বিজ্ঞাপন

আ.লীগে মনসুর-ওয়াদুদ দ্বৈরথ, বিএনপিতে নাদিম-নজরুল

November 23, 2023 | 6:28 pm

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: পদ্মা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এক বিখ্যাত জেলার নাম রাজশাহী। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা। এর পরিচিতি রেশম দিয়ে। রাজশাহীকে বলা হয়ে থাকে সিল্কসিটি। এছাড়াও এই জেলা শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত। তবে ইদানিং রাজশাহীকে আমের রাজধানীও বলা হয়ে থাকে। রাজা ও জমিদারদের কারণে এই জেলার নামকরণেও ছাপ রয়েছে। এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলো বহন করে চলছে রাজা ও জামিদারদের ঐতিহ্য।

বিজ্ঞাপন

৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনে যে জেলার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে সেটি রাজশাহী। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামানের জন্মভূমি এই রাজশাহী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এই জেলা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। রাজশাহী থেকে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু, প্রয়াত সাঈদউদ্দিন আহমেদ, প্রয়াত আবুল হোসেন, মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি, প্রয়াত মনোয়ারা রহমান ও আবদুর রাজ্জাক। এই জেলায় পাকবাহিনীর হাতে প্রথম শহিদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই জেলার অনেক মানুষ শহিদ হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মারা হতো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের। স্বাধীন দেশে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাজশাহীর সন্তান জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান।

রাজশাহীকে এক সময় বলা হতো বিএনপির ঘাঁটি ও মৌলবাদীদের আস্তানা। তবে পিছিয়ে ছিল না প্রগতিশীল আন্দোলনও। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। মূলত তখনই রাজনীতি থেকে অবস্থান হারাতে শুরু করে বিএনপি। সে সময় রাজশাহীর ছয়টি আসন থেকে পাঁচটিতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আর একটিতে জয় পায় ওয়ার্কার্স পার্টি। বর্তমানে রাজশাহীতে বিএনপি তার অবস্থান হারিয়েছে। এই সময়ে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচনে বিশাল শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

রাজশাহীর ছয়টি আসন থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এই জেলার কয়েকটি আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। বিএনপির প্রার্থীর সংখ্যাও কম নয়। তারাও কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কিনেছেন অনেকে। এর আগে তারা মিছিল-মিটিং, শোডাউন, পথসভা উঠান বৈঠক করেছেন। এবারও জাতীয় পার্টি মহাজোটে থেকে নির্বাচন করছে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনের চিত্র।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

বড় দুই দলের নেতায় নেতায় দ্বন্দ্বে দিশেহারা তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের দুইবারের সংসদ সদস্য কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারার সঙ্গে বর্তমান এমপি ডা. মুনসুর রহমানের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে। আর বিএনপির দুই বারের সাবেক সংসদ সদস্য নাদিম মোস্তফার সঙ্গে বিএনপির প্রবীণ নেতা অধ্যাপক নজরুল ইসলামের দ্বন্দ্ব দীর্ঘ দিনের। যা এখনো বিদ্যমান।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহীর পুঠিয়া-দুর্গাপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত সংদীয় আসন রাজশাহী-৫। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এ আসনটি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দলের দখলে থেকেছে। কখনো জাতীয় পার্টি, কখনো আওয়ামী লীগ আবার কখনো বিএনপির দখলে। এর মধ্যে ৯১ থেকে ৯৬ সাল পর্যন্ত এখানে এমপি ছিলেন আওয়ামী লীগের। আর ৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির দখলে ছিল এ আসনটি। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে এ আসনটি ফের দখলে আসে আওয়ামী লীগের।

দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ব্যবসায়ী কাজী আবদুল ওয়াদুদ দারা। ২০১৪ সালের নির্বাচনেও বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হন তিনি। তবে ২০১৮ সালের নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন বঞ্চিত হলে নৌকার টিকিট পান জেলা আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. মনসুর রহমান।

এ আসনে এবার আওয়ামী লীগ ও বিএনপির অন্তত ডজন খানেক নেতা মনোনয়ন পাওয়ার আশায় মাঠে নেমেছেন। এর মধ্যে কেউ রয়েছেন নবীন, আবার কেউ প্রবীণ। সম্ভাব্য এসব প্রার্থীরা এখন সুযোগ পেলেই এলাকার সাধারণ মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছেন। এলাকার রাস্তা-ঘাট এবং বিভিন্ন বাজারসহ মোড়গুলোতে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে নেতাদের শুভেচ্ছা ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে।

রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে এবারও নৌকার মনোনয়ন চেয়ে ফরম জমা দিয়েছেন সংসদ সদস্য প্রফেসর ডা. মুনসুর রহমান এবং জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও দুইবারের সাবেক এমপি আবদুল ওয়াদুদ দারা। এ ছাড়াও এ আসনে মনোনয়নে এবার নৌকার টিকিট চেয়ে মনোনয়ন ফরম জমা দিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আহসানুল হক মাসুদ, পুঠিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান জিএম বাচ্চু হিরা, দুর্গাপুর পৌরসভার মেয়র সাজেদুর রহমান মিঠু, সাবেক এমপি প্রয়াত তাজুল ইসলাম মো. ফারুকের মেয়ে তানজিমা শারমীন মুনি, জেলা আওয়ামী লীগের দফতর সম্পাদক প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, রাজশাহী জেলা যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি ওবাইদুর রহমান, আওয়ামী লীগ নেতা অ্যাড. গোলাম রাব্বানী, অ্যাড. শরিফুল ইসলাম ও অ্যাড. রায়হান কাওসার।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় রাজনীতিকরা জানান, এমপি মুনসুর ও সাবেক এমপি দারার অবস্থান মাঠ পর্যায়ে শক্তিশালী। নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সময় পেলেই ছুটে যাচ্ছেন এলাকায়। নির্বাচন কেন্দ্রিক নানা উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মসূচিতে অংশ নিচ্ছেন তারা। তবে তৃণমূলের সমর্থন আদায় করে কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ব্যানার পোস্টার সাটিয়ে নিজেদের অবস্থান জানান দিচ্ছেন দু’জনই।

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ একটি বড় দল। এখানে অনেক নেতা আছে। সবাই যে যার মতো করে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবেন- এটাই স্বাভাবিক। তবে নির্বাচনের সময় এলে অনেকেই পরিচিত হওয়ার জন্য মনোনয়ন তুলে থাকেন।’ তবে যাদের দলে অবস্থান নাই, তারাই বিভেদ সৃষ্টি করছে বলে দাবি করেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, ‘এই আসনে অতীত ও বর্তমান কর্মকাণ্ড বিবেচনায় গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যে এই আসনে নৌকার টিকিট পাবেন সবাইকে তার পক্ষে কাজ করতে হবে। নির্বাচনের আগে ও পরে আমরাও কোনো দ্বন্দ্ব দেখতে চাই না।’

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এ আসনে এবার বিএনপির মনোনয়নের আশায় আছেন বিএনপির অন্তত হাফ ডজন নেতা। বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে কি না তা এখনো চূড়ান্ত না হলেও ভোটের মাঠে নেমেছেন মনোনয়ন প্রত্যাশী অনেকেই। বিশেষ করে নিজের পক্ষে সমর্থন পেতে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন তৃণমূলের নেতাদের সঙ্গে। তবে এবার ক্লিন ইমেজের নেতা চান বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।

৯৬ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এ আসনে সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি নাদিম মোস্তফা। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর এলাকা ছাড়েন তিনি। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে নাদিমের স্থলে মনোনয়ন দেওয়া হয় পুঠিয়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি নজরুল ইসলাম মণ্ডলকে। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে নজরুল ইসলাম পরাজিত হন। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও নাদিম মোস্তফা ও নজরুল ইসলাম মণ্ডল দলের মনোনয়ন চাইবেন।

এই দু’জন ছাড়াও রাজশাহী-৫ আসনে মনোনয়ন চাইবেন- ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ও পুঠিয়া উপজেলা বিএনপির আহবায়ক আবু বকর সিদ্দিক, দুর্গাপুর উপজেলা বিএনপির সাবেক সহ-সভাপতি গোলাম সাকলাইন, বিএনপির তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা বিষয়ক কমিটির চেয়ারম্যান মাহবুবা হাবিবা, বিএনপি নেতা ইসফা খায়রুল হক শিমুল ও দুর্গাপুর উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহেদ মোল্লার ছেলে সিরাজুল কবির সনু।

বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক শাহীন শওকত সারাবাংলাকে বলেন, ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে না ছাড়া আমরা নির্বাচনে যাব না। যদি কেউ নির্বাচন করে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দল আমাদের নির্বাচনের জন্য এখনও কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। শুনছি অনেক নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করবে। তাদেরও সতর্ক করা হচ্ছে। তবে দল নির্বাচনে গেলে যাকে মনোনয়ন দেওয়া হবে সবাইকে তার পক্ষে কাজ করতে হবে।’

আওয়ামী লীগ-বিএনপির প্রার্থীদের বাইরেও এই আসনে নির্বাচন করতে চান জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা সাবেক এমপি অধ্যাপক আবুল হোসেন। মনোনয়ন প্রত্যাশায় তিনি মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন।

উল্লেখ্য, রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া ও ‍দুর্গাপুর) আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ১ হাজার ৫৯৪ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৬ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৫০ হাজার ২০৮ জন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন আবদুল ওয়াদুদ দারা। তিনি ওই সময় পান ১ লাখ ২৪ হাজার ৪০১ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নজরুল ইসলাম পান ১ লাখ ৮ হাজার ৮৩ ভোট। ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আওয়ামী লীগের টিকিট পান আবদুল ওয়াদুদ। ওই নির্বাচনে তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তবে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান মনসুর রহমান। ওই নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকে ১ লাখ ৮৭ হাজার ৩৭০ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির নজরুল ইসলাম ধানের শীষ প্রতীকে পান ২৮ হাজার ৬৮৭ ভোট।

সারাবাংলা/এমই/পিটিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন