‘ফুটবল বাড়ির’ ছেলের ক্রিকেটে বাজিমাত, নাঈম জ্বরে জন্মশহর
২৪ নভেম্বর ২০১৮ ১৭:৫৪
।। রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
চট্টগ্রাম ব্যুরো: ছেলে নাঈম হাসানের আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচে অভিষেক হয়েছে। বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে জহুর আহমদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লড়ছে ছেলে। কিন্তু মাঠে বসে ছেলের ক্রীড়াশৈলী দেখতে যাননি বাবা-মা কেউই। যাবেন কিভাবে! ছেলে যখন মাঠে লড়ছেন, বাবা-মা তখন ঘরে এলাকার উৎসুক মানুষ-শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভিড় সামলাতে ব্যস্ত। টেলিভিশনের পর্দায় চোখ রেখে তিনদিন ঘরেই কাটিয়ে দিয়েছেন বাবা মাহবুবুল আলম।
শুধু কি নিজের ঘর, নাঈমের বিদ্যাপীঠ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, সহপাঠী সবার আগ্রহের কেন্দ্রেও ছিল তার অভিষেক ম্যাচ। জাতীয় দলের হয়ে আন্তর্জাতিক টেস্টে নাঈমের অভিষেক ছিল এমনই আড়ম্বরপূর্ণ। জন্মশহর চট্টগ্রামের পাড়ায় পাড়ায় নাঈম জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন ক্রিকেটপ্রেমীরা।
চট্টগ্রাম নগরীর চান্দগাঁও ওয়ার্ডের দুইবারের কাউন্সিলর মাহবুবুল আলম। নগরীর চান্দগাঁও থানার ফরিদার পাড়া এলাকায় তাদের বাড়িটি ‘কমিশনার বাড়ি’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এটি আসলে একটি ‘ফুটবল বাড়ি’। মাহবুবুল আলমসহ এই বাড়ির অন্তঃত ছয়জন সদস্য সাবেক ফুটবলার। চট্টগ্রাম ব্রাদার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম নিজেও ছিলেন আশির দশকের মাঠ কাঁপানো ফুটবলার।
সেই বাড়িতে ১৯৯৮ সালে জন্ম নাঈম হাসানের। জাতীয় ক্রিকেট দলে জায়গা করে নিয়েছেন নাঈম। তবে একই ঘরে আরো একজন ক্রিকেটার জোর প্রস্তুতি নিয়ে এগিয়ে চলেছেন জাতীয় পর্যায়ে অভিষেকের অপেক্ষায়। তিনি নাঈমের ছোট ভাই হাসিবুল আলম অনিক।
সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন নাঈমের বাবা মাহবুবুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমার তিন ছেলে। তিনজনকেই ক্রিকেট একাডেমিতে ভর্তি করিয়েছিলাম। বড় ছেলে চলে এসেছে। ভেবেছিলাম মেঝোটার (নাঈম) খেলার প্রতি আগ্রহ নেই। এজন্য তার প্রতি বিশেষ কোন দৃষ্টি ছিল না। কিন্তু সে ঠিকই আমাদের অজান্তে কঠোর অনুশীলন করে গেছে। আমাদের পাড়াতেও তার খুব জনপ্রিয়তা। অনূর্ধ্ব ১৭-১৯ তে খেলে সে আজ জাতীয় দলে। আমাদের ছোট ছেলেটাও অনূর্ধ্ব-১৬ তে জেলা পর্যায়ে খেলছে। আশা করি, সে-ও জাতীয় দলে আসবে।’
জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেকের অপেক্ষায় ছিলেন নাঈম। শ্রীলঙ্কা সিরিজে নাঈমের খেলার কথা থাকলেও তা হয়নি। তবে সাদা পোশাকে অভিষেকটা এবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেই হয়েছে।
টেস্ট দলে ছেলের জায়গা পাওয়ার পর বাবা মাহবুবুল আলমের আনন্দ আর ধরে না। তিনি বলেন, ‘আমার কনফিডেন্ট ছিল যে সে চান্স পাবেই এবং চান্স পেলে সে ভালো করবে। সে কঠোর অনুশীলন করেছে। বর্ষাকালে আমাদের এলাকায় তো খুব পানি উঠে। সেই পানি ভেঙ্গে তাকে দেখেছি ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য চলে গেছে। এভাবে খেলতে খেলতে সে ম্যাচিউরড হয়েছে। ম্যাচিউরিটির প্রমাণ দিয়েছে প্রথম টেস্ট ম্যাচে।’
অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে ব্যাট হাতে ২৬ রান তোলেন নাঈম। আর বল হাতে নেমেই দেখিয়েছেন চমক। উইন্ডিজদের বিপক্ষে স্পিন যাদুতে ৬১ রান খরচায় ৫ উইকেট তুলে নিলেন তরুণ এই স্পিনার।
তবে ছেলের প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ দেখতে মাঠে যাননি বাবা মাহবুবুল আলম। যে মায়ের কাছ থেকে গোপনে টাকা নিয়ে মাঠে ক্রিকেট অনুশীলনের জন্য ছুটে যেত নাঈম হাসান, সেই মা-ও যাননি ছেলের খেলা দেখতে।
কেন? জানতে চাইলে মাহবুবুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিভাবে যাব? বৃহস্পতিবার (২২ নভেম্বর) থেকে আমাদের বাসায় মানুষের ভিড়। এলাকার মানুষ তো তাকে খুব পছন্দ করে। কিশোর-তরুণদের কাছে তো সে ক্রিকেটের শিক্ষকের মতো। টেলিভিশন খুলে আমি আর তার (নাঈম) মা বসে আছি। আর লোকজন শুধু আসছে। স্টেডিয়ামে গেলে আমি হয়ত বসে থাকতাম। বিভিন্ন লোকজন এসে কথা বলে। এতে ভালো করে খেলাটা দেখতে পারতাম না। এখন ঘরে বসে টেলিভিশনে সবার সঙ্গে আনন্দ করে ছেলের খেলাটা দেখছি।’
‘আমার চেয়েও এলাকার মানুষ তাকে বেশি উৎসাহ দিয়েছে। পাড়ার ছেলেরাই তো তাকে ক্রিকেট পাগল বানিয়েছে। তাদেরও তো হক আছে। প্রথম খেলাটা সেজন্য তাদের ছেড়ে দেখতে যেতে পারিনি।’ বলেন মাহবুবুল আলম।
শুধু কি পাড়ার মানুষই উৎসাহ দিয়েছে, তার বিদ্যাপীঠ প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অবদানও তো অনেক। ২০১৬ সালে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিলেন নাঈম। তিন বছর প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে বিভিন্ন আসরে খেলেছেন। এর মধ্যে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় তার নৈপুণ্যে মুগ্ধ শিক্ষক-সতীর্থরা।
প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট ক্লাবের সাবেক অধিনায়ক পংকজ বিশ্বাস সারাবাংলাকে বলেন, ‘নাঈম একজন ভালো মানের অ্যাটাকিং স্পিন বোলার এবং মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। তার ক্রীড়ানৈপুণ্যের কারণে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট ক্লাব অনেকদূর এগিয়ে গেছে। আমরা বুঝতে পারতাম, নাঈম একদিন অনেক ভালো করবে। সে আজ শুধু প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চট্টগ্রামের সম্পদ নয়, সে এখন জাতীয় সম্পদ।’
নাঈমের এমন কৃতিত্বে আনন্দিত প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. অনুপম সেনও। তিনি বলেন, ‘নাঈম হাসানের এমন কৃতিত্বে আমরা সত্যিই আনন্দিত ও গর্বিত। আমাদের বিশ্বাস, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে এই সিরিজে ও পরবর্তীতে নাঈম অনেক ভালো খেলে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করবে। একইসাথে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘ক্রিকেটের ধ্রুপদী খেলা টিস্ট সিরিজে সুযোগ পাওয়া এবং সেখানে নৈপুণ্য দেখানো একজন ক্রিকেটারের পক্ষে বড় অর্জন। নাঈম এ সুযোগ পাওয়ায় প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি ক্রীড়া উন্নয়ন কমিটি এবং প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীরা আনন্দিত।’
সারাবাংলা/আরডি/এসএন