মহান মে দিবস ২০২৫: শ্রমিকের সংগ্রাম, সংহতি ও আগামীর চ্যালেঞ্জ
১ মে ২০২৫ ১৫:৫৪
আজ পয়লা মে, ২০২৫। বিশ্বজুড়ে উদযাপিত হচ্ছে মহান মে দিবস, আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস। এই দিনটি শুধু একটি ছুটির দিন নয়, বরং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শ্রমজীবী মানুষের শোষণ, বঞ্চনা এবং অধিকার আদায়ের রক্তস্নাত সংগ্রামের এক গৌরবময় ইতিহাসের স্মারক। ১৮৮৬ সালের এই দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে মার্কেট স্কোয়ারে ঘটে যাওয়া এক ঐতিহাসিক ঘটনার স্মরণে এবং ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবসের দাবীতে শ্রমিকদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করে প্রতি বছর ১লা মে বিশ্বব্যাপী পালিত হয় মে দিবস। এই দিবসটি শ্রমিকের অধিকার, মর্যাদা এবং ন্যায়সঙ্গত জীবনযাপনের দাবীকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরে। ২০২৫ সালের এই দিনে দাঁড়িয়ে যখন আমরা মে দিবস পালন করছি, তখন এর ঐতিহাসিক পটভূমি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি প্রাসঙ্গিক এর বর্তমান প্রেক্ষাপট এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আলোচনা করা।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিশ্বজুড়ে শিল্প বিপ্লবের জোয়ারে উৎপাদন ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটেছিল। কলকারখানাগুলোতে আধুনিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার শুরু হলেও শ্রমিকের কাজের পরিবেশ ছিল অত্যন্ত অমানবিক। দৈনিক ১৪ থেকে ১৬ ঘণ্টা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারও বেশি সময় ধরে কাজ করতে হতো শ্রমিকদের। ছিল না কোনো ছুটি, নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার নুন্যতম ব্যবস্থা। কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের সস্তা শ্রম কাজে লাগিয়ে বিপুল মুনাফা অর্জন করত, কিন্তু শ্রমিকদের জীবন ছিল চরম দারিদ্র্য ও অনিশ্চয়তায় ভরপুর। এই অমানবিক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ধীরে ধীরে সংগঠিত হতে শুরু করে এবং তাদের প্রধান দাবী হয়ে দাঁড়ায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মসময় নির্ধারণ। এই দাবীতে ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের শ্রমিকরা ধর্মঘট আহ্বান করে। প্রায় তিন লক্ষ শ্রমিক সেদিন কাজ বন্ধ করে রাস্তায় নেমে আসে। ৩রা মে ধর্মঘট চলাকালে ম্যাককরমিক হার্ভেস্টিং মেশিন ওয়ার্কস এর সামনে জড়ো হওয়া শ্রমিকদের উপর পুলিশ গুলি চালালে কয়েকজন শ্রমিক নিহত হয়। এই ঘটনার প্রতিবাদে ৪ঠা মে হে মার্কেট স্কোয়ারে একটি বিশাল প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ চলাকালে এক অজ্ঞাত ব্যক্তি পুলিশের উপর বোমা নিক্ষেপ করলে বেশ কয়েকজন পুলিশ নিহত হয়। পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে শ্রমিকদের উপর নির্বিচারে গুলি চালায়, এতে বহু শ্রমিক হতাহত হয়। এই ঘটনার পর শ্রমিক নেতাদের উপর নেমে আসে চরম নির্যাতন। মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে ৮ জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়, যাদের মধ্যে ৪ জনকে ফাঁসি দেওয়া হয় এবং একজন কারাগারে আত্মহত্যা করেন। এই আত্মত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে শ্রমিকদের আট ঘণ্টা কর্মসময়ের দাবী বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে ১লা মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং তখন থেকেই এই দিনটি বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণীর অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
শিকাগোর হে মার্কেট স্কয়ারের শ্রমিকদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তাদের রক্তের বিনিময়ে দৈনিক ৮ ঘণ্টা কর্মসময়ের দাবী পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধীরে ধীরে স্বীকৃতি লাভ করে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলনের চাপে একের পর এক দেশে ৮ ঘণ্টা শ্রম দিবস আইনত বাধ্যতামূলক করা হয়। এটি ছিল শ্রমিকশ্রেণীর এক বিরাট বিজয়। আট ঘণ্টা শ্রম দিবসের স্বীকৃতি কেবল কাজের সময় কমানোই নয়, এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ছিল শ্রমিকদের জীবন ও সমাজে। কর্মঘণ্টা সীমিত হওয়ায় শ্রমিকরা বিশ্রাম, বিনোদন, শিক্ষা এবং পারিবারিক জীবন উপভোগ করার সুযোগ পায়। এটি শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সহায়ক হয়। আট ঘণ্টা কর্মদিবস শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার এবং তাদের অন্যান্য অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই করার সুযোগ তৈরি করে দেয়। এই বিজয়ের পথ ধরেই পরবর্তীতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শক্তিশালী হয়, শ্রমিকদের জন্য নুন্যতম মজুরি, স্বাস্থ্য বীমা, কর্মস্থলে নিরাপত্তা, অবসরকালীন ভাতা সহ বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। মে দিবস তাই কেবল ৮ ঘণ্টা কাজের দাবীর জন্য নয়, এটি শ্রমিকদের সংগঠিত শক্তি এবং সংহতির প্রতীক যা তাদের অধিকার অর্জনে অপরিহার্য। এটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে শ্রমিকের অধিকার এমনিতেই অর্জিত হয় না, বরং এর জন্য প্রয়োজন অবিচল সংগ্রাম, ঐক্য এবং আত্মত্যাগ।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ প্রান্তে সূচিত মে দিবস বিংশ শতাব্দীতে বিশ্বজুড়ে শ্রমজীবী মানুষের কাছে এক নতুন প্রেরণা যুগিয়েছিল। এই শতাব্দীর শুরু থেকেই শিল্পায়নের প্রসার ঘটে এবং শ্রমিকশ্রেণীর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। মে দিবস তখন কেবল ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবীতে সীমাবদ্ধ না থেকে শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরি, কর্মস্থলের নিরাপত্তা, নারী ও শিশু শ্রমিকের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার এবং সামাজিক সুরক্ষার দাবীতে আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক সংগঠনগুলো মে দিবসকে কেন্দ্র করে সমাবেশ, মিছিল ও শোভাযাত্রার আয়োজন করত। এই দিনটি শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এবং তাদের দাবীর প্রতি নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হত। বিশেষ করে সমাজতান্ত্রিক ও বামপন্থী আন্দোলনগুলোতে মে দিবস অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পালিত হত এবং এটি পুঁজিবাদী ব্যবস্থার শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণীর প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হত। বিংশ শতাব্দীতে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বৈরাচারী শাসনের অবসানে গণতান্ত্রিক আন্দোলনেও শ্রমিকশ্রেণী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং মে দিবস তাদের সংগ্রামের একটি অংশ হয়ে উঠেছিল। অনেক দেশে মে দিবস সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যা শ্রমিকশ্রেণীর অধিকারের প্রতি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির প্রতীক। এভাবে বিংশ শতাব্দী জুড়ে মে দিবস বিশ্বব্যাপী শ্রমিকের অধিকার ও সংহতির এক শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে শ্রমিকের অধিকার ও মে দিবসের তাৎপর্য নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। বিশ্বায়নের ফলে উৎপাদন ব্যবস্থা ক্রমশ আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করেছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো সস্তা শ্রমের সন্ধানে এক দেশ থেকে অন্য দেশে তাদের কারখানা স্থানান্তর করছে। এর ফলে উন্নত দেশগুলোতে শ্রমিকদের কাজের সুযোগ কমে আসছে এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শ্রমিকরা নুন্যতম মজুরি ও অমানবিক পরিবেশে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক সময় দেশীয় আইন কানুন ও শ্রম অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুনাফার লোভে।
অন্যদিকে, প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি বিশেষ করে অটোমেশন, রোবোটিক্স এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) উৎপাদন প্রক্রিয়ায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। অনেক ঝুঁকিপূর্ণ ও পুনরাবৃত্তিমূলক কাজ যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। এর ফলে কিছু শ্রমিকের কাজের সুযোগ তৈরি হলেও অনেক শ্রমিকের চাকরি হারানোর ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে স্বল্প দক্ষ শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রযুক্তির দ্রুত পরিবর্তন শ্রমিকদের নতুন দক্ষতা অর্জনের চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
পাশাপাশি, গতানুগতিক চাকরির কাঠামো পরিবর্তন হচ্ছে। স্থায়ী চাকরির পরিবর্তে অস্থায়ী বা চুক্তিভিত্তিক কাজ, গিগ ইকোনমি (যেমন রাইড শেয়ারিং, অনলাইন ডেলিভারি), ফ্রিল্যান্সিং ইত্যাদি কাজের ক্ষেত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই নতুন কর্মক্ষেত্রগুলোতে শ্রমিকদের সুনির্দিষ্ট নিয়োগকর্তা না থাকায় তারা ট্রেড ইউনিয়ন করার বা সংঘবদ্ধ দর কষাকষির সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাদের নেই কোনো সামাজিক সুরক্ষা, নুন্যতম মজুরির নিশ্চয়তা বা স্বাস্থ্য বীমার মতো সুযোগ সুবিধা। এই পরিবর্তিত কর্মপরিবেশে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং তাদের সংগঠিত করা মে দিবসের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ।
২০২৫ সালের এই মে দিবসে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি বিশ্বব্যাপী শ্রমিকরা এক জটিল বাস্তবতার মুখোমুখি। কোভিড-১৯ মহামারীর অভিঘাত বিশ্ব অর্থনীতিকে দুর্বল করে দিয়েছে, যার ফলে অনেক শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছে অথবা তাদের আয় কমে গেছে। মুদ্রাস্ফীতি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি করেছে, যা শ্রমিকদের প্রকৃত আয়কে আরও কমিয়ে দিয়েছে। অনেক দেশে অর্থনৈতিক মন্দার আশঙ্কায় শ্রমিক ছাঁটাই অব্যাহত রয়েছে।
প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট ডিজিটাল বিভাজন শ্রমিকদের মধ্যে নতুন বৈষম্য তৈরি করেছে। যারা ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ তারা নতুন সুযোগ পেলেও যারা পিছিয়ে আছে তারা কর্মসংস্থানের বাজারে আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ছে। গিগ ইকোনমির প্রসার স্বল্প মেয়াদী কাজের সুযোগ তৈরি করলেও এর ফলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। অনেক গিগ ওয়ার্কার নুন্যতম আইনি সুরক্ষা থেকেও বঞ্চিত।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও শ্রমিকের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে অনেক শ্রমিক তাদের জীবিকা হারিয়েছে এবং নিরাপদ কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে গেছে। সবুজ অর্থনীতির রূপান্তর নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করলেও এর জন্য প্রয়োজন নতুন দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যা অনেক শ্রমিকের নাগালের বাইরে।
রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সংঘাত বিশ্বব্যাপী লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে উদ্বাস্তু করেছে এবং তাদের মানবেতর জীবনযাপন করতে বাধ্য করেছে। এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং তাদের মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। ২০২৫ সালের মে দিবস তাই কেবল অতীত সংগ্রামকে স্মরণ করার দিন নয়, বরং বর্তমান কঠিন বাস্তবতাকে মোকাবেলা করার এবং শ্রমিকদের জন্য একটি ন্যায্য ও সমতাপূর্ণ ভবিষ্যৎ গড়ার অঙ্গীকারের দিন।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে মে দিবসের প্রাসঙ্গিকতা এবং শ্রমিকদের চ্যালেঞ্জগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করলেও শ্রমজীবী মানুষের একটি বড় অংশ এখনও নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত। গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড হলেও এই শিল্পের শ্রমিকরা প্রায়শই স্বল্প মজুরি, অতিরিক্ত কাজের চাপ এবং অনিরাপদ কর্মপরিবেশের সম্মুখীন হয়। রানা প্লাজা ধসের মতো ভয়াবহ ঘটনা কর্মস্থলের নিরাপত্তার অভাবকে মর্মান্তিকভাবে তুলে ধরেছে। যদিও এই ঘটনার পর কর্মস্থলের নিরাপত্তা বিধানে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তবুও অনেক কারখানা এখনও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।
প্রবাসী শ্রমিকরা বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তবে বিদেশে অনেক শ্রমিক নিয়োগকর্তাদের শোষণ, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন এবং নুন্যতম অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। দেশে ফেরার পর তাদের পুনঃএকত্রীকরণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত। কৃষি শ্রমিকরা বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় কাজ পেলেও বাকি সময় তাদের কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তায় ভুগতে হয়। তাদের ন্যায্য মজুরি এবং সামাজিক সুরক্ষা অত্যন্ত সীমিত।
দেশের বিশাল সংখ্যক শ্রমিক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কর্মরত, যেমন রিকশা চালক, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, হকার ইত্যাদি। এই শ্রমিকদের কোনো আইনগত সুরক্ষা নেই, নুন্যতম মজুরি, কাজের সময় বা স্বাস্থ্য সুরক্ষার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তারা ট্রেড ইউনিয়ন করার বা সংগঠিত হওয়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত। নারী শ্রমিকরা প্রায়শই লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, কম মজুরি এবং হয়রানির শিকার হন। শিশুশ্রম এখনও বাংলাদেশের একটি বড় সমস্যা, যদিও সরকার এটি নির্মূলে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার কাগজে কলমে থাকলেও বাস্তবে অনেক শ্রমিককে ইউনিয়ন করার কারণে চাকরি হারাতে হয় বা হয়রানির শিকার হতে হয়। শ্রম আইন প্রয়োগে দুর্বলতা এবং তদারকির অভাব শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের অন্যতম প্রধান কারণ। ২০২৫ সালের মে দিবস তাই বাংলাদেশের শ্রমিকদের জন্য তাদের অধিকার সুরক্ষা এবং উন্নত জীবনযাপনের দাবীতে সোচ্চার হওয়ার এক গুরুত্বপূর্ণ দিন।
পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য বিশ্বব্যাপী শ্রমিক সংহতি অপরিহার্য। এক দেশের শ্রমিকদের সমস্যা অন্য দেশের শ্রমিকদের জীবনকেও প্রভাবিত করতে পারে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলো যখন সস্তা শ্রমের সন্ধানে বিশ্বজুড়ে বিচরণ করে, তখন এক দেশের শ্রমিকরা যদি নুন্যতম অধিকারের জন্য লড়াই করে, তবে তা অন্য দেশের শ্রমিকদের জন্যও একটি ইতিবাচক উদাহরণ তৈরি করে। একইভাবে, এক দেশের শ্রমিকদের অধিকার খর্ব হলে অন্য দেশের শ্রমিকদের উপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
ডিজিটাল যুগে শ্রমিকদের সংহতি নতুন রূপ লাভ করতে পারে। অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শ্রমিকরা তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে, সংগঠিত হতে পারে এবং তাদের দাবীর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারে। গিগ ওয়ার্কার এবং ফ্রিল্যান্সারদের মতো নতুন শ্রেণীর শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য নতুন কৌশল এবং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংগঠনগুলো বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায্য শ্রম মান প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা বিভিন্ন দেশের শ্রমিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে যাতে তারা শ্রমিকদের অধিকারকে সম্মান করে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় শ্রমিকদের সংহতি অপরিহার্য। ন্যায্য উত্তরণ (Just Transition) নিশ্চিত করার জন্য শ্রমিকদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং নতুন সবুজ অর্থনীতিতে তাদের জন্য মানসম্মত কাজের সুযোগ তৈরি করতে হবে। ২০২৫ সালের মে দিবস বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের মনে করিয়ে দেয় যে তাদের সংগ্রাম এককভাবে নয়, বরং সম্মিলিতভাবে পরিচালিত হতে হবে। সংহতিই শ্রমিকের শক্তি।
২০২৫ সালের পর কর্মসংস্থানের ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং অটোমেশন অনেক বিদ্যমান কাজকে প্রতিস্থাপন করবে, তবে একই সাথে নতুন কাজের সুযোগও তৈরি করবে। প্রশ্ন হলো, এই পরিবর্তন শ্রমিকদের জন্য কতটা উপকারী হবে এবং কীভাবে এই পরিবর্তনের সুফল সকলের কাছে পৌঁছাবে। এই পরিবর্তনের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য শ্রমিকদের নতুন দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং জীবনব্যাপী শিক্ষার সুযোগ তৈরি করতে হবে। সরকার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে।
ভবিষ্যতের শ্রমবাজারে শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার জন্য শ্রম আইনগুলোকে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিকায়ন করতে হবে। গিগ ইকোনমি এবং অন্যান্য নতুন কর্মক্ষেত্রগুলোকে আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে হবে এবং এই শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা এবং দর কষাকষির অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর উপর নৈতিক দায়িত্ব আরোপ করতে হবে যাতে তারা প্রযুক্তির বিকাশের সময় শ্রমিকদের ভবিষ্যৎকেও বিবেচনা করে। অটোমেশন থেকে সৃষ্ট মুনাফার একটি অংশ শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ এবং সামাজিক সুরক্ষার জন্য ব্যবহার করার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। ট্রেড ইউনিয়নগুলোকে পরিবর্তিত কর্মপরিবেশে শ্রমিকদের সংগঠিত করার নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শ্রমিকদের কণ্ঠস্বরকে শক্তিশালী করতে হবে। ২০২৫ সালের মে দিবস আমাদেরকে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে শ্রমিকের অধিকার এবং কাজের পরিবেশ কেমন হবে সে সম্পর্কে গভীর ভাবনা এবং প্রস্তুতি নেওয়ার আহ্বান জানায়।
শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা এবং ন্যায্য কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সরকার এবং নিয়োগকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারের দায়িত্ব হলো কঠোর শ্রম আইন প্রণয়ন ও কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যাতে শ্রমিকদের নুন্যতম মজুরি, কর্মঘণ্টা, স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নিশ্চিত হয়। অনানুষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের আইনি সুরক্ষা এবং সামাজিক নিরাপত্তার আওতায় আনার জন্য সরকারকে বিশেষ পদক্ষেপ নিতে হবে। শিশুশ্রম বন্ধে এবং নারী শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।
নিয়োগকর্তাদের কেবলমাত্র মুনাফার দিকে মনোযোগ না দিয়ে তাদের শ্রমিকদের প্রতি মানবিক দায়িত্ব পালন করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি প্রদান, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা এবং তাদের অধিকারকে সম্মান করা নিয়োগকর্তাদের নৈতিক ও আইনগত দায়িত্ব। নিয়োগকর্তাদের শ্রমিকদের সাথে আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে এবং ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকারকে সম্মান জানাতে হবে। সামাজিক সংলাপের মাধ্যমে শ্রমিক, নিয়োগকর্তা এবং সরকারের মধ্যে সমঝোতা তৈরি করা সম্ভব যা সুষ্ঠু শিল্প সম্পর্ক এবং শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় সহায়ক হবে। কর্পোরেট সামাজিক দায়িত্ব (CSR) শুধুমাত্র একটি কথার কথা না রেখে এটিকে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে এবং তাদের অধিকার রক্ষায় কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে। ২০২৫ সালের মে দিবস সরকার এবং নিয়োগকর্তাদের তাদের দায়িত্ব স্মরণ করিয়ে দেয় এবং শ্রমিকদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য তাদের সক্রিয় ভূমিকা পালনের আহ্বান জানায়।
২০২৫ সালের মে দিবসকে কেবল একটি সরকারি ছুটি হিসেবে দেখলে চলবে না। এটি শ্রমিকদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাসকে স্মরণ করার পাশাপাশি বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলোকে অনুধাবন করার এবং ভবিষ্যতের জন্য সংকল্পবদ্ধ হওয়ার দিন। এই দিনে আমাদের শ্রমিকদের অধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিয়ে আলোচনা করা উচিত, তাদের সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা উচিত এবং তাদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার করা উচিত।
মে দিবসের চেতনা হলো সংহতির চেতনা। এই দিনে শ্রমিকরা ধর্ম, বর্ণ, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে একত্রিত হয় এবং তাদের অভিন্ন দাবীগুলোর পক্ষে আওয়াজ তোলে। এই সংহতি কেবল আনুষ্ঠানিক সমাবেশ ও মিছিলের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে শ্রমিকদের দৈনন্দিন জীবনে এবং তাদের সংগ্রামের অংশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। কারখানার শ্রমিক থেকে শুরু করে কৃষি শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, গৃহকর্মী, প্রবাসী শ্রমিক, এমনকি গিগ ইকোনমির শ্রমিক সবার সমস্যাই মে দিবসের আলোচনার বিষয় হওয়া উচিত। শ্রমিক সংগঠনগুলোকে আরও শক্তিশালী ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে হবে যাতে তারা সকল ধরণের শ্রমিকের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে। মে দিবসের চেতনা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে শ্রমিকের মর্যাদা এবং ন্যায্য অধিকার অর্জন এক চলমান প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন অবিরাম প্রচেষ্টা, সচেতনতা এবং সংকল্প।
মহান মে দিবস ২০২৫ যখন আমরা পালন করছি, তখন এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, বর্তমান বাস্তবতা এবং আগামীর চ্যালেঞ্জগুলো আমাদের সামনে স্পষ্ট। শিকাগোর হে মার্কেটের রক্তস্নাত সংগ্রামের পথ ধরেই বিশ্বব্যাপী শ্রমিকরা তাদের অধিকার অর্জন করেছে। আট ঘণ্টা কর্মদিবস ছিল সেই অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। তবে বিশ্বায়ন, প্রযুক্তি এবং পরিবর্তিত কর্মপরিবেশ নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে যা মোকাবেলার জন্য শ্রমিকদের নতুন করে সংগঠিত হতে হচ্ছে এবং নতুন কৌশলের আশ্রয় নিতে হচ্ছে। বাংলাদেশের মতো দেশে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষা এবং কর্মস্থলের নিরাপত্তা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী এবং স্থানীয় পর্যায়ে শ্রমিকের সংহতি। সরকার এবং নিয়োগকর্তাদের শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় তাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং শ্রমিকদের জন্য একটি ন্যায্য ও মানবিক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।
মে দিবসের চেতনাকে শুধুমাত্র একদিনের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ না রেখে এটিকে শ্রমিকদের দৈনন্দিন সংগ্রাম এবং সংকল্পের অংশ করে তুলতে হবে। ২০২৫ সালের মে দিবস আমাদের এই বার্তা দেয় যে শ্রমিকের অধিকার অর্জন ও সুরক্ষা এক নিরন্তর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় সকল শ্রমিকের মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং তাদের জন্য একটি উন্নত ভবিষ্যৎ গড়া আমাদের সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। শ্রমিকশ্রেণী পৃথিবীর অর্থনীতির চালিকাশক্তি, তাদের শ্রম ছাড়া সমাজ অচল। তাই তাদের প্রাপ্য সম্মান, অধিকার এবং উন্নত জীবন নিশ্চিত করাই হওয়া উচিত মে দিবসের মূল লক্ষ্য এবং আগামীর পথচলার পাথেয়।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
সারাবাংলা/এএসজি