বিজ্ঞাপন

আ.লীগে আয়েনের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী আসাদ, বিএনপিতে মিলন এগিয়ে

November 23, 2023 | 10:06 am

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: পদ্মা নদীর তীরে গড়ে ওঠা এক বিখ্যাত জেলার নাম রাজশাহী। এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী জেলা। এর পরিচিতি রেশম দিয়ে। রাজশাহীকে বলা হয়ে থাকে সিল্কসিটি। এছাড়াও এই জেলা শিক্ষানগরী হিসেবে পরিচিত। তবে ইদানিং রাজশাহীকে আমের রাজধানীও বলা হয়ে থাকে। রাজা ও জমিদারদের কারণে এই জেলার নামকরণেও ছাপ রয়েছে। এখানকার প্রাচীন স্থাপনাগুলো বহন করে চলছে রাজা ও জামিদারদের ঐতিহ্য।

বিজ্ঞাপন

৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ৭১’র মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সবধরনের রাজনৈতিক আন্দোলনে যে জেলার অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে সেটি রাজশাহী। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামানের জন্মভূমি এই রাজশাহী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কারণে দেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে এই জেলা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। রাজশাহী থেকে ভাষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন ভাষাসৈনিক গোলাম আরিফ টিপু, প্রয়াত সাঈদউদ্দিন আহমেদ, প্রয়াত আবুল হোসেন, মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জি, প্রয়াত মনোয়ারা রহমান ও আবদুর রাজ্জাক। এই জেলায় পাকবাহিনীর হাতে প্রথম শহিদ হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক শামসুজ্জোহা। মহান মুক্তিযুদ্ধে এই জেলার অনেক মানুষ শহিদ হয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা হলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে নির্যাতন করে মারা হতো বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষদের। স্বাধীন দেশে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর ৩ নভেম্বর জেলখানায় নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন রাজশাহীর সন্তান জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহিদ এএইচএম কামারুজ্জামান।

রাজশাহীকে এক সময় বলা হতো বিএনপির ঘাঁটি ও মৌলবাদীদের আস্তানা। তবে পিছিয়ে ছিল না প্রগতিশীল আন্দোলনও। ২০০৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে ভূমিধস জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। মূলত তখনই রাজনীতি থেকে অবস্থান হারাতে শুরু করে বিএনপি। সে সময় রাজশাহীর ছয়টি আসন থেকে পাঁচটিতে জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ। আর একটিতে জয় পায় ওয়ার্কার্স পার্টি। বর্তমানে রাজশাহীতে বিএনপি তার অবস্থান হারিয়েছে। এই সময়ে আরও বেশি শক্তিশালী হয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ নির্বাচনে বিশাল শক্তি নিয়ে মাঠে নামবে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

রাজশাহীর ছয়টি আসন থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। এই জেলার কয়েকটি আসনে এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাওয়া প্রার্থীর সংখ্যা আগের তুলনায় বেড়েছে। বিএনপির প্রার্থীর সংখ্যাও কম নয়। তারাও কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজি নন। আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়ন কিনেছেন অনেকে। এর আগে তারা মিছিল-মিটিং, শোডাউন, পথসভা উঠান বৈঠক করেছেন। এবারও জাতীয় পার্টি মহাজোটে থেকে নির্বাচন করছে। আর রাজপথের প্রধান বিরোধীদল বিএনপি রয়েছে আন্দোলনে। তবে বিএনপি নির্বাচনে এলে ভোটের হিসাব-নিকাশ কিছুটা হলেও পাল্টে যাবে। কারণ, তারাও দুয়েকটি আসন দখলে ভোটের মাঠে নামবে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আসনভিত্তিক পরিক্রমায় এবার সম্ভাব্য প্রার্থীদের নিয়ে সারাবাংলার আয়োজনে থাকছে রাজশাহী-৩ (পবা ও মোহনপুর) আসনের চিত্র।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন:

রাজশাহী শহরঘেঁষা উপজেলা পবা ও উত্তরের মোহনপুর উপজেলা নিয়ে গঠিত রাজশাহী-৩ আসন। সীমানা পুনর্র্নিধারণের মধ্য দিয়ে ২০০৮ সালে সংসদীয় এই আসনটি সৃষ্টি হয়। এর আগের সব নির্বাচনে এই আসনের পবা উপজেলাটি রাজশাহী-২ (সদর) আসনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আর মোহনপুর উপজেলা যুক্ত ছিল রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সঙ্গে। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) চারপাশ ঘিরে থাকায় জাতীয় সংসদের ৫৪ নম্বর এই আসনটিকে সদরের পর রাজশাহীর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আসন হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে এ আসনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি প্রয়াত মেরাজ উদ্দিন মোল্লা। তবে ২০১৪ সালের নির্বাচনে দলের মনোনয়ন থেকে বাদ পড়েন তিনি। ফলে ওই নির্বাচনে সবাইকে চমক দিয়ে নৌকা প্রতীক পেয়ে সংসদ সদস্য হন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আয়েন উদ্দিন। তখন থেকেই আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে আসছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ। তবে ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনেও দলের মনোনয়নে এমপি হন আয়েন উদ্দিন। টানা দুইবারের সংসদ সদস্য আয়েন উদ্দিন এবারও আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছেন।

এদিকে, গত দুইবারের এমপি আয়েনের বিরুদ্ধে দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মীদের অসম্মান, মারধর, নির্যাতন, মামলা, গ্রেফতারের মাধ্যমে হয়রানি, নৌকা প্রতীকের প্রার্থীদের হারানো ও বিএনপি-জামায়াত তোষণসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। ফলে অনেক হেভিওয়েট প্রার্থী এই আসনে মনোনয়ন পেতে তৃণমূলের সঙ্গে নিয়মিত বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীরা বলছেন, নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে এমপি আয়েন উদ্দিনের জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায়। আবারও তাকে মনোনয়ন দেওয়া হলে গুরুত্বপূর্ণ এই আসনটি হারাবে আওয়ামী লীগ।

২০১৪ সাল থেকে এ আসনটিতে দলীয় মনোনয়ন চেয়ে আসা জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ এবারও নৌকা প্রতীক পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন। কেন্দ্রে যোগাযোগের পাশাপাশি পবা-মোহনপুরে নিয়মিত মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা, মিছিল, মিটিং, উঠান বৈঠকসহ নানা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছেন।

রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসন থেকে নির্বাচন করার জন্য দলীয় মনোনয়ন ফরম উত্তোলন করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দুই বারের এমপি আয়েন উদ্দিন, জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ, পবা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী। এ ছাড়াও এই আসনে প্রার্থিতার জন্য মনোনয়ন কিনেছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি অ্যাড. শরিফুল ইসলাম শরিফ, জেলা মহিলা লীগের সহসভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রোকসানা মেহেবুব চপলা, জেলা কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পবা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ওয়াজেদ আলী খান এবং প্রকৌশলী শামসুল আলম।

বিজ্ঞাপন

রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল কুমার সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘রাজশাহী-৩ আসন থেকে প্রার্থী বেশি। দল যাকে ভালো মনে করবে তিনি মনোনয়ন পাবেন। জেলা কমিটির পক্ষ থেকে সব মনোনয়ন প্রত্যাশীকে বলা হয়েছে নৌকা প্রতীক যে পাবে তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। যদি না করে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচনে কে এলো না এলো তা আমাদের দেখার বিষয় না। তফসিল ঘোষণা হয়ে গেছে, নির্বাচন হবে। প্রার্থীরা দলীয় মনোনয়ন কিনে জমাও দিয়েছেন। সভানেত্রী সব যাছাই-বাছাই করে প্রার্থী দেবেন।’

২০০৮ সালে এই আসনে দলীয় মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেকমন্ত্রী কবীর হোসেন। বার্ধক্যজনিত কারণে ২০১৮ সালে তিনি মনোনয়ন পাননি। সেবার দলের মনোনয়ন পান নগর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিকুল হক মিলন। কিন্তু তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। শফিকুল হক মিলন এবারও মনোনয়ন চাইবেন। তিনি ছাড়াও এই আসনে এবার মনোনয়নের আশায় রয়েছেন কবীর হোসেনের ছেলে নাসির হোসাইন অস্থির, জেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান মন্টু ও জেলার সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রায়হানুল হক রায়হান। তবে বিএনপির সম্ভাব্য এই প্রার্থীরা তাকিয়ে আছেন কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের দিকে। জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়ে গেলেও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে এখনও নীরব ভূমিকায় রয়েছে তারা। দল যদি নির্বাচনে আসে তাহলে তারা এই আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন।

বিএনপির রাজশাহী বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ শাহীন শওকত সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, সরকারের পদত্যাগ, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন ও নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি, মিথ্যা-গায়েবী মামলা প্রত্যাহার এবং সংবিধান ও রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি, ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে চলা আন্দোলন নিয়েই এখন নেতাকর্মীরা ব্যস্ত আছেন। ফলে নির্বাচন বা প্রচার-প্রচারণা নিয়ে কোনো ভাবনা নেই। তবে এসব দাবি বাস্তবায়ন হলে ও ভোট দিয়ে পছন্দের প্রার্থী নির্বাচনের অধিকার জনগণ ফিরে পেলে কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে নেতাকর্মীরা মাঠে নামবেন।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিটি আসনেই আমাদের একাধিক যোগ্য প্রার্থী আছেন। দলের ক্রান্তিলগ্নে যারা আন্দোলন সংগ্রামে ছিলেন, দলের জন্য জেল-জুলুম সহ্য করে দলকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছেন তারাই মনোনয়ন পাবেন।’

শুধু বিএনপি নয়, এই আসনে আওয়ামী লীগ ছাড়া বাকি দলগুলোর নেতাদেরও তৎপরতা চোখে পড়ছে না। তবে নিবন্ধন হারালেও আধিপত্য ধরে রাখতে জামায়াতে ইসলাম এ আসনে প্রার্থী দিতে চায় বলে জানা গেছে।

উল্লেখ্য, রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ৫৭ হাজার ৩৭২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩৪ জন এবং নারী ভোটার ১ লাখ ৭৮ হাজার ৯৩৮ জন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই আসন থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নির্বাচিত হন মেরাজ উদ্দিন মোল্লা। তিনি ওই সময় ১ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৭ ভোট পান। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কবির হোসেন পান ৯৩ হাজার ৬৪৯ ভোট। কিন্তু ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট পান আয়েন উদ্দিন। ওই নির্বাচনে তিনি ৬৭ হাজার ৮৭৯ ভোট পেয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থী মেরাজ উদ্দিন মোল্লা পান ১২ হাজার ৩৪৩ ভোট। এর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ফের আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আয়েন। ওই নির্বাচনে তিনি নৌকা প্রতীকে ২ লাখ ১১ হাজার ৩৮৮ ভোট পেয়ে জয়লাভ করেন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির শফিকুল হক মিলন ধানের শীষ প্রতীক পান ৮০ হাজার ৮০৬ ভোট।

সারাবাংলা/এমই/পিটিএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন