Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বর্তমান ঠিকানা ঢাকা, স্থায়ী দ্যাশে


১৫ জুন ২০১৮ ২০:০৫

রাজধানী ঢাকা বাংলাদেশের রানি মৌমাছি- ঢাকার রাজপথে নামলে এই কথাটিই মনে আসে চকিতে। ঢাকাকে ঘিরেই যেন রচিত গোটা বাংলাদেশ; যেখানে মিল-মিশ ঘটেছে সব কর্ম ও গন্তব্যের। চাকরি-বাকরি, ক্যারিয়ার, ব্যবসা-বাণিজ্য, পড়ালেখা, দৌড়ঝাঁপ সবই ঢাকা কেন্দ্রীক ও ঢাকামুখী। টেকনাফের চিংড়িঘেরের মালিকের ‘হেড অফিস’ ঢাকায় না হলে সুনাম থাকে না বাজারে, তেঁতুলিয়ার অ্যাগ্রো ফার্মেরও চাই একখানা ‘ঢাকা অফিস’। প্লাস্টিকের স্যান্ডেল কিংবা বদনা তৈরির কারখানাও তাই স্থাপিত হয় এই মহানগরে। সরকারি, আধাসরকারি, বেসরকারি- সব কিসিমের সবখাতের সব শাখার কর্ম ও কর্মীর মিলনস্থল ঢাকাকে ঘিরেই যেন আবর্তিত বাংলাদেশের জীবন ও জীবিকা।

বিজ্ঞাপন

তাই ভবিষ্যতের সব দরজা ও দিশা ঢাকায়। নিদেন পক্ষে অর্ধেক দেশবাসীর মনপছন্দ ঠাঁই-নগরীর নাম ঢাকা। ঢাকায় এক টুকরো মাটি কিংবা একখানি ফ্ল্যাটের দিওয়ানা মফিজ থেকে মাধব- কে নয়! অতএব এই রানি মৌমাছির পেছনে ঝাঁকে ঝাঁকে নাগরিক মৌমাছি চাক-বাঁধায় অহর্নিশ ব্যস্ত। হাজারো-লাখো ফুল থেকে মধু আহরণ করে গড়ে তোলা মৌচাকের সঙ্গে ঢাকার মিলও তাই খাপে খাপ ষোলো আনা। গ্রাম-মফস্বলের পাঁজর নিংড়েই তাই গড়ে উঠেছে ঢাকার বিরাট বপু।

বিজ্ঞাপন

তবু এই ‘সব কিছুর সমাহার’ ঢাকাও উৎসবের মৌসুমে কেমন শূন্য হয়ে যায়! পার্বণের হাওয়ায় (না কি ধোঁয়ায়!) ঢাকার-চাক মৌমাছি-শূন্য হয়ে পড়ে। ঢাকায় যারা বাস করেন, ঈদ-পূজায় তারা ‘বাড়ি’ যান। এই বাড়ি মানুষের জন্মভিটা, বাপ-দাদার বসতঘর, গাঁওগেরাম; এই বাড়ির নাম ‘দ্যাশ’- দেশের ভেতরে আরেক দেশ!

গণমাধ্যমের ধারাভাষ্য-বর্ণনায়- কি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোয় কি পত্রপত্রিকায় ঈদ বা পূজার আগে আগে ‘শিকড়ের টান’, ‘নাড়ির টান’ শব্দযুগল দু’টিই ঘুরেফিরে উচ্চারিত হয়। ‘নাড়ির টানে’, ‘শিকড়ের টানে’ ঢাকাবাসী গ্রামের বাড়ি যান। আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে দেশের বাড়ি যান তারা। তবে কি ঢাকায় যারা থাকেন, তাদের শিকড় এখানে গভীরে ছড়ায় না? স্থাপিত হয় না নাড়ির কোনো যোগ? কচুরিপানার মতোই ভাসমান জীবন ঢাকার?

এক অর্থে দুনিয়ায় মানুষের জীবন তো কচুরিপানারই! দু’দিন পর সবই ছেড়ে-ছুড়ে চলে যেতে হয়। ঢাকাবাসীর সেই দুদিনেরও দুই ভাগ; এক ভাগে ‘দৃশ্যমান’ ঢাকা, আরেক ভাগে ‘ঢাকা-থাকা’ গ্রাম!

