবুল মকসুদ তার লেখা ‘ভাসানীর জীবনী’তে তাকে অমর করে রেখেছেন, এছাড়া আছে সৈয়দ ইরফানুল বারীর অনেকগুলো গ্রন্থ। তার পরও বলা যায়, মওলানার জীবনের বহুক্ষেত্র আজও অনালোচিত, অনালোকিত। মওলানার বিবৃতি ও বক্তৃতার সংকলনে কিংবা তার চীন ভ্রমণের স্মৃতিচারণে রাষ্ট্রনীতি ও অর্থনীতি বিষয়ে তার যে গভীর দার্শনিক বোধের সাক্ষাত মেলে, তা নিয়ে যথেষ্ট চর্চা আমাদের দেশে নেই, কিংবা বলা যায় উলটো ম্রিয়মান হয়েছে। কৃষকের মুক্তির যে কর্মসূচি মওলানা দিয়েছিলেন, তা এখনকার অর্থনীতির চিন্তায় খুবই অনুপস্থিত, অথচ এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আজও কৃষক। জাতীয় মুক্তির রাজনীতি তিনি করেছেন, কিন্তু কখনওই উগ্র জাতীয়তাবাদের খপ্পরে পড়েননি। বরং আন্তর্জাতিকতা আর বিশ্বমানবতাবোধই তার মাঝে প্রবল। ভাসানীর এই রাজনীতিই তাকে সমকালীন আফ্রো-এশীয়-লাতিন আমেরিকান রাজনীতিতে অন্যতম ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। এদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক সংগ্রামেও মওলানা ভাসানী প্রেরণা হিসেবে থেকেছেন।
মওলানা ভাসানী বেঁচে থাকবেন অনাদিকালজুড়ে। এই দেশ ও এই জাতি যত দিন টিকে থাকবে, মওলানা ভাসানীকে কেউ অবহেলা কিংবা অবজ্ঞা করতে পারবে না। তার সংগ্রামী আদর্শের কোন মৃত্যু নাই। ইতিহাসই তার সঠিক মূল্যায়ন করবে, তাতে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। মাওলানা ভাসানী চিরকাল সংগ্রামের প্রেরণা হিসেবে থাকবেন। বিপ্লবী রাজনীতির সাথে গণমানুষের দূরত্ব ঘুচিয়ে, একইসাথে প্রবলভাবে দেশীয় চরিত্রের কিন্তু আন্তর্জাতিকতা বোধের সংগ্রামের দিশা তিনি দিয়ে গিয়েছেন। প্রয়াণ দিবসে লাল মাওলানার প্রতি সশ্রদ্ধ অভিবাদন। ভাসানী স্মৃতি অমর হোক। যুগ যুগ জিও, মওলানা ভাসানী।
লেখক : রাজনীতিক ও কলামিস্ট ; মহাসচিব, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি- বাংলাদেশ ন্যাপ ও আহ্বায়ক, জাতীয় কৃষক-শ্রমিক মুক্তি আন্দোলন
সারাবাংলা/এসবিডিই
আবদুল হামিদ খান ভাসানী এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি মওলানা ভাসানী মজলুম জননেতা মুক্তিযুদ্ধে মওলানা ভাসানী