Tuesday 15 Jul 2025
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ডিসকাউন্ট ও অতিরিক্ত দাম: বাংলাদেশে ঈদ সেলের বাস্তবতা

ড. মতিউর রহমান
২৯ মার্চ ২০২৫ ১৭:৫৪

ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহা বাংলাদেশের দুটি প্রধান ধর্মীয় উৎসব, যা ধর্মীয় আবেগ, পারিবারিক সমাবেশ এবং বিশেষভাবে ভোক্তাদের ব্যয়বৃদ্ধির মাধ্যমে উদযাপিত হয়। এই উৎসবের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই বাজার জমে উঠে প্রচারণা, চোখধাঁধানো বিজ্ঞাপন আর বড় অফারের নানা আয়োজনে। রিটেইলাররা, অনলাইন ও অফলাইন—উভয় খাতেই, ক্রেতাদের আকর্ষণ করতে বিশাল ডিসকাউন্ট, এক্সক্লুসিভ অফার আর সময়সীমাযুক্ত ডিলের প্রলোভন দেখায়। কিন্তু এই ঈদ সেলের চকচকে প্রদর্শনীর আড়ালে লুকিয়ে থাকে এক কঠিন বাস্তবতা—ডিসকাউন্ট আর কৃত্রিমভাবে দাম বাড়িয়ে বিক্রির অপকৌশল, যা উৎসবের আবেগকে পুঁজি করে ভোক্তাদের শোষণ করে।

বিজ্ঞাপন

ঈদ সেলের সময় দোকানদাররা সবচেয়ে বেশি যে কৌশলটি ব্যবহার করে তা হলো ডিসকাউন্টের বিভ্রম তৈরি করা। ক্রেতাদের সামনে ‘৭০% পর্যন্ত ছাড়’ বা ‘একটি কিনলে একটি ফ্রি’-এর মতো প্রলোভন দেখানো হয়, যা মনে করিয়ে দেয় অসাধারণ সুযোগের। কিন্তু ভোক্তা অধিকার সংস্থাগুলোর গবেষণা ও রিপোর্টে প্রায়ই দেখা যায়, এই ডিসকাউন্টের বেশিরভাগই প্রতারণামূলক। অনেক দোকানদার ঈদের কয়েক সপ্তাহ আগে পণ্যের মূল্য কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেয়, যাতে সেলের সময় সেই দাম কমিয়ে আগের মূল্যে ফিরিয়ে আনা যায়। এই কৌশলকে ‘প্রাইস অ্যাঙ্করিং’ বলা হয়, যেখানে ক্রেতারা মনে করেন তারা অনেক বড় ছাড় পাচ্ছেন, কিন্তু বাস্তবে তারা স্বাভাবিক দামই দিচ্ছেন—কখনো তার চেয়েও বেশি।

উদাহরণস্বরূপ, একটি জামা সাধারণত ১,৫০০ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু ঈদের আগে এক মাস তার দাম বাড়িয়ে ৩,০০০ টাকা করে দেওয়া হতে পারে। সেল শুরুর পর সেই জামাটিই ‘৫০% ছাড়ে’ ১,৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়। ক্রেতা, যিনি আসল দাম জানেন না, মনে করেন তিনি অনেক সুবিধা পেয়েছেন, অথচ দোকানদারের লাভের পরিমাণ একই থাকে। এই চালাকি শুধু দোকানেই নয়, ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মেও ব্যাপকভাবে চলে, যেখানে দামের ইতিহাস না থাকায় এই কৌশল ধরা পড়ে না।

বাংলাদেশে ই-কমার্সের উত্থান ডিসকাউন্টের সমস্যাকে আরও জটিল করেছে। দারাজ, ইভ্যালি (যার পতন হয়েছে), এবং অন্যান্য স্থানীয় প্ল্যাটফর্মগুলো ঈদ সেলকে ঘিরে কাউন্টডাউন টাইমার, ফ্ল্যাশ সেল আর ডিসকাউন্ট ভাউচারের মাধ্যমে জোর প্রচারণা চালায়। কিছু সত্যিকারের অফার থাকলেও, অনেক বিক্রেতা ‘আসল দাম’ কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দেখায়, যাতে ছাড়টা বড় দেখায়। এছাড়াও, কিছু দোকান পণ্যের রেটিং ও রিভিউ জালিয়াতি করে ক্রেতাদের বিভ্রান্ত করে।

আরেকটি উদ্বেগজনক প্রবণতা হলো নিম্নমানের বা নকল পণ্য ঈদ ডিসকাউন্টের নামে বিক্রি করা। অনেক ক্রেতা অভিযোগ করেন যে তারা অনলাইনে যা দেখেছেন, বাস্তবে তার চেয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন পণ্য পেয়েছেন—সস্তা কাপড়, ত্রুটিপূর্ণ ইলেকট্রনিক্স, বা নকল ব্র্যান্ডের জিনিস আসল বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। ঈদের ব্যস্ততা আর ‘সীমিত সময়ের অফার’-এর চাপে অনেকেই তাড়াহুড়ো করে কেনাকাটা করেন, পরে গিয়ে আফসোস করেন।

ঈদ হলো উদারতা ও উৎসবের সময়, আর দোকানদাররা এই সময়টাকে কাজে লাগায় ক্রেতাদের আবেগকে পুঁজি করে। নতুন জামাকাপড়, উপহার বা ঘরের জিনিস কেনার ঐতিহ্য ভোক্তাদের মধ্যে একরকম জরুরিত্ব তৈরি করে। বিপণনকারীরা এই সুযোগ নিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে—স্টক সীমিত বা অফার শিগগিরই শেষ হয়ে যাবে, এমন বার্তা দিয়ে। এই ‘ফিয়ার অফ মিসিং আউট’ (FOMO) ক্রেতাদের দাম না যাচাই করেই তাড়াহুড়ো করে কেনার দিকে ঠেলে দেয়।

আরও বড় কথা, ঈদের সময় নতুন পোশাক পরা ও উপহার বিনিময়ের সামাজিক চাপ অনেক মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের পরিবারকে তাদের সাধ্যের বাইরে ব্যয় করতে বাধ্য করে। দোকানদাররা এই সুযোগ নিয়ে ‘সহজ কিস্তির সুবিধা’ বা ‘জিরো ইন্টারেস্ট EMI’-র মতো অফার দেয়, যার মধ্যে লুকিয়ে থাকে অতিরিক্ত খরচ বা কঠোর শর্ত। অনেক ক্রেতা, ছোট কিস্তির লোভে, তাদের সীমিত বাজেটের চেয়েও বেশি ব্যয় করে ফেলেন, যা ঈদ-পরবর্তী সময়ে আর্থিক চাপ তৈরি করে।

ডিসকাউন্ট ও দাম বাড়ানোর এই প্রবণতা চলার একটি বড় কারণ হলো ভোক্তাদের অসচেতনতা। বাংলাদেশের অনেক ক্রেতাই জানেন না যে তাদের অধিকার কী, বা দোকানদাররা কীভাবে দাম নিয়ে কারসাজি করে। বাংলাদেশ কম্পিটিশন কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর থাকলেও তাদের তদারকি দুর্বল। দাম পর্যবেক্ষণের কঠোর ব্যবস্থা না থাকায় অসাধু ব্যবসায়ীরা নির্ভয়ে এইসব কৌশল প্রয়োগ করে।

এছাড়াও, ই-কমার্সের দ্রুত বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গেছে, যার ফলে অনলাইন বিক্রেতাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা কঠিন। সরকার ডিজিটাল বাণিজ্য নীতিমালা প্রণয়ন করলেও এর বাস্তবায়ন দুর্বল, এবং প্রতারক বিক্রেতারা সহজেই তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ক্রেতা অভিযোগ দাখিল বা টাকা ফেরত পাওয়ার জটিল প্রক্রিয়ায় হতাশ হয়ে পড়েন, ফলে তারা প্রতিকার চাইতেই নিরুৎসাহিত হন।

ঈদ সেলের সময় ডিসকাউন্ট ও দাম বাড়ানোর সমস্যা মোকাবিলায় ভোক্তা ও কর্তৃপক্ষ—উভয়কেই সক্রিয় হতে হবে। ক্রেতাদের উচিত পূর্বেই পণ্যের দাম যাচাই করা, বিভিন্ন দোকানের অফার তুলনা করা এবং পণ্যের রিভিউ ভালোভাবে পড়া। তাড়াহুড়ো করে কেনা এড়িয়ে প্রকৃত বাজারদর জানার চেষ্টা করলে এইসব প্রতারণা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর উচিত ভোক্তা সুরক্ষা আইন শক্তিশালী করা এবং ঈদের মতো ব্যস্ত সময়ে দাম মনিটরিং জোরদার করা। ই-কমার্স প্ল্যাটফর্মগুলোকে দামের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বাধ্য করা উচিত এবং প্রতারক বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এছাড়াও, গণসচেতনতা কার্যক্রমের মাধ্যমে ভোক্তাদের তাদের অধিকার ও অসাধু দোকানদারদের কৌশল সম্পর্কে জানানো যেতে পারে।

বাংলাদেশে ঈদ সেল ব্যবসায়ীদের জন্য যেমন লাভজনক, তেমনি ভোক্তাদের জন্য অনেক সময় হয়ে ওঠে প্রতারণার শিকার হওয়ার সময়। উৎসবের এই সময়টি, যা আনন্দ ও উদযাপনের হওয়া উচিত, তা অনেক সময় প্রতারণামূলক বিপণন কৌশলের শিকার হয়ে ধোঁকায় পরিণত হয়। দোকানদাররা স্বল্পমেয়াদে লাভবান হলেও, এইসব অসাধু পদ্ধতি ভোক্তাদের আস্থা নষ্ট করে এবং বাজারের বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করে।

একটি সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ কেনাকাটার পরিবেশ নিশ্চিত করতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কেই নৈতিকতা মেনে চলতে হবে। ভোক্তাদের সচেতন হতে হবে, আর কর্তৃপক্ষকে প্রতারণার বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তবেই ঈদের প্রকৃত চেতনা—সততা, উদারতা ও পারস্পরিক শ্রদ্ধা—ফুটে উঠবে এই উৎসবের কেনাকাটায়ও।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

সারাবাংলা/এএসজি

ঈদ সেল ড. মতিউর রহমান ডিসকাউন্ট মত-দ্বিমত

বিজ্ঞাপন

বরিশালে এনসিপির পদযাত্রা
১৬ জুলাই ২০২৫ ০১:৪৩

আরো

সম্পর্কিত খবর