Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

এটা ফুটবল প্রেম নাকি পরকীয়া?


২৪ জুন ২০১৮ ১২:০১ | আপডেট: ২৪ জুন ২০১৮ ১২:২২
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সবাই প্রস্তুত। ঘাটে ট্রলার (ইঞ্জিন চালিত নৌকা) বাঁধা। ঘরে ঘরে সবাই দুপুরের খাবার খেয়ে নিচ্ছে। খাওয়া শেষে সবাই ট্রলারে চেপে বসবে। আমি শুধু ছুটছি। একবার মায়ের কাছেতো আরেকবার দাদির কাছে তদবির। কিন্তু কেউই আমার কথায় আস্থা রাখতে পারছেন না। তাই অনুমতিও মিলছে না।

কিভাবে যাব জানিনা, শুধু জানি ট্রলারে আমাকেও উঠতে হবে সময়মতো। এদিকে, কাউকে কিছু না বলেও যাওয়া যাবে না। একা একা গেলে যদি হারিয়ে যাই- সেই ভয়ও রয়েছে মনে।

গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলো তখনকার দিনে কেমন যেন ছিলো। খেলাধুলা কিংবা আমোদ ফুর্তিতে অংশ নিতে বাড়ির মুরুব্বিরা বয়স নির্ধারণ করে দিতেন। অন্তত ক্লাস নাইন/টেনের বারান্দায় পা না রাখলে কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষ করে খেলার মাঠে কিংবা দূরের কোনো মেলায়।

বিজ্ঞাপন

বেশ দিশেহারা হয়ে বাড়ির উঠানে হাঁটছি। মাকে অনেক অনুরোধ করেছি। কাজে আসলো না। দাদিও কিছু বলছেন না। ছোট কাকা কিংবা গ্রামের অন্য কারো হাতে আমাকে ছেড়ে দিতে তাদের সাহস নেই।

আজ ফাইনাল খেলা। নিশ্চিত কাইজ্জা (ঝগড়া) হবে। কাইজ্জা শুরু হলে আমি তাদের জন্য তখন হয়তো সমস্যা হয়ে দাঁড়াবো! ছোট মানুষ গোলমাল শুরু হলে কই যাবো?

তবে খেলা আমি দেখবই। সকল ভাবনার হিসেব চুকিয়ে সবার আগে ট্রলারে উঠে বসে রইলাম। তারপরেও কেন যেনো ভয় হচ্ছে। কাকারা এসে যদি নামিয়ে দেয়। ভয়ে ভয়ে সময় ঘনিয়ে আসছে।

একে একে গ্রামের সবাই ট্রলার ঘাটে। যাত্রা শুরু হবে। কেউ আমাকে মেনে নিতে পারছেন না। আমি তখন বাড়ির ছোট ছেলে। ততটা ছোট, যতটা ছোট হলে বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ থাকে।

প্রাইমারি স্কুলের গন্ডি শেষ হয়নি। কোনো বন্ধুর আমার মতো সাহসি নেই। থাকলে হয়তো তাদের সাথে নিয়ে চলে যেতাম। নিরুপায় হয়ে ট্রলারে বসে আছি।

অনেকে অনেক কিছু বলছে। ছোট কাকা এসে রীতিমত রাগারাগি। পরে ইউনুস মোল্লা এসে আমার পক্ষ নিলেন। তিনি কাকাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে আমাকে নিয়ে যেতে সম্মতি দিলেন।

আমি বেশ মজা করেই বসলাম। ট্রলার ঘাট থেকে ছেড়ে যাবার পরেই “হাওয়া হাওয়া” গান শুরু হলো। সবাই মজা করছে। আমি শুধু ভাবছি। ভাবনায় খেলা। ঢাকা থেকে খেলোয়াড় আনা হয়েছে। নিশ্চিত অনেক ভালো খেলা হবে।

গোহালা থেকে দিগনগর খুব বেশি দুর নয়। আধাঘন্টা ট্রলার চলার পরেই দিগনগর ব্রিজের দেখা পেলাম। খেলার মাঠ থেকে হিন্দি আর বাংলা গানের আওয়াজ ভেসে আসছে। জমজমাট খেলার আয়োজন। সুতোর সাথে লাল, হলুদ, বেগুনী রংয়ের কাগজ দিয়ে মাঠ সাজানো।

দুটি ট্রলারের পাশ ঘেঁষে আমাদের ট্রলার ভিড়ল। ছোট কাকা হাত ধরে নামালেন। মাঠে তিল ধারনের ঠাঁই নেই। এ যেন আরেক বিপত্তি, কোনোভাবেই মাঠের খেলা দেখা যাবে না। কপালে লাল শালু বেঁধে হাতে বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন সেচ্ছাসেবকরা। বিভিন্ন পাশ ঘুরে কাকা চেষ্টার লড়াইয়ে ব্যর্থ হলেন। তাতেও আমি বেজার নই। মাঠে অসছি এ যেনো অন্যরকম এক সুখ।

