ফুটবলের প্রথম জাদুকরের প্রয়াণ
১৭ নভেম্বর ২০১৮ ১৫:১৯
।। মুশফিক পিয়াল, সিনিয়র নিউজরুম এডিটর ।।
সত্যিকারের ফুটবলপ্রেমীরা ফেরেঞ্চ পুসকাসকে কখনো এড়িয়ে যেতে পারবেন না। ফুটবল ইতিহাসের সেরা নায়কদের বেছে বেছে বের করা হলে তাতে নিশ্চিতভাবেই উপরের দিকে নাম থাকবে হাঙ্গেরীর এই কিংবদন্তির। নিজের দেশ হাঙ্গেরী ছাড়াও পুসকাস খেলেছেন স্পেন জাতীয় দলের জার্সিতে। ১৯২৭ সালের ২ এপ্রিল হাঙ্গেরীর বুদাপেস্টে জন্ম নেওয়া এই কিংবদন্তি ২০০৬ সালের আজকের দিনে (১৭ নভেম্বর) ৭৯ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন।
বিশ্বকাপ জয় ছাড়া সম্ভাব্য সবকিছুই জিতেছেন, এমন এক ফুটবলার হাঙ্গেরীর পুসকাস। ১৯৫৪ সুইজারল্যান্ড বিশ্বকাপ ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির কাছে অবিশ্বাস্যভাবে হেরে গেলে বিশ্বকাপ ট্রফি ছোঁয়ার দূরত্ব থেকে ফিরে আসেন পুসকাস। তাকে বলা হয় ফুটবলের প্রথম জাদুকর। হাঙ্গেরীর ফুটবল হয়ে ওঠেছিল পুরোটাই পুসকাসময়।
১৯৬৬ সালে বুটজোড়া তুলে রাখেন পুসকাস। ২০০২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হলে ২০০৬ সালে জন্মস্থান বুদাপেস্টের হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়েছিল। স্ত্রী আরজেবেত আর একমাত্র কন্যা আনিকোকে রেখে সে বছরের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন পুসকাস। তার কফিনটি পুসকাস ফেরেঞ্চ স্টেডিয়ামে নেওয়া হয়, সেখানে সামরিক অভিবাদন জানানো হয়। ১৯৫৩ সালে পুসকাসের নামে তৈরি হয়েছিল স্টেডিয়ামটি।
ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থা ফিফা থেকে পুসকাসের প্রতি সম্মান দেখিয়ে ২০০৯ সাল থেকে একটি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। বছরের সবচেয়ে সুন্দর গোলদাতা এই পুরস্কারটি পেয়ে থাকেন। প্রতি বছর সবরকম প্রতিযোগিতা থেকে বাছাই করে সবচেয়ে দর্শনীয় এবং নজরকাড়া গোলের জন্য গোলদাতাকে সম্মানিত করা হয় পুসকাস অ্যাওয়ার্ড দিয়ে।
১৯৫০ এর দশকে হাঙ্গেরী জাতীয় দল পরিচিত ছিল অপরাজেয় হিসেবে। তারা দীর্ঘ চারবছর কোনো ম্যাচ হারেনি এবং পুসকাস ছিলেন দলটির অন্যতম প্রধান স্ট্রাইকার। ১৯৫৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে পশ্চিম জার্মানির বিপক্ষে ৩-২ গোলে হেরে শিরোপা জিততে পারেনি পুসকাসের দলটি। হাঙ্গেরী যখন বিশ্বকাপে আসে তখন তারা ছিল টানা ২৭ ম্যাচে অপরাজিত (২৩ জয় আর ৪ ড্র)। দুর্দান্ত খেলছিলেন পুসকাস।
কোয়ার্টার ফাইনালের আগে পুসকার ইনজুরিতে পড়েন। পুসকাসবিহীন হাঙ্গেরী ব্রাজিলকে ৪-২ গোলে হারায় কোয়ার্টার ফাইনালে। সেমিতে উরুগুয়েকে ৪-২ গোলে হারানো ম্যাচেও ছিলেন না পুসকাস। গ্রুপ পর্বে যেই হাঙ্গেরীর বিপক্ষে পশ্চিম জার্মানি ৮-৩ গোলে হেরেছিল, সেই জার্মানরাই ফাইনালে হারিয়ে দেয় হাঙ্গেরীকে।
পুরোপুরি ফিট না হওয়া সত্ত্বেও মাঠে নেমেছিলেন পুসকাস। ৮ মিনিটের মাথায় হাঙ্গেরী ২-০ গোলে এগিয়ে যায়। পুসকাস নিজে একটি গোল করার পাশাপাশি সতীর্থকে দিয়ে একটি গোলও করিয়েছিলেন। কিন্তু, পরের সময়টা ছিল জার্মানদের নিয়ন্ত্রণে, তিনটি গোল করে শিরোপা জেতে তারা। স্বদেশী ককসিস ৬ ম্যাচে ১১ গোল করলেও, মাত্র ৩ ম্যাচে ৪ গোল করেই গোল্ডেন বল জিতে নেন পুসকাস।
তার দুর্দান্ত ফর্মের কারণে হাঙ্গেরীর আধিপত্য চলতে থাকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত। এর মাঝে দলটি ১৯৫২ সালের অলিম্পিক শিরোপা ঘরে তোলে। সেই আসরের ৫ ম্যাচে হাঙ্গেরী গোল করে ২০টি, বিপরীতে হজম করে মাত্র ২টি গোল। কোয়ার্টার, সেমি এবং ফাইনালে পুসকাস গোল করেন। ১৯৫২ সালে অলিম্পিকে সোনা জেতা পুসকাসের হাঙ্গেরী ৩২ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ড গড়েছিল। জিতেছিল ইউরোপীয়ান কাপও।
জাতীয় দল হাঙ্গেরীর হয়ে ৮৫ ম্যাচে ৮৪ গোল করেছেন পুসকাস। ম্যাচ প্রতি গোল ০.৯৮টি। ১৯৬২ বিশ্বকাপেও খেলেন পুসকাস। তবে গায়ে জড়ান স্পেনের জার্সি। গোলের রাজা পুসকাস থাকেন নিজের ছায়া হয়ে। স্পেনের হয়ে আরো চারটি ম্যাচ খেলে কোনো গোল পাননি তিনি। এজন্য ৮৯ ম্যাচে ৮৪ গোল তার গড় গোলের পরিমান কমিয়ে দেয়।
সর্বকালের অন্যতম সেরা গোলদাতা পুসকাস ক্লাব ক্যারিয়ারে খেলেছেন স্প্যানিশ জায়ান্ট রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে। ক্লাব ক্যারিয়ারে ৬২৯ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ৬২২টি। অফিসিয়াল গোল সংখ্যায় সর্বকালের সেরার তালিকায় তিনি চতুর্থ। হাঙ্গেরীর লীগে ৪ বার সর্বোচ্চ গোল করা পুসকাস ১৯৪৮ সালে সকল ইউরোপীয় লীগের মধ্যে সর্বোচ্চ গোল করেন। রিয়ালের হয়ে টানা ৫ বার স্প্যানিশ শিরোপাও জেতেন। ১৩টি ভিন্ন দলের হয়ে কোচ ছিলেন তিনি। সবশেষ ১৯৯৩ সালে নিজের জন্মভূমি হাঙ্গেরীর কোচ ছিলেন পুসকাস।
সারাবাংলা/এমআরপি