লাল-সবুজের আনন্দের কারিগরদের ভাগ্য বদলাবে কবে?
২০ জানুয়ারি ২০১৯ ১৬:৩৭
।। মহিবুর রহমান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
সকাল,দুপুর কিংবা বিকেল। কখনো কখনো রাত ১২টা। মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সবুজ জমিনে চোখ ফেললেই দেখা যায় একদল শ্রমিক সারিবেঁধে একাগ্রতার সঙ্গে মাঠের পরিচর্যা করছেন। কেউ নতুন ঘাস লাগাচ্ছেন,কেউ মৃত ঘাস তুলছেন,কেউ ঘাসে পানি দিচ্ছেন,কেউ মাঠ রোলিং করছেন,কেউ ফিতে দিয়ে ২২ গজের উইকেটের দৈর্ঘ-প্রস্থ মাপছেন, আবার কেউ পরিচর্যা করছেন। এদের পরিচয় হলো; এরা সবাই গ্রাউন্ডসকর্মী। যারা শের-ই-বাংলাকে খেলার উপযোগি করে তোলেন। আরো সহজ করে বললে ক্রিকেটরদের ব্যাটে-বলে লড়াইয়ের জমিনটা প্রস্তুত রাখেন।
তাদের হাতের নিপুন ছোঁয়াতেই এ মাঠ প্রাণ পায়। এখানে খেলা গড়ায়। কখনো সেখানে চার-ছাক্কার ফুলঝুড়ি দেখা যায়। কখনো বা বোলারদের দাপট। ক্রিকেটমোদীদের রক্তের মধ্যে শিহরণ বইয়ে দেয়া লড়াইয়ের ক্ষেত্র তাদের হাতেই তৈরি। এদেশের কতশত বাধভাঙা আনন্দের উৎস এই মাঠ! জানেন? সেই আনন্দের মূল রুপকার কিন্তু তারাই। তাদের তৈরি মাঠে খেলেই সাকিব আল হাসানরা তারকা খ্যাতি পান। বিশ্বসেরার খেতাব অর্জন করেন।২২ গজের পারফরম্যান্সে প্রতিনিয়ত যে নতুন নতুন তারকার জন্ম হয়, সেই জমিনের রক্ষণাবেক্ষণের গুরু দায়িত্ব তাদের কাঁধেই ন্যস্ত থাকে।
দেশের আরো চারটি ভেন্যু; বিকেএসপি, ফতুল্লা খান সাহেব ওসমান আলী, সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম ও চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে গেলেও তাদের দেখা মিলবে। তবে শের-ই- বাংলার মতো হরহামেশা নয়। যেহেতু হোম অব ক্রিকেটের ভেন্যু সেহেতু ব্যস্ততার মাত্রাটা এখানেই বেশি।
যা হোক। এদেশের ১৬ কোটি মানুষকে আনন্দের উপলক্ষ্য এনে দেয়া এই মানুষগুলোর মাসিক বেতন কত জানেন? মাত্র ৮ হাজার টাকা! খুব বেশি অভিজ্ঞ হলে ১২ হাজার। শিক্ষাগত যোগ্যতা তাদের নেই বললেই চলে। কিন্তু যে কাজটি করেন তার মজুরি কী এতটাই নগন্য হওয়া উচিত? বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গ্রাউন্ডস বিভাগের দেয়া তথ্যমতে, সারাদেশে এমন গ্রাউন্ডস কর্মীর সংখ্যা মোট ৩শ। এদের মধ্যে ১শ স্থায়ী, বাকি ২শ মাস্টার রোল বা দিন মজুরি হিসেবে কাজ করেন।
মজুরি নামেমাত্র হওয়ায় সবাই মানবেতর জীবন-যাপন করেন। অনাহার ও অর্ধাহারে কাটে মাস, বছর। ক্ষুধা-দারিদ্র্যের কষাঘাত সহ্য করতে না পেরে একসময় অনেকে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হন। সমস্যাটা শুরু হয় তখনই। কেননা বিশেষায়িত ক্ষেত্র হওয়ায় এই মানুষগুলোকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন পড়ে। সেই প্রশিক্ষণ না দেয়া পর্যন্ত অন্য কাউকেই এখানে নিয়োজিত করা সম্ভবপর হয়ে উঠে না। বিষয়টি এমন না, কাউকে ধরে বললাম, এসো কাজ করো। আর সে করলো।
এতে করে মহাবিপদে পড়ে যান কিউরেটররা। যেহেতু মাঠ প্রস্তুতির জন্য তাদের একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া থাকে। সেটা বাধাগ্রস্থ হয়। হয়তো তারা পারেন। তবে যতটা নিখুঁত হওয়ার কথা ততটা হয়ে ওঠে না। দিন শেষে সেই দায় নিতে হয় কিউরেটরকে। দেশের সংবাদ মাধ্যমগুলো উইকেটের সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দেশের আন্তর্জাতিক এক ভেন্যুর কিউরেটর আক্ষেপ করে সেকথাই বলছিলেন, ‘ওদের বেতন খুবই কম। ৮ হাজার টাকায় কি হয় বলেন? দেখা যায় একটা গুরুত্বপূর্ণ সিরিজ সামনে তখন কেউ চাকরি ছেড়ে দিল। ভয়ানক বিপদে পড়ে যাই তখন। কেননা চাইলেই তো আমি কাউকে গ্রাউন্ডসের কাজে লাগাতে পারি না। ওদের ট্রেনিং দিতে হয়।’
সেই কিউরেটরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আর্থিক সঙ্গতি না থাকায় তাদের বড় একটি সংখ্যা বাসা ভাড়া করে থাকতে পারেন না। স্টেডিয়ামের জীর্ণ শীর্ণ কোনো কক্ষে দিন-রাত কাটে।
এরপর অনেকটাই অনুযোগের সুরে কিউরেটর জানালেন, ‘বিসিবির তো এখন টাকার অভাব নেই। ওদের বেতন বাড়িয়ে দিলে আমরা আরো চমৎকার ভেন্যু এবং উইকেট উপহার দিতে পারতাম।’
বিষয়টি জানতে এবং সংকট উত্তোরণে যোগাযোগ করা হলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের গ্রাউন্ডস ও ফ্যাসিলিটিস বিভাগের ম্যানেজার সৈয়দ আব্দুল বাতেনের সঙ্গে। প্রশ্ন করতেই কিছুক্ষণ নিরব থাকলেন। এরপর বললেন, ‘আমরা কিন্তু বোর্ডকে পরিকল্পনা দিয়েছি। দেখা যাক হয়তো সামনের বোর্ড মিটিংয়ে বিষয়টি আমরা তুলে ধরতে পারবো।’
বাতেনের দাবী, ‘খেলা হলে কিন্তু তাদের ম্যাচপ্রতি আমরা ১শ টাকা করে দিচ্ছি। বিনামূল্যে খাওয়া-দাওয়া, বাসস্থান যোগাড় করে দিচ্ছি। তারপরেও ৮ হাজার টাকা বেতন আসলে খুবই কম।’
এদেশের ক্রিকেটের দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে কত মানুষের ভাগ্যই তো বদলেছে। কিন্তু ক্রিকেটের আনন্দের মূল কারিগররাই থেকে গেছেন বঞ্চিত। তাদের ভাগ্য আজও বদলায়নি। কবে বদলাবে?
সারাবাংলা/এমআরএফ/এমআরপি