চার টাকার বাদাম কিনে দিয়ে আমাকে ট্রলারে ছাদে রেখে কাকা খেলা দেখতে গেলেন। আমি বাদাম খাই আর মাইকের উত্তেজিত ধারাভাষ্য শুনছি। হঠাৎ বাঁশির আওয়াজ। বেশ কিছুক্ষণ নিরব। কেমন যেনো হাউ-কাউ। তারপর মাইকের অনুরোধের চিৎকার। বার বার ঘোষণা হচ্ছে- আপনারা থামুন, কেউ গোলমাল করার চেষ্টা করবেন না। এরপর যা ঘটলো সেই ঘটনার আশঙ্কাতেই আমাকে কেউ আনতে চায়নি মাঠে।

একদল মানুষ ধর ধর বলে চিৎকার। সবাই দিকবিদিক ছুটছে। খেলার দর্শকরা তাদের ট্রলারে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছেন। কাকা আমাদের ট্রলারে দিকে তাকালেন। আমাকে দেখে চিন্তামুক্ত হলেন। পরে সবাই ঘরে ফিরলাম।

দুই/এক বছর আগে পেশাগত কারণে একবার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম গিয়েছিলাম। সেদিন সম্ভবত আফগানিস্তানের সাথে বাংলাদেশের খেলা ছিল। ফুটবল খেলা বলে কথা। না দেখে চলে আশা যায়? দুঃখজনক হলেও সত্য- সাত/আট মিনিট খেলা দেখেছিলাম। থাকতে পারিনি। আসলে খেলোয়াড়দের খেলায় কোনো মায়া ছিলো না।

সেদিন বাংলাদেশের জাতীয় টিমের খেলা দেখে মনে পড়ে আমার স্কুল মাঠের কথা। তখনও আমরা ছোট। বড়রা ছিলেন অসিম দা, উত্তম দা, টিপু ভাই। তাদের ছোট ছিলেন কায়ুম ভাই, জাহাঙ্গীর ভাই, হালিম ভাই ও ইকবাল ভাইদের বন্ধুমহল। তখন আমরা সবেমাত্র গোহালা টিসিএএল উচ্চ বিদ্যালয় যাওয়া আশা শুরু করেছি।

আমাদের স্কুলের মাঠ কোনো জাতীয় স্টেডিয়ামের থেকে অসুন্দর নয়। মাঠের চারপাশের রাস্তা ছিলো আমাদের গ্যালারি। প্রতিদিন বিকালে ফুটবল খেলা হতো। আমরা ছুটে যেতাম। আমরা ছুটতাম ঠিক বিকেল চারটার দিকে। বড়দের আগে আমরা একটু খেলে নিতাম। তারপর বসে থাকতাম। খেলোয়াড় কম থাকলে আমরা সুযোগ পেতাম।

দিগনগর, গোহালা, রাগদী, ননখীর, জলিরপাড়, খালিয়া কিছু ইউনিয়নের নাম। সারা পৃথিবীতে যখন ফুটবল উম্মাদনায় কাতর আমার মনে পড়ছে এসব ইউনিয়নের সেইসব দিনের কথা। প্রতিবছর বিভিন্ন নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট ছাড়া হতো। গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর ও মাদারীপুর জেলার রাজৈর থানার প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নের নিজস্ব টিম খেলায় অংশ নিতো। আমরা খেলা উপভোগ করতাম।

মাদারীপুর জেলার শাহারপাড় এলাকা থেকে ১৬ টিমের খেলার আয়োজন করে। খেলার ফাইনালে গিয়ে মজার ঘটনা ঘটে। গোহালা যুব সংঘ ও শাহাপাড় একাদশ। এই খেলা কেন্দ্র করে মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ জেলার সবাই ঝাঁপিয়ে পড়েন। মাদারীপুরের নেতারা চান তাদের খেলা তারা জয়ী হবেন। আর গোপালগঞ্জবাসী চায় বিজয় আমাদের।

ওই খেলার উপহার ছিলো ২০ ইঞ্চি কালার টিভি। টিভিটা শুধু টিভি ছিলো না। ওই টিভিতে ছিলো দুটি জেলার সম্মান। যতটুকু মনে পড়ে সেই খেলায় গোহালা ঢাকা থেকে টিম ভাড়া নেয় আর শাহারপাড় খুলনা থেকে একটি বিশেষ বাহীনির ফুটবল টিম আনে। খেলোয়াড়দের সম্মানীর টাকা গ্রামে গ্রামে চাঁদা তুলে সংগ্রহ করা হয়। প্রায় দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা খরচ হয়।

ওই খেলাটাই ছিলো আমার জীবনের শেষ খেলা। কারণ সেই খেলাতেও গোলমাল হয়। নব্বই দশকের শেষ দিকে টেকেরহাট কবির মাঠের খেলায় গোলমাল হয়। প্রায় একই সময় জলিরপাড় ও ননখীর এলাকার খেলাগুলোতে গোলমাল হয়।

প্রায় দশ বছর পর আবার গোহালা থেকে ফুটবল টুর্নামেন্ট ছাড়া হয়। গোহালা স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মরহুম আব্দুস সালাম বিশ্বাস স্যারের ছেলে এখন ঢাকার নামকরা সাংবাদিক ও ডিইউজে সাবেক সভাপতি শাবান মাহমুদ ও এলাকাবাসীর অনেক পরিশ্রমে খেলার আয়োজ সম্পন্ন হয়। তবে তাতেও দলাদলির শেষ ছিলো না।

আর্জেন্টিনার পরাজয়ের পর ছোট বেলার সেই কথাগুলো খুব বেশি মনে পড়ছে। আসলে মনে পরার প্রধান কারণ- ব্রাজিল সমর্থকদের Facebook পোস্ট আর আক্রমণাত্মক সব কথাবার্তা। আবার আর্জেন্টিনার সমর্থকরাও ছেড়ে কথা বলছে না। এসব কথায় খুব কষ্ট হয় না।

কেমন যেন কষ্টই লাগে। আমাদের গ্রামে গ্রামে সেই খেলাধুলা আর নেই। ছোটবেলায় বাড়ির পাশের খোলা জাগায় বর্ষার দিনে অনেক ফুটবল খেলতাম। খেলায় পুরস্কারও থাকতো। বিজয়ী দলের জন্য ছিলো “আয়না” আর ভালো খেলোয়ারের জন্য ছিলো “চিরুনি”।

সমসাময়িক সময়ে ক্রিকেট খেলায় আমরা যথেষ্ট ভালো অবস্থানে। ক্রিকেট বিশ্বকাপ আনার স্বপ্নও দেখার যোগ্যতাও রয়েছে আমাদের। কিন্তু কখনো কি ভেবেছি ফুটবলের আমরা কতটা ভক্ত? অথচ সেই ফুটবল বিশ্বকাপের ধারেকাছেও নেই আমার দেশ।

আমাদের প্রজন্মেরই যারা বয়সে ছোট, তারা হয়তো অনেকেই জানেনা- আমাদের ফুটবলে আবাহনী আর মোহামেডান নামের দুটি দল আছে। তারাও এক সময় আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের মতো অনেক ভক্তের মালিক ছিলো।

যুগে যুগে বিশ্বজুড়ে রাষ্ট্রিয় পতাকার অনেক ইতিহাস রয়েছে। তবে আমাদের লাল-সবুজের পতাকার ইতিহাস সবার থেকে ভিন্ন। এই পতাকায় আবেগ আছে, প্রতিজ্ঞা আছে, রয়েছে লাখো শহীদের রক্তের দাগ।

সেই আমরা কিন্তু স্বাধীনতা দিবসের সময় পাড়া-মহল্লায় পতাকার প্রতিযোগিতা দেখি না। কেউ বাড়ির ছাদ থেকে মাটি পর্যন্ত লাল সবুজ পতাকা টানিয়ে উদযাপন করে না। অফিসে অফিসে পতাকা টানানোর ধুম পড়ে না। অথচ ফুটবল বিশ্বকাপ এলেই নিজ পছন্দের ভীনদেশী পতাকার উল্লাস দেখি হরমামেসাই।

ফুটবল উন্মাদনা থাকলেও আশি ও নব্বই দশকের মতো পাড়ায় মহল্লায় ফুটবল খেলা কেন নেই? সে কথা কি একবারও ভেবেছেন কোনো জেলার জেলা প্রশাসক? ফুটবল ফেডারেশন কি একবারও প্রতিজ্ঞা করছে- দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বাছাই করে ভালো খেলোয়াড় আনব। অন্তত বিশ্ব কাপের ময়দানে অংশ নিব? আচ্ছা রাষ্ট্র কি করে? এমন আসরে তারা অংশ নিবে এমনটা কি ভাবতে পারে না? নাকি জার্মান, ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা স্লোগান দিয়েই যাবে যুগের পর যুগ?

আচ্ছা নিজের স্ত্রী কিংবা স্বামী রেখে অন্য কারো প্রতি যে ভালোবাসা ও আসক্তি জন্ম নেয়- তা যদি পরকীয়া হয়- তাহলে দেশের দেশের ফুটবল রেখে অনবদ্য অন্য দেশের ফুটবল দল ও খেলোয়ারদের প্রতি যে প্রেম, এটা কি আসলেই ফুটবল প্রেম নাকি পরকিয়া?

লেখক: স্টাফ রিপোর্টার, জিটিভি

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর