Monday 18 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

৫৯ বছরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়: অর্জন, সংকট ও প্রত্যাশা

ইমরান ইমন
১৮ নভেম্বর ২০২৪ ২০:১০

পাহাড় ও বন মিলিয়ে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: সংগৃহীত

৫৮ পেরিয়ে ৫৯ বছরে পদার্পণ করলো অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। দেশের তৃতীয় এবং চারটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করা এই বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়। যা ২৩০০ একরের বৃহৎ পাহাড়ী ও সমতল ভূমিবেষ্টিত।

প্রতিষ্ঠাকালীন বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি—এ চারটি বিভাগ, ৭ জন শিক্ষক ও ২০০ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে ১০টি অনুষদ, ৪৮টি বিভাগ, ৬টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। অধ্যয়ন করছে প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী, রয়েছে ৯২০ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে মোট ১৩ টি আবাসিক হল (ছেলেদের ৮টি, মেয়েদের ৫টি) ও একটি ছাত্রাবাস।

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা যেভাবে

বিশ শতাব্দীর শুরুর দিকে চট্টগ্রাম বিভাগে কোনও বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় চট্টগ্রামের অধিবাসীরা স্থানীয়ভাবে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন অনুভব করে। ১৯৪০ সালের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতায় অনুষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের সর্বভারতীয় সম্মেলনে মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সভাপতির ভাষণে চট্টগ্রাম অঞ্চলে একটি ‘ইসলামিক ইউনিভার্সিটি’ নির্মাণের কথা উপস্থাপন করেন এবং একই লক্ষ্যে তিনি চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার দেওয়াঙ পাহাড়ে বিশ্ববিদ্যালয় নির্মানের জন্য ভূমি কেনেন। দুই বছর পর, ১৯৪২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি নূর আহমদ চেয়ারম্যান বঙ্গীয় আইন পরিষদে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করেন।

বিজ্ঞাপন

ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৬০-১৯৬৫) প্রণয়নকালে চট্টগ্রামে একটি ‘বিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মানের স্থান হিসেবে শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত চট্টগ্রাম সরকারি কলেজকে সম্ভাব্য ক্যাম্পাস হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬২ সালে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জনশিক্ষা উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ফেরদাউস খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার একটি প্রাথমিক খসড়া পরিকল্পনা তৈরি করেন। একই বছর, ১৯৬২ সালের নির্বাচনী প্রচারনায় খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরী এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাধারণ প্রতিশ্রুতি দেন এবং নির্বাচন পরবর্তীকালে তিনি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী নির্বাচিত হলে চট্টগ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ গ্রহণ করেন।

চট্টগ্রাম সরকারি কলেজের স্থানে এই বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তিত হওয়ার পর, ১৯৬১ সালের ৭ মে চট্টগ্রামবাসীর উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম হলে এক প্রতিবাদসভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ প্রধান অতিথির ভাষণে চট্টগ্রামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত প্রকাশ করেন এবং তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করেন। পরবর্তীকালে ১৯৬২ সালে ৩০ ডিসেম্বর, ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ’ নামে আরেকটি পরিষদ গঠিত হয়। এই সকল সংগঠনের উদ্যোগে বিভিন্ন পর্যায়ে যোগাযোগ ও স্মারকলিপি প্রদান, পত্রপত্রিকায় বিবৃতি, সেমিনার অনুষ্ঠিত হতে থাকে। ১৯৬৩ সালের ৮ জানুয়ারি, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে চট্টগ্রামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়।

১৯৬৩ সালের ২৯ নভেম্বর, খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরী পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের স্পীকার মনোনীত হন। প্রথমদিকে এ বিশ্ববিদ্যালয় সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালিতে স্থাপনের পরিকল্পনা করা হলেও ১৯৬৩ সালের ১২ ডিসেম্বর, রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের অনুপস্থিতিতে মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে সভাপতিত্বকালে খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরী কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী এটিএম মোস্তফাকে বিশ্ববিদ্যালয়টি কুমিল্লা থেকে চট্টগ্রামে স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেন। ১৯৬৪ সালের ৯ মার্চ তার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত একটি জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের বৈঠকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ মঞ্জুর করা হয়। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর এম ওসমান গণিকে চেয়ারম্যান এবং ডক্টর কুদরাত-এ-খুদা, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, এম ফেরদৌস খান ও ডক্টর মফিজউদ্দীন আহমদকে সদস্য নির্বাচন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’ গঠিত হয়। এই কমিশন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে হাটহাজারী উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নের জঙ্গল পশ্চিম-পট্টি মৌজার নির্জন পাহাড়ি ভূমিকে প্রস্তাবিত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হিসেবে সুপারিশ করে। ১৯৬৪ সালের ১৭-১৯ জুলাই পাকিস্তানের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি খান বাহাদুর ফজলুল কাদের চৌধুরীর সভাপতিত্বে ইসলামাবাদে জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের সভায় ‘স্থান নির্বাচন কমিশন’-এর সুপারিশের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং এর চূড়ান্ত অনুমোদন প্রদান করা হয়। ১৯৬৪ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯৬৫ সালের ৩ ডিসেম্বর, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ও বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘরের প্রাক্তন কিউরেটর ড. আজিজুর রহমান মল্লিককে (এ আর মল্লিক) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প-পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এরপর ড. আজিজুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম শহরের নাসিরাবাদ হাউজিং সোসাইটির ৩ নং সড়কের ‘কাকাসান’ নামের একটি ভবনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্পের অফিস স্থাপন করেন। ড. আজিজুর রহমান মল্লিক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ছিলেন। ১৯৬৫ সালের ১৪ ডিসেম্বর, এক সরকারি প্রজ্ঞাপন বলে তৎকালীন পাকিস্তান শিক্ষা পরিদপ্তরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমস্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রকল্প অফিসে বদলি করা হয়। স্থপতি মাজহারুল ইসলামের ‘বাস্তকলা’ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি মাষ্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। প্রাথমিকভাবে একটি দ্বিতল প্রশাসনিক ভবন, বিভাগীয় অফিস, শ্রেণিকক্ষ ও গ্রন্থাগারের জন্য একতলা ভবন তৈরি করার পাশাপাশি শিক্ষক ও ছাত্রদের আবাসনের ব্যবস্থাও করা হয়। অবশেষে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। ১৮ নভেম্বর তাই ‘বিশ্ববিদ্যালয় দিবস’ পালিত হয়ে থাকে।

জাতিগঠনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারী উপজেলায় অবস্থিত হওয়াতে শিক্ষার্থীদের যাতায়াতে ১৯৮০ সালে চালু হয় শাটল ট্রেন। আর এ শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান আকর্ষণ। বর্তমানে বিশ্বের একমাত্র শাটল ট্রেনের বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন রয়েছে দুটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। চবিতে রয়েছে চট্টগ্রামের সর্ববৃহৎ বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার।‌ যাতে‌ রয়েছে সাড়ে তিন লক্ষের বেশি বই, দুর্লভ সংগ্রহশালা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উল্লেখযোগ্য প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ ও অধ্যাপনা করেছেন যার মধ্যে একজন নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং একাধিক একুশে পদক বিজয়ী অর্ন্তভুক্ত রয়েছেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। পরবর্তীতে ১৯৯০ এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে এ বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে ৮ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. আজিজুর রহমান মল্লিকের সভাপতিত্বে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। ২৪ মার্চ, স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে প্রাক্তন ছাত্র সমিতির আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মাঠে আয়োজন করা হয় গণসঙ্গীত। ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস দখল করে এবং টানা নয় মাস তাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তানি সেনারা এখানে তাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প বানিয়েছিল। পরবর্তীতে যুদ্ধের শেষে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাফর ইমামের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযান চালায় এবং ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের নয়দিন পর ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানিদের আওতামুক্ত হয়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ১২ জন শিক্ষার্থী‌ এবং তিনজন কর্মকর্তা নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেওয়া হয়। এই ইতিহাস সংরক্ষণের লক্ষ্যে, মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ২০০৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে জিরো পয়েন্ট চত্বরে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিস্তম্ভ স্মরণ। যা ‘স্মরণ চত্বর’ নামে পরিচিত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গুণীরা

১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দীর্ঘ ৫৮ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক জ্ঞানীগুণী তৈরি হয়েছেন। উপমহাদেশের খ্যাতিমান ভৌতবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. জামাল নজরুল ইসলাম, নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. অনুপম সেন, অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক আবুল ফজল, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ আলী আহসান, মুর্তজা বশীর, ঢালী আল মামুন, পার্থ বড়ুয়া ‍ও সাবেক ইউজিসি চেয়ারম্যান ড. আব্দুল মান্নানসহ বহু কীর্তিমান মনীষী জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. শাহাদাত হোসেন দুটি নতুন মাছের প্রজাতি শনাক্ত করেন এবং প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র হালদা নদী রক্ষা ও গবেষণায় অবদানের জন্য শিক্ষক মনজুরুল কিবরিয়া পেয়েছেন দেশি-বিদেশি সম্মাননা। এখনও তিনি সে কাজ করে যাচ্ছেন। ড. শেখ আফতাব উদ্দিনের কম খরচে সমুদ্রের পানি সুপেয় করার পদ্ধতি আবিষ্কার, ড. আল আমিনের লেখা বই যুক্তরাষ্ট্রের ৬টি বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের রেফারেন্স বুক হিসেবে পঠিত, অধ্যাপক ড. সাইদুর রহমান চৌধুরীর বঙ্গোপসাগর নিয়ে মানচিত্র তৈরিসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক নিজ নিজ ক্ষেত্রে রেখেছেন প্রতিভার স্বাক্ষর।

এতে পিছিয়ে নেই শিক্ষার্থীরাও। ব্যাঙের নতুন প্রজাতি আবিষ্কার করে সর্বকনিষ্ঠ বিজ্ঞানী হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র সাজিদ আলী হাওলাদার, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে চবির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ছাত্র শাখাওয়াত হাসান ও তার দলের নাম ছড়িয়ে পড়েছে সারাবিশ্বে। এছাড়াও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, প্রধানমন্ত্রীর মূখ্য সচিব, সাবেক মন্ত্রীপরিষদ সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ১১জন সচিব ও ৩০ জন অতিরিক্ত সচিব পদসহ বিভিন ক্ষেত্রে চবি শিক্ষার্থীরা দায়িত্ব পালন করেছেন। করোনাকালীন জাতীয় দুর্যোগ মুহূর্তে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া করোনা চিকিৎসায় ‘প্লাজমা থেরাপি’ আবিষ্কার করে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।‌ পরবর্তীতে করোনা চিকিৎসায় এ আবিষ্কার দেশ ও বিদেশে কার্যকর ভূমিকা রাখে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পাঁচ বছর পূর্বে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এ বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৬ সালে সুবর্ণজয়ন্তীর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত শাটল ট্রেন। ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যা ও সংকট

চবির অর্জনের বলার মতো অনেক গল্প ও দৃষ্টান্ত আছে। কিন্তু সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে হলে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের গৌরবময় অবস্থানে রাখতে হলে চলমান সমস্যা ও সংকটগুলোর সমাধান করতে হবে। আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় ক্যাম্পাস হয়েও পর্যাপ্ত আবাসিক সুবিধা না থাকায় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। ইউজিসির ৪৬তম প্রতিবেদন অনুযায়ী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) মোট শিক্ষার্থীর ৭৯ শতাংশেরই নেই আবাসন ব্যবস্থা। অর্থাৎ, মাত্র ২১ শতাংশ শিক্ষার্থীর রয়েছে হলে থাকার সুবিধা। অন্যদিকে চবির হলের রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিনিয়ত গণমাধ্যমের প্রধান শিরোনাম হয়। তাছাড়া হলের ডাইনিংগুলোতে দাম অনুযায়ী মানসম্মত ও পর্যাপ্ত পুষ্টিকর খাবারের রয়েছে অপ্রতুলতা।

দেশের উচ্চশিক্ষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যাপীঠ হওয়া সত্ত্বেও চবিতে এখনও অনেক বিভাগ, অনুষদ ও ইনস্টিটিউটে রয়েছে ভয়াবহ সেশনজট। আর এ সেজনজট শিক্ষার্থীদের জন্য ভয়াবহ অভিশাপস্বরূপ। দেশের উচ্চশিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান এবং চারটি পূর্ণাঙ্গ স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হয়েও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র—টিএসসি। অথচ শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে, মুক্তচিন্তার ধারাকে বিকশিত করতে, গবেষণায় এগিয়ে যেতে টিএসসি কার্যকর ভূমিকা রাখে। এ কারণে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর থেকে চবি তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে রয়েছে।

চবিতে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির কালাকানুন নিয়ে শিক্ষার্থীদের অভিযোগের শেষ নেই। অথচ চবির এই লাইব্রেরি দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ একটি লাইব্রেরি। কিন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের প্রবেশে এবং লাইব্রেরি সুবিধা নিতে হয়রানির শিকার হতে হয়। এ নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে আন্দোলন ও কর্তৃপক্ষের নিকট লিখিত ‌অভিযোগও দিয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ নজর দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ হলো গবেষণা। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গবেষণায় চবি অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে গবেষণার সঙ্গে ‌শিক্ষার্থীদের সংশ্লিষ্ট করতে হবে, গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

শাটল ট্রেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণসঞ্চারের জায়গা। এ শাটলে চড়েই এখান থেকে জন্মেছেন পার্থ বড়ুয়া, এস আই টুটুলরা। কিন্তু শিক্ষার্থী অনুপাতে শাটলে রয়েছে বগি সংকট, রয়েছে স্বাস্থ্যকর পরিবেশের অভাব। দেখা যায়, শাটলের ভেতরে ফ্যান থাকলেও সে ফ্যান ঘুরে না, লাইট জ্বলে না, নেই কোনও টয়লেটের ব্যবস্থা। তাছাড়া দীর্ঘ এতো বছর পরও শাটলে বগির সংখ্যা বাড়েনি। অথচ শিক্ষার্থীদের সংখ্যা বেড়েছে। আর এতে শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। সম্প্রতি শাটল ট্রেনের ভেতরে সিট না পেয়ে ছাদে ওঠে সেখান থেকে পড়ে গিয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী।

তাছাড়া স্থানীয় জোবরা এলাকাবাসীদের হাতে‌ এখানকার সাধারণ ‌শিক্ষার্থীরা অনেকটাই জিম্মি। স্থানীয় বাড়িওয়ালা, সিএনজি চালক, রিক্সা চালক, দোকানিরা যেভাবে ইচ্ছা যাচ্ছেতাই স্বেচ্ছাচারীভাবে বাড়িভাড়া, গাড়িভাড়া, খাওয়ার দাম নির্ধারণ করে চলেছে। অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে সবকিছু সুলভমূল্যে শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে থাকার কথা। যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্ধারণ করে দেয়। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন দুর্ভোগ যেন দেখার কেউ নেই! ফলে শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে অবিরত।

সমাবর্তন অনুষ্ঠান একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অনুষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের কাছে এ অনুষ্ঠান অত্যন্ত আবেগের ও মর্যাদার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দেশের এই শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়টির ৫৮ বছরে সমাবর্তন অনুষ্ঠান হয়েছে মাত্র ৪টি! এক্ষেত্রে চবি এতো পিছিয়ে আছে কেন! উপাচার্যরা বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও কেন সমাবর্তন অনুষ্ঠান করতে ব্যর্থ হচ্ছেন?

প্রতিষ্ঠার এতো বছর পরও বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তির আধুনিক যুগেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম চলে সেই মান্ধাতার আমলের সিস্টেমে। শিক্ষার্থীদের এখনও লাইনের পর লাইনে দাঁড়িয়ে ফি জমা দিতে হয়, হলে হলে দৌড়াতে হয় রেজাল্ট বা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের জন্য। চবির পুরো কার্যক্রমকে অনলাইন ব্যবস্থার আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।

সম্প্রতি একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চবিতে দিনদিন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পরীক্ষার জন্য আবেদন করেও পরীক্ষা দিচ্ছেন না শিক্ষার্থীরা। আবার বারবার ভর্তির জন্য ডাকা হলেও সিট খালি থেকে যাচ্ছে, ভর্তির জন্য পাওয়া যাচ্ছে না শিক্ষার্থী। এমনটা কেন হচ্ছে সেটা সহজেই অনুমেয়। শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়মুখী করা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এখন বড় চ্যালেঞ্জ।

তাছাড়া গবেষণায় তুলনামূলকভাবে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চাইতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অনেক পিছিয়ে আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

চলমান এ সমস্যা, সংকটগুলোর সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদ্যোগী হবে—এটাই প্রত্যাশা। বর্তমান উপাচার্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক উন্নতি, চলমান সমস্যা‌ ও সংকটসমূহ নিরসনে কার্যকর ভূমিকা রাখবেন—এটাই প্রত্যাশা। ৫৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমৃদ্ধি কামনা করছি। জয়তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর