আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ রাজনীতি কেমন হবে
২২ নভেম্বর ২০২৪ ১০:৫২
এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, রাজনীতির ভেতরের রাজনীতি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে সাধারণ মানুষসহ ছাত্র-জনতার ভাষা। একদিকে পতিত সরকারের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির গুটিকয়েক পোষা দল। অন্যদিকে একটি বৃহৎ বলয়ের দল ও জোট। তার ওপর দেশি-বিদেশি সক্রিয় গ্রুপ ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিরূপ ধ্যান ধারণা দলটিকে রাজনীতির মাঠ থেকে কোনরূপ আগাম সতর্কতা ব্যতিরেকে বলয় থেকে ছিটকে দিয়েছে। যেখানে দেশের অনুমান ৮০ শতাংশ জনগণ তাদের বিরুদ্ধে তো বটেই উল্টো দলীয় বঞ্চিত ও নিগৃহীত হওয়া কর্মী-সমর্থকদের নিরবতা তাদের খড়কুটো আঁকড়ে ধরেও দাঁড়াতে সাহায্য করা তো দূরে থাক দায় নিতে আগ্রহী নয়। এতে একটা বিষয় পরিস্কার হয়েছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে একটা সিন্ডিকেট তাদের নিজস্ব অনুসারী ছাড়া আর কাউকে সুযোগ দিতেও রাজি ছিল না। এতে পদবঞ্চিত, সুবিধাবঞ্চিত বৃহৎ সমর্থকগোষ্ঠীর সমর্থন হারিয়েও ক্ষমতা আর আধিপত্য বজায় রাখতে দমনপীড়ন চালিয়ে নিজ দলীয় কর্মীদের জামায়াত-শিবির ট্যাগ দিয়ে দল ছাড়তে বাধ্য করাও ছিল বেশ লক্ষণীয়। আবার দলে নিজেদের অবস্থান পোক্ত করতে রাজনীতির মাঠে কোনঠাসা হয়ে পড়া জামায়াত-শিবিরকে কিংবা ভিন্ন দলের কর্মীদের দলে টেনে দলভারী করে আধিপত্য কায়েম করতে দেখা গেছে। আর শেষমেশ সেটাই পরিলক্ষিত হয়েছে সরকার পতনের সফল অভ্যুত্থানের সময়। তখন আওয়ামী লীগ কার্যত বন্ধুহীন একা হয়ে পড়ে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে পূর্বের যে কোন সময়ের চেয়ে কঠিন পথ পাড়ি দিতে হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ ৭৫ সালে স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধুহত্যার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের মতো দেশি-বিদেশি চক্রান্ত সামাল দিতে পারলেও এবারকার পরিস্থিতি ভিন্ন। তা প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জন্যেও বিষফোঁড়া হয়ে দেখা দিয়েছে। ৫ আগস্টের পর আওয়ামী লীগের সমস্ত নেতাকর্মী ঘরছাড়া হয়ে আত্মগোপনে রয়েছেন। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। অনেকেই সীমান্ত পাড়ি দিতে যেয়ে বর্ডারে ধরা খেয়ে জেলে। অনেকেই আবার প্রতিবেশী দেশের সীমান্তরক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন। কারও কারও কাছে ছিল নগদ টাকা, ডলারসমেত। কেউ কেউ অবৈধ উপায়ে সীমান্ত পাড়ি দিতে চুক্তি করে উল্টো খুইয়েছেন সাথে থাকা টাকা ও মালামাল। অর্থাৎ জীবন বাঁচাতেই আবার জীবনের ঝুঁকি নিতেও আগপিছ ভাবছেন না। এমন একটি করুণ পরিণতি ঘটেছে, সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের সাথে। যিনি ছিলেন ডায়াবেটিকসসহ বিভিন্ন উপসর্গের রোগী। তাকেও ভারতে যেতে সাহায্যের নামে স্থানীয় দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে অন্যূন ৭০ লক্ষ টাকা।
ইতোমধ্যে সরকার আগের সরকারে থাকা মন্ত্রী এমপিদের লাল পাসপোর্ট অর্থাৎ কূটনৈতিক পাসপোর্ট বাতিল করায় এই মুহূর্তে যে যেখানে অবস্থান করছেন ভিনদেশে পাড়ি দেওয়ার সুযোগ থাকছে না। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাসপোর্টও বাতিল হওয়ায় ৪৫ দিন মেয়াদের বেশি থাকা নিয়ে সংশয় থাকলেও ভারত তাকে আশ্রয় দিয়ে সর্বশেষ বন্ধুত্বের নজির স্থাপন করে বিশ্বস্ততার প্রতিদান দিলেও অধিকাংশ বাংলাদেশিদের কাছে চক্ষুশুলে পরিণত হয়েও সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় পরম যত্নে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ভারতেই অবস্থান করছেন। আবার গুঞ্জন রয়েছে, দেশে বিচার শুরু হলে গণহত্যার অভিযোগে গঠিত যুদ্ধাপরাধ বিচার নিষ্পত্তি আদালত অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হলে শেখ হাসিনাকে বন্দী বিনিময় চুক্তির আওতায় ফেরত চাওয়া হবে। সেক্ষেত্রে ভারত কি ভূমিকা গ্রহণ করে সেটাও দেখার বিষয়। আবার অন্যদিকে আমেরিকার কূটচাল শুরু আঞ্চলিক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত ভারতকে নিয়ে। চীনও থেমে নেই ভারতের বিরুদ্ধে। আরেক প্রতিবেশী রাষ্ট্র পাকিস্তানও চরম বৈরী আচরণ শুরু করায় বেশ বিপাকে পড়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হাত এখন দৃশ্যতই পিঠের নিচে। আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রভাববলয় টিকিয়ে রাখতে আমেরিকা লেগে আছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। চীনকেও অস্থির করে তুলতে মরিয়া। ভারতে এখন প্রতিনিয়তই ভাঙনের খেলা চলছে। এদিকে মিয়ানমারের ১০ লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ভার বয়ে চলতে পারছে না বাংলাদেশ। কূটনৈতিকভাবেও কাউকে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস হয়তো আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় এনে এই সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হবেন বলেও দেশের মানুষ ধারণা করছে।
কিছুদিন আগে ফাঁস হওয়া শেখ হাসিনার কল রেকর্ড নিয়েও চলছে জোর আলোচনা। কথোপকথনে জানা যায় তিনি দেশে আসতে চান। তারই ধারাবাহিকতায় রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে হাসিনাপুত্র জয়ও সে বিষয়ই ইঙ্গিত করেছেন। জয় আরও জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা দেশে এসে বিচার মোকাবিলা করতে চান। তবে সেই চেষ্টা কতখানি সফল হবে তা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে।
এবার আসা যাক ফ্যাসিবাদ নিয়ে আলোচনায়। ফ্যাসিবাদ বলতে আমরা কি বুঝি? সর্বজনীনভাবে ফ্যাসিবাদ হচ্ছে একটি মতাদর্শ। ‘ফ্যাসিবাদ’ ধারণাটির উৎপত্তি হয় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ইটালিতে। তারপর জার্মানি এবং ইউরোপের নানা দেশে বিস্তার ঘটে এই মতবাদের। জার্মানিতে হিটলারের ‘নাৎসিবাদ’ এর উত্থান হয়। এটিও ছিল ‘ফ্যাসিবাদের একটি রূপ। ‘ফ্যাসিবাদ’ উত্থানের মধ্য দিয়ে ইউরোপে হিটলার ও মুসোলিনির মতো বিতর্কিত নেতার উদ্ভব হয়।
এইক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ বামপন্থীদের নিয়ে বাম মধ্যপন্থী রাজনীতিতে বিশ্বাসী হলেও দেশের চলমান সংকটের ফলে এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্র রাজনৈতিক জোটকে বিরুদ্ধ মত ও মতাদর্শের রাজনৈতিক গোষ্ঠী ফ্যাসিস্ট হিসেবে আখ্যা দিতে শুরু করে। ফ্যাসিবাদ হচ্ছে উগ্র-ডানপন্থী মতাদর্শ হলেও আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে সমাজতান্ত্রিক ধারণার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শে বিরোধীমতের কোনও স্থান ছিল না। কর্তৃত্বময় শাসন ক্ষমতাই ছিল ‘ফ্যাসিবাদ’ এর মূলমন্ত্র। আর সেই তকমা আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচন পূর্ব ও পরবর্তী সরকার পতন পর্যন্ত এবং ফ্যাসিস্ট দল হিসেবে গণহত্যার অভিযোগে বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে ১০ বছর শাস্তির আইন প্রণয়নের কথাও শোনা যাচ্ছে।
এই পরিস্থিতে আওয়ামী লীগ নামক স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়া দলটির ভবিষ্যৎ নিয়েও শংকা দেখা দিয়েছে। দলটির সভাপতি হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করছেন শেখ হাসিনা। তার নামে শতাধিক মামলা রুজু হয়েছে। যাতে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত বল প্রয়োগে হত্যা, গুম ও পোড়ানো অভিযোগ আনা হয়েছে। এই লক্ষ্যে বিভিন্ন মামলায় তদন্তের অনুমতি চাওয়া হয়েছে। ঢেলে সাজানো হয়েছে তারই গড়ে তোলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সেই ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
মাঠের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ অতীতে অনেক সংকট থেকে উত্তরণ ঘটিয়েছে দক্ষ নেতৃত্বের মাধ্যমে। এবার কোন পথে হাঁটবে দলটি? আর নেতৃত্বেই থাকবে কে? মাঠ গোছানোর মত শক্ত কাজ করে বৈরী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে পারবে কি গায়ে লাগা এসব তকমা মুছে ফেলতে? নাকি সাবেক স্বৈরাচারী শাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের মতোই আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাকেও বাকি জীবন কাটাতে হবে সেই অভিশপ্ত ‘স্বৈরাচার’ নামক ঘৃণিত শব্দে। সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দল বলে পরিচিত দলটি সবসময়ই ছিল নির্বাচনমুখী। অথচ সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়াও নির্বাচন বৈধ হবে। তাহলে অর্থ কি দাঁড়ায় বিচারে যাই হোক, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে দূরে রাখতেই একটি মহল সোচ্চার। সরকারও সেই তেলে ঘি ঢেলে যাচ্ছে নিয়মিত। উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের স্পষ্ট বক্তব্য বিচারের আগে এই ফ্যাসিস্ট দলকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হতে দিতে চান না। উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও একই মত ব্যক্ত করে চলেছেন মিডিয়ায় ও কর্ম পরিকল্পনায়।
সময় যত গড়াচ্ছে ততোই পরিস্থিতি একদিক থেকে স্বাভাবিক হচ্ছে। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের অনেকেই আত্মগোপন অবস্থা থেকে ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন। পাশাপাশি ধরপাকড়ও চলছে। মিডিয়ায় এসেছে সারাদেশে অনেক নিরপরাধ ব্যক্তিকে মামলায় আসামী শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে। সরকারও বিষয়টা আমলে নিয়ে যেনতেন গ্রেপ্তার নয় মর্মে পুলিশকে এই বিষয়ে মৌখিক নির্দেশনা দিয়ে রেখেছে।
সবিশেষ, অতীতে রাজনীতির ক্রান্তিকাল পেরিয়ে এসেছে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং বামপন্থী দলগুলো। সবারই অভিজ্ঞতা আছে সংকট উত্তরণের। এবার আওয়ামী লীগ কিভাবে উত্তরণ ঘটাবে? দেশের সাধারণ মানুষসহ সবারই যৌক্তিক প্রত্যাশা সাধারণ ছাত্র জনতার হত্যা, গুমখুনসহ সকল অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইবে আওয়ামী লীগ। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি সেই ক্ষমা চাইবে? সেই লক্ষণ এখনও কোনওভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এমন যদি হয় তাহলে দলটি আদৌ কি পারবে সংকট কাটিয়ে স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে? নাকি নব্বইয়ের পতিত স্বৈরাচার এরশাদের মতো ধুঁকে ধুঁকে কাটাতে হবে বাকি সময়টা? দেখতে চাই আমরা। তবে, আমরা সাধারণ মানুষ দেশে সুস্থির রাজনীতি দেখতে চাই। মানুষে মানুষে সহাবস্থান চাই। দেশের মঙ্গলের জন্য যে কোনও শুভ পদক্ষেপ আমরা স্বাগত জানাই। একইসাথে, আবারও যদি কোনও ফ্যাসিবাদ, একনায়কতন্ত্র উস্কে উঠে তবে সেটিকে কঠোর হাতে দমন করবো আমরাই।
লেখক: আইনজীবী ও কলাম লেখক
সারাবাংলা/এসবিডিই