এবছর কেমন ছিল বাংলাদেশের ফুটবল?
৩১ ডিসেম্বর ২০১৮ ২২:০০
।।জাহিদ-ই-হাসান, স্পোর্টস করেসপন্ডেন্ট।।
ঢাকা: আনন্দ-দু:খ-বেদনায় কেটেছে এবছরের দেশের ফুটবল। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের ইতিহাসের হাসিও যেমন আছে তেমনি এই বছরে সাফ ও বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপের ব্যর্থতার বেদনাও আছে। আছে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে নারী-পুরুষ ফুটবলে অভাবনীয় সাফল্য। সব কিছু ছাপিয়ে দেশের ফুটবলটা হয়েছে হাসি-কান্না সংমিশ্রণ।
‘সারাবাংলাডটনেটের নিয়মিত পাঠকদের জন্য থাকছে ২০১৮ সালজুড়ে দেশের ফুটবলের আলোচিত-সমালোচিত ঘটনাবলীর খুঁটিনাটি।’
পুরুষ ফুটবলের ‘বোতলমুক্তি’:
শত চরাই-উতরাই পেরিয়ে এ বছরটা বলা যায় দেশের পুরুষ ফুটবলের ‘বোতলমুক্তির’ বছর। এ বছরেই দীর্ঘ ১৯ মাস নির্বাসন কাটিয়ে নিয়মিত ফুটবলে ফিরেছে বাংলাদেশ। কাতার-ইন্দোনেশিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া ব্যয়বহুল ক্যাম্প শেষে লাওসের সঙ্গে ম্যাচের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরেছে প্রায় দু‘বছর পর। তার প্রভাবটা র্যাঙ্কিংয়েও উজ্জ্বল। ১৯৭ র্যাঙ্কিং থেকে বছরের শেষে বাংলাদেশের র্যাঙ্কিং দাঁড়িয়েছে ১৯২। ‘মন্দের ভালোই বলতে হবে‘। এ বছর জামাল-সুফিলরা আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে ৮টি। জিতেছে তিনটিতে, হেরেছে চারটিতে। আর ড্র করেছে একটিতে।
এশিয়ান গেমসে ইতিহাস:
অ্যান্ড্রু ওর্ডের হাত ধরে যেখানে আন্তর্জাতিক ফুটবলে ফিরেছিল দেশের ফুটবল সেখানে আরেক ইংলিশ কোচ জেমি ডে‘র হাত ধরে ঐতিহাসিক মুহূর্ত উপহার দিয়েছে জামাল-রানারা। ইন্দোনেশিয়ায় ইতিহাস রচনা করেছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। এশিয়ান গেমসে স্বাধীনতার ৪৭ বছরে প্রথমবারের মতো নক আউট পর্বে উঠেছিল বাংলাদেশ। এটাই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ সাফল্য।
বহুল আকাঙ্খিত সাফ ও বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে ব্যর্থতা:
এশিয়াডে ইতিহাস গড়া জেমি ডের শিষ্যদের নিয়ে দেশের ফুটবল সমর্থকদের সামনে আরেকটি ইতিহাসের হাতছানি ছিল। সাফ গেমসে দীর্ঘ ১৫ বছরের শিরোপা খরা ঘোচানোর হাতছানি ছিল। অন্যদিকে ঘরের মাঠে আরেকটি জায়ান্ট টুর্নামেন্ট বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপেও শিরোপার আশ্বাস। আকাঙ্খার পারদে স্টেডিয়ামজুড়ে যখন টইটুম্বুর দর্শক শুরুটা দুর্দান্ত করে শেষে নেপালের কাছে হেরে সাফ গেমসের গ্রুপ পর্ব থেকে বেদনার বিদায় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশকে। বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে সেমি ফাইনাল থেকে বিদায় নিতে হয়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। বছরের শুরুটা যেখানে আনন্দের সেখানে শেষটা মোটেও সুখকর হয়নি।বেদনার রঙে বিদায় নিতে হয়েছে।
ঘরোয়া ফুটবল: রেফারি পেটানো ও খেলোয়াড়দের মধ্যে মারামারি:
স্বাধীনতা কাপ দিয়ে এবারের ঘরোয়া ফুটবল আসর শুরু হয়েছে। ঢাকা আবাহনী-মোহামেডানকে চমকে দিয়ে প্রথমবারের মতো শিরোপা নিয়েছে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ। অন্যদিকে পরের টুর্নামেন্টে ফেডারেশন কাপেই সেই আরামবাগ আবারও সংবাদ শিরোনাম। এবার রেফারিকে পিটিয়ে আলোচনায় তারা। ওই টুর্নামেন্টের ফাইনাল আরেকটি সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ফাইনাল ম্যাচটি ঘিরে ঢাকা আবাহনী ও বসুন্ধরা কিংসের খেলোয়াড়রা জড়িয়ে পড়েন অনাকাঙ্খিত মারামারিতে। পরপর দুটি ঘটনায় বড় শাস্তি দেখতে হয়েছে তাদের। স্বাধীনতা কাপ দিয়ে ঘরোয়া ফুটবলের শুরু হয়েও একই টুর্নামেন্ট দিয়ে বছর শেষ করেছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। বছরের শেষ টুর্নামেন্টটি ঘরে তুলেছে নবাগত তারকাবহুল দল বসুন্ধরা কিংস।
এএফসি কাপের টিকিট চ্যালেঞ্জ:
শিডিউল জটিলতায় এবার এশিয়ান পর্যায়ে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্লাব লড়াইয়ের ঠিকানা এএফসি কাপের স্লট ছিল একটি ক্লাবের জন্য বরাদ্দ। সেই চ্যালেঞ্জ নিতে উঁচুমানের বিদেশি ফুটবলার দলে ভেড়িয়ে ফেডারেশন কাপে নেমেছিল ক্লাবগুলো। তারকাবহুল বসুন্ধরা কিংসকে হতাশ করে টিকিট নিশ্চিত করেছে ঢাকা আবাহনী। সেই ম্যাচেই মারামারির মতো ঘটনায় চলমান ম্যাচেই লাল কার্ড দেখতে হয়েছে দুই দলের চার ফুটবলারকে। শেষ পর্যন্ত ফেড কাপ শিরোপা জিতে এএফসির টিকিট নিশ্চিত করেছে ‘ঘরের বাঘ‘ আবাহনী।
জুনিয়র ফুটবলে সাফল্য:
সিনিয়র ফুটবলে হাসি-কান্নায় কাটলেও বয়সভিত্তিক পর্যায়ে পুরুষ ফুটবলে অসাধারণ সাফল্য নিয়ে এসেছে অনূর্ধ্ব-১৫ বয়সী ফুটবলাররা। দক্ষিণ এশিয়ার বিশ্বকাপ খ্যাত সাফ গেমসের শিরোপা ঘরে তুলেছে মেহেদী-উচ্ছ্বাসরা। মাত্র এক মাসের ক্যাম্প করে ভারতকে টাইব্রেকারে হারিয়ে সাফ শিরোপা ঘরে তুলেছে মাসুদ আনোয়ার পারভেজ বাবুর শিষ্যরা। তারপরেই উয়েফার একটি টুর্নামেন্টে অংশ নিয়ে থাইল্যান্ডের মতো দলের সঙ্গে ১-১ ব্যবধানে ড্রসহ টুর্নামেন্টে তৃতীয় হয়েছে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। বছরজুড়ে তারাও ফুটবল সমর্থকদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।
মেয়েদের ফুটবল: জুনিয়রে সাফল্য; সিনিয়রে ব্যর্থতা
বাংলাদেশের ফুটবল মানেই যেন মেয়েদের ফুটবল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরজুড়ে মেয়েরাই বলতে গেলে ফুটবলের বিজ্ঞাপন হয়ে ছিল। বয়সভিত্তিক পর্যায়ে অভাবনীয় সাফল্য যেমন দেখা গেছে তেমনি সিনিয়র পর্যায়ে ভরাডুবিও দেখেছে বাংলাদেশ। যেমন আগস্টে ভুটানে মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে ভারতের কাছে হেরে শিরোপা হারাতে হয়েছে। তেমনি অক্টোবরেই অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ শিরোপা ঘরে তুলেছে মারিয়া-আঁখিরা। এর মাঝে অনূর্ধ্ব-১৬ এএফসি ফুটবলের বাছাইপর্বে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে গোলাম রব্বানী ছোটনের শিষ্যরা। নাম লিখিয়েছে টুর্নামেন্টের চূড়ান্তপর্বে।তারপরেই যেন মুদ্রার উল্টোপিঠও দেখতে হয়েছে সিনিয়র ফুটবলে। নভেম্বরে মিয়ানমারে টোকিও অলিম্পিক গেমসের বাছাইপর্বে চার দেশের মধ্যে তৃতীয় হয়েছে তারা। মাত্র এক পয়েন্ট নিয়ে মাঠ ছেড়েছে সাবিনারা। বছরের শেষটা সিনিয়র ফুটবল ছিল ব্যর্থতায় মুড়ানো।অক্টোবরে তাজিকিস্তানে নারী অনুর্ধ-১৯ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলে বাংলাদেশ ৪ দেশের মধ্যে তৃতীয় হয়। অবশ্য এপ্রিলে হংকংয়ে ‘জকি কাপ’ জিতেছে অনুর্ধ্ব-১৫ নারী ফুটবল দল। মালয়েশিয়া, ইরান ও স্বাগতিক হংকংকে গোল বন্যায় ভাসিয়ে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয় গোলাম রব্বানি ছোটনের শিষ্যরা। বছরজুড়ে বয়সভিত্তিক নারীদল সাফল্য পেয়েছে অভাবনীয়। সিনিয়র ফুটবলে দেখেছে হতাশা আর অপেক্ষার নীল ছবি।
বছরজুড়ে দেশ ফুটবলময় হলেও বিপাকে পড়তে হয়েছে ফেডারেশনকেও। স্পন্সর জটিলতায় পড়ছে হয়েছে বাফুফেকে। পেশাদার লিগ থেকে সরে দাঁড়িয়েছে সাইফ গ্লোবাল স্পোর্টস। অবশ্য পরে সত্ত্ব কিনে নিয়েছে কে স্পোর্টস পাঁচবছরের জন্য। এদিকে এ বছর গঠিত হয়েছে জেলা ও বিভাগীয় ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন।চেয়ারম্যান আ জ ম নাছির ও মহাসচিব হয়েছেন তরফদার রুহুল আমিন। যিনি সামনের বাফুফে নির্বাচনে সভাপতির দায়িত্বে থাকবেন।
এছাড়াও এ বছর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে সবজি চাষ নিয়েও বেশ আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আবার এশিয়াডে ইতিহাস গড়ে ফুটবলারদের গানও ভাইরাল হয়েছে। ভারতে ফ্র্যাঞ্জাইজি ভিত্তিক লিগে সাবিনা-কৃষ্ণার খেলতে যাওয়াও ছিল আলোচনায়।
আরও পড়ুন নিচের লিংকে
সাফ চ্যাম্পিয়ন মেহেদী-উচ্ছ্বাসরা
সাফ চ্যাম্পিয়ন মেয়েরা
ভারতের কাছেও বিধ্বস্ত মেয়েরা
চার ফুটবলার ‘নিষিদ্ধ’, আরামবাগকে আর্থিক দণ্ড
এশিয়াডে ইতিহাস লিখলো বাংলাদেশ
সারাবাংলা/জেএইচ
গোলাম রব্বানী ছোটন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন মাসুদ আনোয়ার পারভেজ বাবু