Wednesday 12 Mar 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

গ্রিন গার্মেন্টস ও একটি সামাজিক উদ্যোগ

মামুনুর রশিদ চৌধুরী
১২ মার্চ ২০২৫ ২০:৩২

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ও পরিবর্তনে গার্মেন্টস শিল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের মধ্যেই অর্থনৈতিক মুক্তির যে বীজ প্রোথিত ছিল, তা গার্মেন্টস শিল্পের মাধ্যমে অনেকটাই পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। গার্মেন্টস শিল্পের পথে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা প্রায় পাচঁ দশকের। আজ এদেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি আর গার্মেন্টস শিল্প একই সুতোয় বাঁধা। ১৯৭৭ সালে ২৫ জুলাই রিয়াজ গার্মেন্টসের উৎপাদিত পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল। তা আজও বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাজারের পর ব্রাজিল, রাশিয়া, চীনের মত বৃহৎ বাজার দখলের প্রচেষ্টা এখন গার্মেন্টস শিল্প উদ্যোক্তাদের। এই শিল্পে চীন বাদ দিলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরী পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক দেশ। বিশ্বের ৪১০ বিলিয়ন ডলারের গার্মেন্টস পণ্যের বাজারে চীন ৩৭% আর বাংলাদেশ ৮% দখল করে আছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের জন্ম এবং এর বিস্ময়কর উত্থান রূপকথার মতো। ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম সংস্থাপন সচিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা, ডাকসাইটে আমলা নূরুল কাদের’র দেশ গার্মেন্টস এবং কোরিয়ার দ্যাইয়্যু কর্পোরেশনের উদ্যোগে এদেশের ১২৩ জন কর্মীকে দক্ষ হিসাবে গড়ে তোলার কর্মসূচী গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশকে ত্বরান্বিত করে। চট্টগ্রামের কালুরঘাটে অবস্থিত দেশ গার্মেন্টস থেকে প্রথম চালানে প্রায় ১২০০০ ডলারের উৎপাদিত পোশাক রপ্তানি করে দেশে আলোড়ন তৈরী করেছিল। এরই ধারাবাহিকতায় ৮০’র দশকে গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের জন্য এক বিপুল সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দেয়। শ্রীলংকার অভ্যন্তরীন রাজনৈতিক সংকট আমাদের এ শিল্পের বিকাশকে দ্রুততর করে। নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও দেশের একদল নতুন শিল্প উদ্যোক্তা শিল্পায়নের স্বপ্নে জড়িয়ে পড়েন গার্মেন্টস শিল্পে। পুঁজি বলতে সামান্য অর্থ আর দৃঢ় সংকল্প। এই দু’য়ের চেয়েও তাদের বড় পুঁজি ছিল চোখভরা দিগন্ত বিস্তৃত স্বপ্ন। যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপের বাজার দখলের যে স্বপ্ন সেটা তো কোন সাধারণ স্বপ্ন নয়, বিশেষ করে বাঙালি শিল্প উদ্যোক্তাদের জন্য। এই স্বপ্নের পথে যারা অভিযাত্রা শুরু করেন তাদের কাছে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ সর্বোপরি পাশ্চাত্যের কোন দেশ মানেই, বিশ্ব মানচিত্র বা ভূগোল বইয়ের পাতা দেখা ও পড়া কোন দেশ।

বিজ্ঞাপন

অনেক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে এদেশের গার্মেন্টস শিল্প আজ শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী উদ্যোগ আজ পুরো জাতির গর্বের বিষয়। ১৯৯০ সালের পর থেকে এদেশের শিল্পখাতের অন্যতম খাতে পরিণত হয়েছে গার্মেন্টস শিল্প। ১৯৯৬ সাল থেকে রপ্তানি বানিজ্যে শীর্ষে অবস্থান করছে এই শিল্প। দেশের রপ্তানী আয়ের প্রধান এই শিল্প খাতের গর্ব- পরিবেশবান্ধব কারখানায় প্রতিযোগী দেশগুলোর কেউই বাংলাদেশের ধারে কাছে নেই। আশা করছি, বৈশ্বিক এ স্বীকৃতি পোশাকের দাম বাড়াতে সহায়তা করবে। এদেশের রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে পোশাক শিল্প খাত থেকে। তবে মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যে এ খাত নিয়ে চরম শঙ্কা তৈরি হয়- বাতিল হয়েছিল অনেক অর্ডার। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলা করে স্বরূপে ফিরতে খুব বেশি দেরি হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানে বাতিল হওয়া অর্ডারগুলো পুনরায় ফিরে আসতে থাকে। ফলে করোনার মাঝেও চমক দেখিয়েছে পোশাক খাত। একই সঙ্গে বেড়েছে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা বা গ্রিন ফ্যাক্টরির সংখ্যাও। ২০১২ সালে প্রথম পরিবেশবান্ধব গার্মেন্টস কারখানার যাত্রা শুরু হয় পাবনার ঈশ্বরদী ইপিজেডের ‘ভিনটেজ ডেনিম স্টুডিও’-এর মাধ্যমে। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিলের (USGBC) তত্ত্বমতে বাংলাদেশে এখন সবুজ গার্মেন্টসের সংখ্যা ২৩০টি। এর মধ্যে প্লাটিনাম ক্যাটাগরি ৯২টি, গোল্ড ক্যাটাগরি ১২৪টি, সিলভার ক্যাটাগরি ১০টি ও সার্টিফাইড ক্যাটাগরি ৪টি। এছাড়া ৫৫০টির বেশি কারখানা গ্রিন ফ্যাক্টরির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পাইপলাইনে রয়েছে। বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি LEED ফ্যাক্টরির মধ্যে বাংলাদেশেই ৬২টি কারখানা। শুধু তাই নয় শীর্ষ ১০টি কারখানার মধ্যে ৯টি এবং সর্বোচ্চ রেটিং শীর্ষ ২০টি LEED সবুজ কারখানার মধ্যে ১৮টিই বাংলাদেশে। এগুলোর মধ্যে মীর্জা শামস এর এসএম সোর্সিং লিমিটেড ১১০ এর মধ্যে ১০৬ স্কোর নম্বর পেয়ে বিশ্বব্যাপী সর্বোচ্চ LEED গ্রিন কারখানা হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার পাশাপাশি প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়াতে এলইইডি (LEED) সার্টিফিকেট গুরুত্বপূর্ণ। বিগত পাঁচ দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ার পেছনে পেছনে আমাদের যে যাত্রা তার মূলে রয়েছে শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ, বিশেষ করে শ্রমনির্ভর ম্যানুফ্যাকচারিং গার্মেন্টস খাত। ৭০ দশকের শেষের দিকে যাত্রা শুরু করে এরই মধ্যে বিশ্ববাজারে আমরা দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে নিজেদের অবস্থান তৈরি করেছে।

গার্মেন্টস শিল্পে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান এবং পরোক্ষভাবে প্রায় ১ কোটি মানুষের জীবিকার প্রধান উৎস। এ শিল্পের জিডিপিতে অবদান ১১ শতাংশ। দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে অব্যাহত অবদান রাখার পাশাপাশি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিকের ক্ষমতায়ন এবং সবুজ শিল্পায়নেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে এ শিল্প। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অডিট প্রতিষ্ঠান ‘কিউআইএমএ’ বাংলাদেশের পোশাক খাতকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এথিক্যাল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প হিসেবে চিহ্নিত করেছে। পরিবেশবান্ধব সবুজ শিল্পায়নেও আমাদের গার্মেন্টস খাত অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। ক্রম পরিবর্তনশীল আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনে শিল্পের ভূমিকার বিষয়টিকেও নজর রাখতে হচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণাটি আমাদের দেশে নতুন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণা আমাদের গার্মেন্টস শিল্পে ব্যাপকভাবে চালু হওয়ায় গোটা অর্থনীতিতে এয় চমৎকার অনুকূল প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। আমাদের গার্মেন্টস খাত থেকে ৫০ বিলিয়ন ডলার আয়ের যে রূপকল্প নির্ধারণ করা হয়েছে, তার যথাযথ বাস্তবায়নে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার দ্রুত বিকাশ সবাইকে আস্থাশীল করে তুলেছে। সাভারে রানা প্লাজা ধস কিংবা তাজরিন পার্মেন্টস এ ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছিল, এর ফলে ভাটা পড়েছিল এ খাতে। বিদেশি ক্রেতারাও আস্থার সংকটে পড়েছিল। বড় ধরনের ধাক্কা খাওয়ার পর ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প। পরিবেশবান্ধব টেকসই কারখানা বা ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠায় রীতিমতো তুমুল প্রতিযোগিতা শুরু হয় উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এর মাধ্যমে সারা দেশে একে একে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি। এগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণাটি আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। দিনে দিনে আরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে পরিবেশবান্ধব গ্রিন ফ্যাক্টরি।। আগামীতে আরও অনেকগুলো গার্মেন্টস কারখানাকে সবুজায়নের আওতায় আনার প্রক্রিয়া জোরেশোরে চলছে।

শ্রমিকবান্ধব গার্মেন্টস কারখানা প্রতিষ্ঠায় মালিকদের আন্তরিক প্রচেষ্টা সুফল বয়ে এনেছে, অর্থনীতিতে নতুন প্রত্যাশা সৃষ্টি করেছে বলা চলে। গার্মেন্টস শিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণা নিঃসন্দেহে নতুন জাগরণ সৃষ্টি করেছে উদ্যোক্তাদের মধ্যে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণা দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে সন্দেহ নেই। এতে বিদেশি ক্রেতারা অবশ্যই আকৃষ্ট হবেন জোর দিয়ে বলা যায়। রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে যাবে বহুগুণ। বর্তমানে যারা নতুন কারখানা চালু করছেন, তারা গত কয়েক বছরে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকেই কারখানা স্থাপন করছেন, তা বলাবাহুল্য। কারণ তারা উপলব্ধি করেছেন এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কারখানা না হলে বিদেশি ক্রেতারা অর্ডার দেবেন না। তাই উদ্যোক্তারা ব্যবসার আইনকানুনের পাশাপাশি দেশের প্রচলিত বিভিন্ন আইন মেনে তাদের ব্যবসা পরিচালনা করছেন। আবার সম্পূর্ণ কমপ্লায়েন্ট না হলে নতুন কোনো কারখানাকে ‘বিজিএমইএ’ থেকে অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। একটি পরিবেশবান্ধব পোশাক কারখানায় উৎপাদনের প্রতিটি ধাপে পানি, বিদ্যুৎ, রং এবং বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার পরিবেশবান্ধব উপায়ে হচ্ছে কিনা তা দেখা হয়। অধিকাংশ পোশাকশিল্প কারখানা ইটিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে গতানুগতিক ইটিপির পরিবর্তে বায়োলজিক্যাল ইটিপি ব্যবহার করছে, যা আমাদের সবুজ বিপ্লবেরই একটি ইতিবাচক ইঙ্গিত। বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হলে টেকসই উন্নয়নের বিকল্প নেই। তাই বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুদৃঢ় করে তুলতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় মনোযোগী হতে হবে। পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নে অর্থায়নের পাশাপাশি এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল ও করপোরেট গভর্ন্যান্স (সিএসজি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকে আরও গুরুত্ব সহকারে দেখতে হবে। বিশ্বব্যাপী ভোক্তাদের টেকসই ও স্বল্প কার্বনফুট প্রিন্ট সম্পন্ন পোশাকের প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বেড়ে চলেছে এবং জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলোও পরিবেশবান্ধব পোশাক তৈরির নিত্যনতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কনজুমারদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, পরিবেশের সুরক্ষা। পরিবেশবান্ধব, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হলেও গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ চ্যলেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে। অনেক বাধা, বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। গার্মেন্টস সামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্টস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছেন। যে সব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই শুধু তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এ জন্য এখন গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক ধরনের অগ্রাহ্য করা হয়েছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনেও বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আর্থিক ক্ষেত্রে গ্রিন ব্যাংকিং ধারণার বিকাশ সময়ের দাবি হয়ে উঠেছিল। বর্তমানে যা দারুণ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রিন ব্যাংকিং ধারনার অনুসারী হয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে। যার চমৎকার ফলাফল ক্রমেই অর্থনীতিতে সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। একইভাবে গার্মেন্টস শিল্পে গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার পরিপূর্ণ বিকাশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আরও এগিয়ে নেবে- আমাদের দৃঢ়বিশ্বাস। গ্রিন ফ্যাক্টরি কার্যক্রমকে বিশেষ প্রণোদনা প্রদানের ব্যাপারে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করলে এ ক্ষেত্রে চমৎকার গতির সঞ্চার হবে আশা করা যায়। একটি বিষয় এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন। তা হলো, গ্রিন ফ্যাক্টরি করতে প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ দরকার। একটি ফ্যাক্টরি করতে ২০০ থেকে ৩০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়। এর পাশাপাশি জমিও লাগে ৩ থেকে ১০ বিঘা। দেশের এ পর্যন্ত যে সব কারখানা গ্রিন ফ্যাক্টরির খেতাব জিতে নিয়েছে তাদের বেশিরভাগ উদ্যোক্তার বিনিয়োগই ছিল ৫০০ কোটি থেকে ১১০০ কোটি টাকার মধ্যে। গ্রিন ফ্যাক্টরির স্বীকৃতি। লাভ করতে হলে একটি প্রকল্পকে ইউএসজিবিসির তত্ত্বাবধানে নির্মাণ থেকে উৎপাদন পর্যন্ত বিভিন্ন বিষয়ে। সর্বোচ্চ মান রক্ষা করতে হয়। ভবন নির্মাণ শেষ হলে কিংবা পুরোনো ভবন সংস্কার করেও আবেদন করা যায়।

এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এ ধরনের গ্রিন ফ্যাক্টরি প্রকল্পের জন্য উদ্যোক্তাকে উৎপাদনের শুরু থেকে কারখানা গুটিয়ে নেয়া বা ধ্বংস হওয়ার আগ পর্যন্ত কার্যক্রম পরিচালনায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে হয়। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো, পরিবেশের সুরক্ষা। পরিবেশবান্ধব, বিদ্যুৎ, পানি ও গ্যাস সাশ্রয়ী, স্বাস্থ্যসমাত পরিবেশে উৎপাদন প্রক্রিয়া চালু রাখা কঠিন চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচিত হলেও গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হচ্ছে আমাদের গার্মেন্টস ঘাতকে। অনেক বাধা-বিপত্তি প্রতিকূলতা, ষড়যন্ত্র উপেক্ষা করে আমাদের গার্মেন্টস খাতকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী এখন পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সবাইকে আলাদা মনোযোগ দিতে হচ্ছে। গার্মেন্টস সামগ্রী ক্রেতা দেশ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা, গোষ্ঠী এখন গার্মেন্টস উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পরিবেশবান্ধব, শ্রমিকবান্ধব নানা শর্ত আরোপ করছেন। যেসব শর্ত পূরণের মাধ্যমেই শুধু তাদের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব। আর এ জন্য এখন গার্মেন্টস শিল্পে কমপ্লায়েন্সকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হচ্ছে। অতীতে এ বিষয়টিকে এক ধরনের অগ্রাহ্য করা হয়েছে। গ্রিন ফ্যাক্টরি ধারণার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার পেছনেও বিদেশি ক্রেতাগোষ্ঠীর চাপ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। আন্তর্জাতিক ফিন্যান্স সময়ে নানারকম ঝড়ঝঞ্চা এলেও দক্ষতার সঙ্গে আমাদের গার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা সেগুলো সামাল দিয়েছে।

রিয়াজ গার্মেন্টসের হাত ধরে চলা এই পোশাক রপ্তানি এরই মধ্যে বিশ্বে পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়তে উন্নতি ঘটছে। ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশ পোশাক রপ্তানিতে ভালো করছে। আমরা অনেকেই হয়তো জানি বা জানি না, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে একজন বাংলাদেশের তৈরি ডেনিম জিনস প্যান্ট ব্যবহার করে। আর ইউরোপীয়দের মধ্যে প্রতি তিনজনে একজন বাংলাদেশের তৈরি টি-শার্ট ব্যবহার করে। এটি বাংলাদেশের জন্য গর্বের। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিদেশে পোশাক রপ্তানি হয়েছে ৪২.৬১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের, যা মোট রপ্তানির ৮১.৮১ শতাংশ। দেশের জিডিপির কম বেশি ১১ শতাংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে। তৈরি পোশাক রপ্তানির বিশ্ববাজারের প্রায় ৮ শতাংশ স্থান দখল করে আছে বাংলাদেশ। এর অর্থ বিশ্ববাজারের আরো বেশি অংশ করায়ত্ত করার বিশাল সুযোগ রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। ২০৩০ সালের মধ্যে পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ শিল্পে কর্মসংস্থান হয়েছে কম-বেশি ৪০ লাখ মানুষের। এর মধ্যে কম-বেশি ৭০ শতাংশ মহিলা। পরোক্ষভাবে কম-বেশি ৫ কোটি মানুষ এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাজারে বাংলাদেশ দক্ষতার সঙ্গে তার অবস্থান ধরে রেখে নতুন নতুন বাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে আমল কবিশ্বে বালামেন্টস কারখানায় কর্মরত কর্মীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত প্রশিক্ষণ হচ্ছে।

পণ্যের মান ও ডিজাইন আধুনিক করার পাশাপাশি ক্রেতাদের রুচি এবং তাদের ভবিষ্যৎ চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে গবেষণার মাধ্যমে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানি বৃদ্ধি অব্যাহত রাখা হচ্ছে। পোশাক শিল্পের হাত ধরেই দেশের অর্থনীতিতে এসেছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। শ্রমঘন এ শিল্পের মাধ্যমে দরিদ্র দূরীকরণ, কর্মসংস্থান ও নারীর ক্ষমতায়ন বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের সুবিধা এ বিগত নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে।

এছাড়াও আরো ৫৫০টি গার্মেন্টস কারখানাকে পরিবেশবান্ধব কারখানায় রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ চলছে। সাধারণত অন্যান্য গার্মেন্টসের চেয়ে পরিবেশবান্ধব গার্মেন্টসের খরচ ৫-২০ শতাংশ বেশি হয়ে থাকে। গত চার দশকে একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত করার পেছনে সরকারের নীতি এবং শিল্পের অভাবনীয় বিকাশ কাজ করছে। দেশের সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নে অব্যাহত অবদান রাখার পাশাপাশি, নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত, শ্রমিকের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা এবং পরিবেশবান্ধব সবুজ শ্রমঘন শিল্প হিসেবে গার্মেন্টস সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের যুগে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় পরিবেশ ও জলবায়ুর বিষয়গুলোকে বিদেশি বায়ার অর্থাৎ তৈরি পোশাকের বিদেশি ক্রেতারা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। ফলে দ্রুত পরিবর্তনশীল ও প্রতিযোগিতামূলক বিশ্ব বাণিজ্যে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা এবং সবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে পরিবেশবান্ধব কারখানা তৈরির বিকল্প নেই।

গামেন্টস শিল্পের শ্রমিকরাই প্রাণ- শ্রমিক সহজলভ্যতার জন্যই এই শিল্পের বিকাশ। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গ্রিন ফ্যাক্টরি বাংলাদেশকে নতুনভাবে তুলে ধরেছে, আর এই শিল্পের বিকাশে প্রধান অনুষঙ্গ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি। এই জনশক্তির কর্মদক্ষতা স্বাভাবিক রাখার জন্য কর্মীদের নিরাপদ স্বাস্থ্য সচেতনতাবোধ তৈরির পাশাপাশি প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরি। যেহেতু বাংলাদেশের (০৫) পাঁচ কোটি নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছে যাদের বয়স ৯ থেকে ৪৫+ সেইজন্য সবুজ গার্মেন্টস্ শিল্প তথা সকল গার্মেন্টস্ শিল্পের কর্মীরা এই জরায়ুমুখ ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছে। কারণ এই শিল্পে কর্মরত কর্মীদের গড় বয়স ১৮ থেকে ৪০ বছর । বিধায় এসব নারী শ্রমিকদেরকে সচেতন করার পাশাপাশি জরায়ু ক্যান্সারের প্রতিরোধক টিকা গ্রহনে উৎসাহিত করা জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর বাংলাদেশে ৫ লাখ ৭০ হাজার নারী জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং ৩ লাখ ১০ হাজার নারী মৃত্যুবরণ করে। বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৭,৬৮৬ জন নারী এ জরায়ু ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১০৩৬২ জন মৃত্যুবরণ করে। প্রতিদিন ১৮ জন জরায়ু ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী মারা যায়।

নিরাপদ কর্মীই পারে উৎপাদনশীল কারখানার পণ্য উৎপাদনের গতি স্বাভাবিক রাখতে। তাই এদের নিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠান সিএসআর হিসেবে নারী কর্মীদেরকে সুস্থ ও স্বাভাবিক রাখার নিমিত্তে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস এ, কলেরা, নিউমোনিয়া ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিষেধক ভ্যাকসিন গ্রহনে উৎসাহী ও প্রদানে সহযোগিতা করা জরুরি। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পে কর্মীদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহন করছে সুপরিচিত ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান ‘ভিশন এন্টারটেইনমেন্ট’। প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যে বাংলাদেশের আইন অঙ্গনের প্রধান স্থান বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের সকল সম্মানিত বিচারপতি ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের পাশাপাশি কর্মরত সকল জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল কর্মকর্তাদের মাঝে স্বাস্থ্যসচেতনতামূলক বিভিন্ন কর্মসূচি আয়োজন ও টিকাদান কর্মসূচী বাস্তবায়ন করেছে। তাই ‘ভিশন এন্টাটেইনমেন্ট’ গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকদের মাঝে স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক কর্মসূচীর উদ্যোগ গ্রহন করেছে।

গার্মেন্টস শিল্পের মালিকদের আন্তরিক সহযোগিতা পেলে ‘ভিশন এন্টারটেইনমেন্ট’ এ ধরনের কর্মসূচী বাস্তবায়নে আগ্রহী। ভিশন এন্টারটেইনমেন্ট বিশ্বাস করে গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত দক্ষ নারী কর্মীরা যেভাবে এদেশের শিল্পায়ন বিকাশে অর্থনীতির ভিত্তি তৈরিতে ভূমিকার পাশাপাশি এসব নারী কর্মীরা সুস্থ সুন্দর পরিবেশে সন্তান জন্ম দিয়ে আগামী দিনের সুনাগরিক গড়ে তুলতেও ব্যাপক ভূমিকা রাখছে। আগামী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে এসব কর্মীরা যেভাবে নিরলস শ্রম ও একাগ্রতার সাথে কাজ করে যাচ্ছে সেজন্য তাদের নিয়োগকৃত প্রতিষ্ঠানসহ বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোCSR) তহবিলের মাধ্যমে টিকাদান কর্মসূচী বাস্তবায়নে উদ্যোগী হলে আগামীর বাংলাদেশ আরও কর্মীবন্ধর দেশ হিসেবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। গ্রিন ফ্যাক্টরি যেমন আজ আমাদের গর্বের প্রতীক, তেমনি সুস্থ কর্মীরাও এই গর্বের অন্যতম অংশীদার। আসুন ওদেরকে সুস্থ রাখার জন্য আমাদের স্বাস্থ্য সচেতনতা কর্মসূচী বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে কর্মীদেরকে নিরাপদ রাখি- আগামীর সুন্দর বিনির্মাণে।

লেখক: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক

সারাবাংলা/এএসজি

গ্রিন গার্মেন্টস মত-দ্বিমত মামুনুর রশিদ চৌধুরী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর