শিক্ষাই পারে চরাঞ্চলের বাল্যবিবাহ ও প্রতিবন্ধীতা দূর করতে
২৮ জানুয়ারি ২০২৫ ১৪:০৭
পৃথিবীর বৃহত্তম ব-দ্বীপ বাংলাদেশ। হাজার নদী জালের মতো ছড়িয়ে রয়েছে দেশজুড়ে। বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ৫৭টি আন্তঃসীমান্ত নদীসহ সর্বমোট ৪০৫টি নদী প্রবাহিত হচ্ছে। বাংলাদেশের মোট ভূমির প্রায় ১০ শতাংশ চরভূমি। দেশের ৩২টি জেলার শতাধিক উপজেলার অংশবিশেষ চরাঞ্চল। দ্বীপচর, উপকূলীয় চর- সব মিলিয়ে ৫০-৬০ লাখ মানুষ চর এলাকায় বসবাস করে। প্রতিবছর প্রায় ৫,০০০ থেকে ৬,০০০ হেক্টর জমি নদীভাঙ্গনে হারিয়ে যায়। নদীভাঙ্গনের ফলে প্রতিবছরে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ২৫ কোটি ডলার। চরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা পরিচালনার প্রধান দুটি উপায়ের একটি হলো কৃষিকাজ এবং অন্যটি মাছ ধরা। কিছু মানুষ অন্যত্র শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। চর এলাকার সমস্যা অগণিত। আর সকল সমস্যা সমাধানের প্রথম সিড়ি বা ধাপ হলো শিক্ষা। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই গড়ে তুলতে পারে স্থায়ী ও কাঠামোগত উন্নয়ন অথবা সমাধান।
শিক্ষা হল জ্ঞানলাভের একটি পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া এবং ব্যক্তির সম্ভাবনার পরিপূর্ণ বিকাশ সাধনের অব্যাহত অনুশীলন। শিক্ষা প্রক্রিয়ায় কোনো ব্যক্তির অন্তর্নিহিত গুণাবলীর পূর্ণ বিকাশের জন্য উৎসাহ দেয় এবং তাকে সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সব দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলি অর্জনে সহায়তা করা হয়। আধুনিক ও বিজ্ঞান নির্ভর শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার উদ্দেশ্যে বিপুল সম্ভাবনাময় চরাঞ্চলের মানুষের জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। চরের মানুষের নিজস্ব একটি শক্তি আছে। সেই শক্তিকে কাজে লাগানোর বিষয়ে ভাবতে গেলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আমাদের দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্তরগুলো হলো- প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়। চর এলাকায় শিক্ষা বিস্তারের অন্যতম প্রতিষ্ঠান হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়। কয়েকটি চরের জন্য কিংবা বিপুল সংখ্যক চরবাসীর জন্য রয়েছে ১টি বা ২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। মহাবিদ্যালয় বা উচ্চ স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কথা চিন্তাই করা যায় না। মূল ভূখন্ডে শিক্ষার্থীদের জন্য ০.৯২ থেকে ১.৭ কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যেই বিদ্যালয় রয়েছে। পক্ষান্তরে চরাঞ্চলের শিক্ষার্থীদেরকে শুকনো মৌসুমে ধূ ধূ বালি পথে বা বর্ষাকালে জীবনের ঝুকি নিয়ে নদী পথে বিদ্যালয়ে যেতে স্থানভেদে ২.৫ থেকে ৫.৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিতে হয়। দেশে বর্তমানে মোট সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৬৫ হাজার ৯৯টি, শিক্ষকের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৪৮ হাজার ৫৮৪ জন এবং শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২ কোটি ০৯ লক্ষ ১৯ হাজার ১০১ জন। আমাদের দেশে প্রথম প্রাথমিক শিক্ষার যাত্রা শুরু হয় ১৮১৮ সালে হবিগজ্ঞ জেলার লস্করপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের মাধ্যমে। ২০২৫ সালেও আমরা দেখতে পাই কোন কোন চরে এখনও প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। আজকেও যদি কোন চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলে সে চরটিও প্রাথমিক শিক্ষায় পিছিয়ে থাকবে ২০৭ বছর। এভাবে যত দেরি হবে পিছিয়ে থাকার সময়ও তত বাড়বে।
চরের যে এলাকায় প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে সেখানকার শিক্ষা ব্যবস্থাও অত্যন্ত করুন। উদাহরণ হিসেবে ডেইলি স্টারের একটি প্রতিবেদন থেকে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার অষ্টমীর চর ইউনিয়নে ডাটিয়ার চর এলাকায় দক্ষিণ নটারকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বিদ্যালয়টিতে কাগজে-কলমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২০৩ জন। শিক্ষকের পদ সংখ্যা ০৬টি কিন্তু কর্মরত মাত্র ০১ জন শিক্ষক। আবার তিনিও প্রতিদিন না এসে মাঝে মধ্যে স্কুলে আসেন। যার ফলে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী ঝড়ে পড়ে। মাত্র ৫০-৬০ জন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করত। অথচ বিদ্যালয়টি তৎকালীন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রীর নির্বাচনী এলাকার মধ্যেই অবস্থিত। গাইবান্ধা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের (জিইউকে) তথ্য অনুযায়ী, গাইবান্ধা, রংপুর ও কুড়িগ্রাম জেলার তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা নদীর ৪৪টি নদীবেষ্টিত চার শতাধিক চরে প্রায় ১৬ লক্ষাধিক বা ২৫ শতাংশ মানুষ বসবাস করে। উক্ত জনসংখ্যার বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থী সংখ্যা অন্তত ৩ লাখ ৪৫ হাজার। প্রত্যেক চরে প্রাথমিক বিদ্যালয় না থাকায় সব শিক্ষার্থীই প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ পায় না কারণ চরগুলোর দূরত্ব ও বন্যাকালীন যোগাযোগ সমস্যার কারণে বেশির ভাগ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েও নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারে না অথবা একটা সময় ঝড়ে পড়ে। উল্লেখিত তিন জেলার নদীবেষ্টিত ১৩টি উপজেলার ৪২টি ইউনিয়নের চার শতাধিক চরে ছয়টি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে মাত্র তিন হাজার শিক্ষার্থী পড়ালেখার সুযোগ পেয়ে থাকে। এসব এলাকায় এখনো গড়ে ওঠেনি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এ কারণে প্রাথমিক বিদ্যালয় শেষ করা মোট শিক্ষার্থীর ৭০ এবং মাধ্যমিক শেষে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে। কিছু অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের শিক্ষাথীকে মূল ভূখণ্ডের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করার সুযোগ ও সামর্থ্য থাকলেও পরিবারিক আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গন্ডি পেরোতেই ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থী এবং প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর যারা নিম্নমাধ্যমিক কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না এরুপ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন যাত্রা পথেই বন্ধ হয়ে যায়।
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ তাদের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলেছে চরম আবহাওয়া বা তাপপ্রবাহের প্রভাবে ৮৫টি দেশে স্কুলগামী প্রায় ২৪ কোটি ২০ লাখ শিশুর পড়াশোনা বিঘ্নিত হয়েছে। এ শিশুদের সাড়ে তিন কোটিই বাংলাদেশের। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় প্রচন্ড তাপপ্রবাহের কারণে বাংলাদেশ, কলম্বিয়া, ভারত, থাইল্যান্ড ও ফিলিপাইনে শুধু এপ্রিল মাসেই ১১ কোটি ৮০ লাখ শিশু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে দেশের চর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। কারণ চর অঞ্চলে বড় বড় গাছপালা না থাকায় এ সময় তাপমাত্রা বেশি থাকে এবং আবহাওয়া থাকে চরম ভাবাপন্ন।
শিক্ষা বন্ধ হয়ে যাওয়া মেয়েদের অভিভাবকরা মনে করেন মেয়ে বুড়ি হয়ে যাচ্ছে। চর এলাকার বাস্তবতায় তাড়াতাড়ি মেয়েদের বিয়ে দিতে না পারলে পরিবারের সদস্যরা সামাজিক নিন্দায় পড়ে যাবার আশংকায় ভোগেন। বাবা-মা আতংকিত হয়ে ওঠে কারো সাথে মেয়ের অবৈধ সম্পর্ক সৃষ্টি হলে নিন্দার ঝড়ে তারা সমাজচ্যুত হয়ে যাবে। মেয়ের বয়স বেশি হলে উপযুক্ত পাত্র পাওয়া যাবে না কিংবা যৌতুকের টাকার পরিমাণ বেড়ে যাবে। এক শ্রেণীর দালাল বা ঘটক পার্সেনটেজ পাবার আশায় মেয়ের বাবাকে নানাভাবে অল্প বয়সেই বিয়ের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে। চরাঞ্চলের অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ বাল্যবিবাহকে মেয়েদের সতীত্ব ও সম্মান রক্ষার উপায় হিসেবে দেখে থাকে যা মেয়েদের স্বাধীনতা ও মুক্ত চলাফেরায় বাঁধার সৃষ্টি করে। চরের মানুষের নিকট কোন মেয়ে অবিবাহিত থাকলে তা পরিবারের পক্ষে অসম্মানজনক ও নিন্দনীয়। চর অঞ্চলে বাল্য বিয়ের প্রধান কারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় অভিভাবকরা বাধ্য হয়েই মেয়েদের বাল্য বিয়ে দিচ্ছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থাকলে এরকম হতো না। কোন চরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলেও সেখানকার মেয়েদের বিয়েটা আরো ৫ বছর অনায়াসে পিছানো যেত বলে অনেক অভিভাবক মনে করেন। একটি বাস্তব উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি পরিস্কারভাবে তুলে ধরছি। করোনার দেড় বছরে বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ থাকায় কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ি উপজেলার ৪৩টি বিদ্যালয়ের ৫০০ শিক্ষার্থী বাল্য বিয়ের শিকার হয়। ফুলবাড়ির বড়ভিটা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ৮৭ জন এবং বড়ভিটা উচ্চ বিদ্যালয়ের একই ক্লাসের ৫৫ জন শিক্ষার্থী বাল্য বিয়ের শিকার হয়। (সূত্র: The Dhaka Tribune-Child marriage: An epidemic within the pandemic in Kurigram.) এ পরিসংখ্যানে বলে দেয় যে কোন এলাকায় বিদ্যালয় বা পড়ার সুযোগ না থাকলে তা বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে কতটা ভয়াবহ ভূমিকা রাখে। ঝড়ে পড়া কিশোরদেরও বাবা-মা যৌতুকের লোভে বিয়ে দিয়ে দেন।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ অনুসারে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ। দেশে এখন বাল্য বধুর সংখ্যা ৪১.৬ মিলিয়ন যার অর্ধেকেরও বেশির বয়স ১৫ বছরের কম। ২০ বছর বয়সের নীচে মহিলাদের ২৫% বিয়ের সাথে সাথেই সন্তান ধারণ করে যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর (UNICEF, 2019)। Plan International এর মতে বিশ্বে প্রতি ২ সেকেন্ডে একটি করে বাল্য বিয়ে হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বাল্য বিয়ে হয় আফ্রিকার দেশ নাইজারে (৭৬%) আর সবচেয়ে বাল্য বিয়ে কম হয় মালদ্বীপে (০২%)। বাংলাদেশের চর অঞ্চলে বাল্য বিয়ের হার ৮০% যা নাইজারের চেয়েও বেশি। আবার সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিনল্যান্ড, নরওয়ে, বেলজিয়াম, লিথুয়ানিয়া, যুক্তরাজ্য এবং উত্তর আয়ারল্যান্ডে কোন বাল্যবিবাহ নেই (সূত্র: Science Publication : Noakhali Science and Technology University.)।
বাল্যবিবাহ একজন নারী, একটি সমাজ বা দেশের জন্য জটিল অন্তহীন সমস্যার শৃঙ্খল তৈরী করে। বাল্য বিয়ে মানে হলো মেয়েদের ১৮ বছরের আগে এবং ছেলেদের ২১ বছরের আগে বিয়ে হওয়া। স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞগণের মতে ১৮ বছর বয়সের আগে একটি মেয়ের শরীর বিয়ে ও গর্ভধারণের জন্য উপযুক্তভাবে তৈরি হয় না। এই বয়সে গর্ভে সন্তান ধারণের মানে হলো ‘শিশুর গর্ভে শিশু’ জন্ম নেয়া। ডব্লিউএইচওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, কিশোরী মাতৃত্ব অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ৬০ শতাংশ কিশোরী মা রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। তাদের শরীরে পুষ্টির অভাব থাকে। অপুষ্ট মায়ের বাচ্চাও অপুষ্টির চক্রে ভোগে। কিশোরী মা মানে মা ও সন্তান- উভয়কে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলা।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে বাল্য বিবাহ ও কিশোরি মায়ের সন্তান ধারণের ক্ষেত্রে গর্ভধারণজনিত নানারকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। তন্মধ্যে হলো- (১) স্থির জন্ম (Still Birth): সন্তান জন্মের পর প্রাণের কোন অস্তিত্ব না থাকলে বা মৃত সন্তান প্রসব হওয়াকে বলে স্টিল বার্থ। জিনেটিক বা ভ্রুণের গাঠনিক সমস্যার কারণে বাচ্চা গর্ভেই মারা যেতে পারে বা কোনভাবে বেঁচে গেলেও বাচ্চা প্রতিবন্ধী হয়ে থাকে।
(২) গর্ভপাত (Miscarriage): গর্ভধারণের প্রথম ২৮ সপ্তাহের মধ্যে যদি কোন শিশুর মৃত্যু হয়, তাকেই মিসক্যারেজ বা গর্ভপাত বলা হয়ে থাকে। প্রতি ১০০ জন গর্ভবতী নারীর মধ্যে ১০-১৫ শতাংশের গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের ২০১৪ সালের একটি জরিপ অনুযায়ী, প্রতি বছর অন্তত ১১ লাখ ৯৪ হাজার শিশুর ক্ষেত্রে স্বপ্রণোদিত গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ প্রতিদিন গর্ভপাতের সংখ্যা ৩ হাজার ২৭১টি। চর অঞ্চলে গর্ভপাতের সংখ্যা বেশি। কারণ গর্ভধারণের ১৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রসুতির আবাস ভূমির আবহাওয়ার তাপমাত্রা যদি ২৮-৩২ ডিগ্রী সে. (পরিমিত তাপমাত্রা ১৬-২১ ডিগ্রী সে.) থাকে তাহলে এ হার ২৫% হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে এবং চরাঞ্চলে গাছপালা কম থাকায় বিশেষ করে শুস্ক মৌসুমে চরম রুক্ষ আবহাওয়া বিরাজমান থাকে। (সূত্র: Frontiers: The risk of miscarriage)
(৩) Pregnancy Termination: গর্ভাবস্থার সমাপ্তি, যা গর্ভপাত নামেও পরিচিত।এরকম ঘটনা প্রতি হাজারে ২৯টি বা তারও বেশি ঘটে। গর্ভপাতজনিত কারণে যুবতী মায়ের চেয়ে কিশোরী মায়ের মৃত্যুর ঝুকি দ্বিগুন থাকে। (ICRW, 2007)। ২০০৮ সালে ঔষধ কোম্পানি গুলোর তরফ থেকে তৈরি করা এক হিসেবে বলা হয়, বছরে প্রায় ৬ লাখ গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। আর বর্তমানে প্রতি এক হাজারে ১৮.২ জন নারী গর্ভপাত ঘটাচ্ছে। কিন্তু চর অঞ্চলে যে সকল গর্ভপাতের ঘটনা ঘটছে তার বেশির ভাগই সাস্থ্যগত ও কুসংস্কার এবং অনিরাপদ পদ্ধতিতে ঘটছে ফলে কিশোরী মা অকাল মৃত্যু বরণ করছে। বিশেষ করে ক্লিনিকের অদক্ষ কর্মী দ্বারা কিংবা তাদের ব্যবহৃত অপরিচ্ছন্ন মরচে ধরা যন্ত্রপাতির মাধ্যমে ইনফেকশন ঘটাচ্ছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে প্রসূতি মা।
উপরোক্ত প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে যে শিশুগুলো জন্ম নিচ্ছে তাদের মধ্যে নানারুপ প্রতিবন্ধীতা দেখা যাচ্ছে। চর এলাকার লোকজনের কাছ থেকে তথ্য নিয়ে জানা গেছে, চরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা মোটেও উন্নত নয়। চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে পারেন না মাতৃত্বকালীন রোগীরা। চরে প্রসবকালীন নানা রোগের সমস্যার কোনো সমাধানই মেলে না বলা চলে।
সন্তান প্রসবের মতো জটিল কাজটি করা হয় অদক্ষ ধাই দিয়ে। ধাইদের অদক্ষতার কারণে শিশুদের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থান আঘাত প্রাপ্ত হতে পারে। ডায়াবেটিস আক্রান্ত প্রসুতির সন্তানের আকার বড় হয়ে থাকে তাই তাকে সিজার ছাড়া স্বাভাবিকভাবে প্রসব করাতে গেলে সন্তানের মাথা কিংবা অন্যত্র আঘাত লেগে সন্তান প্রতিবন্ধী হবার আশংকা শতভাগ কিন্তু চর অঞ্চলে এরকম ঘটনা অহরহ ঘটছে। প্রয়োজনীয় মুহূর্তে অক্সিজেনের অভাবও একটা বড় সমস্যা। অনিরাপদ পানি পান, মাতৃত্বকালীন পুষ্টির অভাবও প্রতিবন্ধী শিশু জন্ম নেওয়ার উল্লেখযোগ্য কারণ। গর্ভাবস্থায় যেখানে মা, ভ্রুণ বা নবজাতকের একটি প্রতিকূল স্বাস্থ্য অবস্থার সম্মুখীন হওয়ার উচ্চ ঝুঁকি থাকে সেক্ষেত্রে অশিক্ষিত দম্পতির যৌন স্বাস্থ্য সংক্রান্ত উপযুক্ত জ্ঞান না থাকায় তাদের অনিয়ন্ত্রিত মেলামেশায়ও ভ্রুণ কিংবা ফিটাস আঘাত প্রাপ্ত হয়ে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম দিতে পারে। এ কারণে নদী কবলিত কুড়িগ্রাম জেলায় প্রতিবন্ধীর সংখ্যা প্রায় ৫৩ হাজার। সিরাজগঞ্জ জেলায় মোট প্রতিবন্ধীর সংখ্যা ৪০ হাজার ১৩৭ জন। চর এলাকায় প্রতিবন্ধীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বলে প্রাথমিক জরিপের তথ্য থেকে জানা গেছে।
কিশোরী গর্ভধারণের ক্ষেত্রে অবস্টেরিক ফিসটুলার ঝুকি থাকে। বাল্য বিয়ের শিকার একজন কিশোরী সন্তান ধারণে সক্ষম হলেও তার জনন অঙ্গ ভ্রুন গঠণ থেকে প্রসবের আগ পর্যন্ত যে সকল প্রয়োজনীয় বায়োলজিক্যাল সাপোর্টের প্রয়োজন এমন সক্ষমতা থাকেনা। বিশেষ করে ১০-১৫ বছর বয়সের কিশোরীদের পেলভিক বোন সন্তান ধারণ ও প্রসবের জন্য উপযুক্তভাবে গঠিত হয় না। তাদের অবস্টেরিক ফিস্টুলার মতো জটিল সমস্যার সম্ভাবনা থাকে প্রায় ৮৮%। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞদের মতে বিলম্বিত ও বাধাগ্রস্থ প্রসবের কারণে অবস্টেরিক ফিস্টুলার সমস্যা শুরু হয়। অসহনীয় শারীরিক যন্ত্রণার পাশাপাশি সামাজিকভাবেও অবহেলা এবং অবমাননার শিকার হন নারীরা। সন্তান প্রসবে বিলম্ব হলে মাতৃগহবরে থাকা শিশুর মাথা যখন মায়ের অপরিণত বা ছোট পেলভিক বোনে দীর্ঘামেয়াদী চাপ দেয় তখন টিস্যু নষ্ট হয়ে বার্থ ক্যানেলে সৃষ্ট এক ধরণের গর্ত নালী পথ তৈরী করে যার মাধ্যমে নারীর যোনিপথ ও পায়ুপথের সংযোগ ঘটে। ফলে প্রস্রাব বা পায়খানা নির্দিষ্ট পথে না হয়ে পায়ু পথে মুত্র কিংবা মুত্র পথে পায়খানা নির্গত হয়ে একটি বিব্রতকর ও যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ফিস্টুলার মতো জটিল শারীরিক রোগের চিকিৎসা সাধারণত: অভিজ্ঞ সার্জন দ্বারা অপারেশনের মাধ্যমে করা ছাড়া আর কোন উপায় নাই (UNCF, 2005)। সাধারণত: চরাঞ্চলের গরীব কিংবা অসহায় রোগীর পক্ষে অনেক সময় এ ধরণের ব্যয়বহুল চিকিৎসা করানো সম্ভব হয় না। প্রতি বছর দেশে ২০ হাজার নারী অবস্টেরিক ফিস্টুলা সমস্যায় ভুগছেন। তাদের ৮২ শতাংশই চিকিৎসার বাইরে। এর সঙ্গে প্রতিবছর আরও ২ হাজার রোগী নতুন করে যুক্ত হচ্ছেন। এ অবস্থার জন্য বাল্য বিবাহ এবং কিশোরী বয়সে মা হওয়ার প্রবণতাই বেশি দায়ী। চরাঞ্চলের মেয়েদের এ দুটি কারণ বিদ্যামান থাকায় এ ধরণের রোগীর সংখ্যা অধিক। বাংলাদেশে এখনও প্রতি লাখে ৩২০ জন মা প্রসবকালীন সমস্যায় মারা যায় (NIPORT, 2014) আর চরাঞ্চলে তো কোন হাসপাতাল, ক্লিনিক দুরের কথা সেখানে প্রশিক্ষিত কোন ধাত্রীও নেই কাজেই সেখানে এরকম মৃত্যু হার আরও বেশি হতে পারে।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের অন্যতম কার্যকর উপায় হলো শিক্ষা। তাই, মেয়েদের শিক্ষার সুযোগ প্রদান, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, বিবাহ বিলম্বিত করতে এবং তাদের জীবন সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে মেয়েদের ক্ষমতায়ন করতে সাহায্য করতে পারে একমাত্র শিক্ষা। ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর তার ‘বাল্য বিবাহের দোষ’ প্রবন্ধে বলেছেন ‘বিয়ে করে যার সঙ্গে একটি মেয়েকে সারাজীবন কাটাতে হবে, যার আচার-ব্যবহার, চরিত্র তথা মানসিকতার ওপর মেয়েটির ভবিষ্যৎ সুখ-দুঃখ নির্ভরশীল, তাকে জেনে-বুঝে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার মেয়েটির আছে।’ আজকের এ যুগে এ অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রয়োজন মেয়েদের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেয়া। চর অঞ্চলে যে প্রাথমিক বিদ্যালয় গুলো আছে সেগুলোর গঠন কাঠামো এমন হতে হবে যাতে বন্যা বা অতি বর্ষায় এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সহজেই স্থানান্তর করা যায় এবং তা হতে পারে বিশেষ ধরণের কোন কাপড় বা প্লাস্টিকের নির্মিত তাবু। প্রতিটি বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বন্যাকালীন সময়ে প্রয়োজন মাফিক জলযান বা নৌকার ব্যবস্থা রাখা প্রয়োজন। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়াশোনর পর শিক্ষার্থীদের যাতে পড়াশোনা বন্ধ হয়ে না যায় সেজন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় নির্দিষ্ট সংখ্যক মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। যতদিন মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা যায় নি ততদিন উম্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বা উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষা পদ্ধতির মাধ্যমে শিখন ব্যবস্থা চালু রাখা। যেহেতু চরাঞ্চলে শিক্ষকরা থাকতে চান না সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের চরভাতা চালু করার পাশাপাশি বিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ করে শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়গুলোর জন্য শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তা হলে বদলী বা অন্য কোন কারণে শিক্ষক ঘাটতির সুযোগ থাকবে না। একমাত্র শিক্ষাই তাদের কাছে প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে টিকে থাকতে সাহায্য করবে। চরের জন্য এরকম ব্যবস্থা যুগ যুগ ধরে চালু রাখার প্রয়োজন হয়তো বা হবে না। এভাবে সুযোগ পেলে একটা সময় চরের একটি বিরাট শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরী হয়ে যাবে এবং তারাই নিজেদের স্কুল, কমিউনিটি ক্লিনিক বা কৃষি খামারে কাজ করতে পারবে। সরকারের পক্ষে চরের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমুল পরিবর্তন আনা সম্ভব। তার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন সুবিধা দেখলেই বোঝা যায়। মাত্র দুই বছরে ভাসান চরে ১ লক্ষ রোহিঙ্গাদের জন্য ক্লাস্টার হাউজ, সাইক্লোন সেন্টার, শৌচাগার, খাদ্য গুদাম, রাস্তা-ঘাট, হাট-বাজার, অস্থায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, খেলার মাঠ, বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা এবং কর্মসংস্থানের মত এত সব সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। চরাঞ্চলে পুরুষের চেয়ে নারীদের সমস্যা বেশি। সমতা ও সম্পদ- দুই দিক থেকেই তারা পিছিয়ে আছে। নারী ও কিশোরীদের সমস্যার যেন শেষ নেই আর তা দুর করতে পারে একমাত্র শিক্ষা।
লেখক: অধ্যক্ষ, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, কুড়িগ্রাম
সারাবাংলা/এএসজি
চরাঞ্চলে বাল্যবিবাহ ও প্রতিবন্ধীতা প্রফেসর মীর্জা মো. নাসির উদ্দিন মত-দ্বিমত