অর্থাৎ কর্মের জন্য থাকা, ক্যারিয়ারের পেছনে ছোটা, ভবিষ্যতের সোপান গড়া- সবই ঢাকায়, কিন্তু মস্তিষ্ক আর মননের ফারাকের মতো এক বিভেদ জেগে থাকে ‘ঢাকার বাসা’ আর ‘দেশের বাড়ি’র ঠিক মধ্যেখানে। নগরের নাগরিক মাত্রই তাই ভেতরে-মননে দ্বিচারী! দেশের ভেতর আরেক ‘দ্যাশ’ বাঁচিয়ে রাখেন তারা সযত্নে, মনের গহীন-ভেতরে। সেই দ্যাশের পানে ছোটেন তারা উৎসবে-পার্বণে, ছুটি ছাটায়; ফুরসত পেলেই গ্রামের পথ ধরেন। যেন এক অভ্যন্তরীণ অভিবাসীর জীবন ঢাকাবাসীর। দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে গিয়ে ভিনদেশি না হলেও গাঁয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে তারা ‘পরবাসী’ হয়ে থাকেন। দিন কয়েকের তরে গ্রামে ফিরে তারা ‘আপনবাসী’ হন।

ঢাকার এই নাগরিক জীবনের সঙ্গে বলক ওঠা ভাতের হাড়ির উপমাটা বেশ যুৎসই ঠেকে। চালগুলো হাড়ির এপাশ-ওপাশ, ওপর-নিচ ছোটাছুটি করে, একে অন্যের সঙ্গে টক্কর লাগে; কিন্তু পলকের জন্যও স্থির হওয়ার সুযোগ ঘটে না। তেমনই অস্থির ছুটে চলেন ঢাকার মানুষ, ঢাকা নামের মস্ত এই হাড়ির ভেতর। একই নগরের একই মহল্লায়, এমনকি একই ভবনে থেকেও দুই কথা হয় না তাদের! দু’দণ্ডে স্থিরতা দেয় না তাদের কমপিটিশনের যুগ, গ্লোবালাইজেশনের কাল।

এই চলোর্মিচঞ্চল সময়ের পিঠে সওয়ার ঢাকার সোসাইটিতে সামাজিক যোগাযোগ একেবারেই ওপর-ভাসা। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে অর্থাৎ ফেসবুক ইত্যাদিতে যতটা দেখা যায় তা শত ভাগ ভার্চুয়াল। মানবিক বন্ধনের দৃঢ়তাও তাই কম কিংবা কমজোরি ঢাকায়। এখানে পরিচিতজনের সঙ্গে দেখা হয় বটে, ‘মিলন’ ঘটে না। সময়ের স্বল্পতা যেমন বাধা, তেমনি নিউক্লিয়ারপন্থী শহুরে ব্যবস্থাও ঐক্যের সমাজ গঠনে বড় প্রতিন্ধকতা। তাই ঢাকায় ‘হাই-হ্যালো’র মধ্যে সীমিত মানুষের ভার্চুয়াল সম্পর্ক, বুকে জড়ানো পিরিতির জায়গা গ্রাম। স্বজন-সুজনের সামষ্টিক সমাজ সেখানে দু’হাত বাড়িয়ে ঢাকাবাসীর জন্য অপেক্ষা করে থাকে। ঈদ-পূজা-পার্বণে তাই ঢাকার মানুষও পথের ঝক্কি, যানের জট- বেহদ ভোগান্তি হাসিমুখে সয়ে বাড়ি যান। এই যাওয়ায় কেবল আত্মীয়-পরিজন-আপনজনের সঙ্গে তাদের সাক্ষাত ঘটে তা নয়, বাংলার হাজার বছরের সংস্কৃতিরও নবায়ন ঘটে।

সামাজিক উৎসব আসলে সমাজের জীয়নকাঠি, যার ছোঁয়ায় জেগে ওঠে জনজীবন। ধর্মীয় উৎসবও এই সমাজে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’! ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সব মানুষকে তাড়িত করার মতো ধর্মীয় উৎসবের ধর্মনিরপেক্ষ এমন তাৎপর্য, এক কথায় তুলনারহিত। দুনিয়ার দরবারে অ্যানালগ ও ডিজিটাল- দু’ভাবেই এলান করার মতো ঘটনাই বটে।

এই যে দুই ‘দেশ’, এই যে ঢাকায় ইটের পরে ইটের মাঝে মানুষের ‘কীটসম’ জীবন, বিপরীতে সবুজের খোলা প্রান্তর, বহতা নদী, বিস্তৃত খেতখামার; এই যে নগরের বাজারি পরিবেশ আর গ্রামের শান্তসমাহিত প্রতিবেশ- এই দুইয়ের মিলন কি ঘটে কখনো?

শহুরে অ্যাটিকেটে অভ্যস্ত মানুষটি গ্রামে গিয়ে দিব্যি ‘ওমুকের পোলা’, ‘তমুক বাড়ির ছেলে’ বনে যান। থ্রি-কোয়ার্টার, ট্রাউজার ছেড়ে লুঙ্গি পরে আদুল গায়ে পাড়া-পরশির দাওয়ায় ঢুঁ মারেন। এর-ওর খোঁজ-খবর নেন। বাজারের কোণে চায়ের দোকানে দন্ত কেলিয়ে গালগল্প করেন সবার সাথে। ময়মুরুব্বি দেখে সটান দাঁড়িয়ে পড়েন, সালাম দেন বিগলিত চিত্তে। এই আদবকেতা সহজাত, অ্যাটিকেটটি আলবত রপ্ত। তাই জীবন ও যাপনের দুই সমাজ সমান্তরালেই বয়ে যায়, এক হয় না।

ইতিহাসও ‘যশ্মিন দেশে যদাচার’র পক্ষেই সাফাই-সাক্ষ্য দেয়। নগরে মানুষ ছুটেছে ক্ষমতায় ভাগ বসাতে, রুজিরুটির তাগিদে, বিদ্যার বহর হতে। কিন্তু বার বার ফিরে গেছে সে মাটির টানে, আপনজনের সান্নিধ্যে, মায়ের আঁচলতলে। তাই তিলোত্তমা উপমিত নগরীও মানুষের কাঙ্ক্ষিত হলেও ‘আপন’ হতে পারেনি। অস্থায়ী আবাস হয়েই থেকেছে নগর, স্থায়ী নিবাস রয়ে গেছে গ্রামের এঁদো ডোবার পারের কুঁড়েঘরটি।

ঢাকায় থাকেন বটে, নিজেকে ‘ঢাকাইয়া’ বলেন ক’জন? কয়েক শতক ধরে বসবাস করা পুরান ঢাকার মানুষের জন্যই যেন একচেটিয়াভাবে বরাদ্দ এই ‘পরিচয়’। এখনো দুই ঢাকাবাসীর আলাপচারিতায় দ্বিতীয় অবশ্যম্ভাবী প্রশ্নটি হয়- ‘দেশের বাড়ি কোথায়’? প্রথম প্রশ্নটি অবশ্য ‘বাসা কোথায়’ বা থাকেন কোথায়?

মাঝে বাসাভাড়ার প্রসঙ্গটি আসাও খুব সম্ভব। সবকিছুর ঝড়ো গতির বাড়বৃদ্ধির সহগামী হয়ে বাসা ভাড়াও বাড়ছে ফি বছর, সূর্য ওঠার নিয়মে। আয়-রোজগারের অর্ধেকই বাসা ভাড়া দিয়ে বাদবাকি অর্থে সব কিছু ‘ম্যানেজ’ করার ম্যানেজারিই ঢাকার মানুষের জীবন। নুন আর পান্তার যুগলবন্দি ঘটানোর অসাধ্য সাধনের জীবন ঢাকাবাসীর। তবু কর্মসূত্রে, জীবিকার তাগিদে, শিক্ষার লক্ষ্যে, ক্যারিয়ারের দৌড়ে ঢাকায় ঢোকা ছাড়া উপায় থাকে না। কিন্তু আজকের এই ‘অন্যোন্যপায়’ গন্তব্য-মঞ্জিল ঢাকা আসলে কতটা ‘মঞ্জিল’ হয়ে উঠতে পেরেছে? মঞ্জিলের একটি অর্থ ‘বাসভবন’ হলেও আরেক অর্থ তো ‘সমাধী’।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর একাধিক জরিপে বাসযোগ্যতা ও অবকাঠামোগত সূচকে এশিয়ার সব ক’টি বড় শহরের পেছনে পড়ে আছে ঢাকা। বিশ্ববিচারেও তলানির দিকেই তার অবস্থান। কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন আর কি! মহানগর হিসেবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার সমন্বিত বন্দোবস্তের চিত্রটি ঢাকায় কিন্তু একেবারে ঢাকা নয়, উদোম! অপর্যাপ্ত হলেও হয়তো সবই আছে, কিন্তু কিছুই নেই তার নিয়ম মতো। অনিয়মের যা আছে, তারও ‘সেবা-ধারা’ কেবল ক্ষমতা আর বিত্তগামী। অধিকাংশ ঢাকাবাসীর তাই জীবনধারণের স্থান ঢাকা হলেও ঢাকা তাদের জীবনযাপনের জায়গা নয়; সেই ‘অযাপিত’ জীবনের জায়গা দ্যাশের বাড়ি! তাই ঠিকানাও তাদের দু’টি- বর্তমান ও স্থায়ী।

লেখক: হাসান ইমাম, সাংবাদিক

বিজ্ঞাপন

বাঘায় কৃষককে গলা কেটে হত্যা
২৩ নভেম্বর ২০২৪ ১৬:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর