বাংলাদেশ ক্রিকেটের প্রথম মহাতারকার জন্মদিন
৭ জুলাই ২০১৯ ১৫:৪৬
৭ জুলাই ১৯৮৪, বাংলাদেশের এক সময়কার ক্রিকেটের বিজ্ঞাপন মোহাম্মদ আশরাফুলের জন্ম। এর তিন বছর আগে একই দিনে জন্ম নিয়েছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটের বড় বিজ্ঞাপন মহেন্দ্র সিং ধোনি। দুজনই নিজ নিজ দেশের জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ধোনি এখনও বিশ্ব ক্রিকেটের বড় নাম আর সময়ের স্রোতে হারিয়ে গেছেন আশরাফুল। দেশের ক্রিকেটের আশার ফুল হয়ে ফোটা আশরাফুল জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন আরও আগেই, লড়ছেন নতুন করে নিজেকে ফিরে পেতে।
দেশের জার্সিতে আশরাফুলের টেস্ট ম্যাচ থমকে গেছে ৬১টি ম্যাচ খেলে। ওয়ানডে খেলেছেন ১৭৭টি আর টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ২৩টি। ধোনি ভারতের হয়ে টেস্ট খেলেছেন ৯০টি, ওয়ানডে খেলেছেন ৩৩২টি আর টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ৯৩টি। সাদা পোশাকে না খেললেও ধোনি এখনও খেলছেন ওয়ানডে আর টি-টোয়েন্টিতে। অথচ বাংলাদেশের জাতীয় দলে ব্রাত্য অ্যাশ।
ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি ভারতীয় জাতীয় দলে এখনও অটোমেটিক চয়েজ ধোনির অনেক আগেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেছিলেন আশরাফুল। ২০০১ সালের ১১ এপ্রিল বুলাওয়াতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষেক হয় আশরাফুলের। সবশেষ ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৩ সালের ৮ মে, সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, সেই বুলাওয়েতে। ২০০১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর কলম্বোতে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট অভিষেকে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হয়ে সেঞ্চুরি হাঁকিয়ে সাড়া ফেলেন আশরাফুল। ২০১৩ সালের এপ্রিলে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হারারেতে সবশেষ সাদা পোশাকে নেমেছিলেন অ্যাশ। ২০০৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর নাইরোবিতে কেনিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে অভিষেক হয় অ্যাশের। ২০১৩ সালের ৩১ মার্চ পাল্লেকেলেতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তিনি খেলেছিলেন তার সবশেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। জাতীয় দলে আর কখনো ফেরা না হলে দেশের মাটিতে অভিষেক কিংবা দেশের মাটিতে বিদায় নেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকবেন আশরাফুল।
নিজের অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে আশরাফুল শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ৫৩ মিনিট ক্রিজে থেকে ৫৩ বলে করেছিলেন ২৬ রান। আর দ্বিতীয় ম্যাচেই ইতিহাস লিখে করেছিলেন ১৬ বাউন্ডারিতে ১১৪ রান। ক্রিজে ছিলেন ২৪৮ মিনিট, বল মোকাবেলা করেছিলেন ২১২টি। মাত্র ১৭ বছর ৬১ দিন বয়সে অভিষেক টেস্টে সেঞ্চুরির মধ্য দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটে অনন্য এক নজির স্থাপন করেছিলেন আশরাফুল। কলম্বোর সিংহলিজ স্পোর্টস স্টেডিয়ামে ওই সেঞ্চুরির সুবাদে আশরাফুল যেমন নিজেকে চিনিয়েছেন তেমনি হয়েছিলেন টেস্টের সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান। ওয়ানডে অভিষেকে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আশরাফুল ৮ বলে দুটি বাউন্ডারিতে করেন ৯ রান। বল হাতে ৪ ওভারে ২৫ রানের বিনিময়ে নিয়েছিলেন একটি উইকেট। আর নিজের প্রথম টি-টোয়েন্টিতে ব্যাট হাতে অধিনায়ক আশরাফুল ২০ বলে চারটি চার আর একটি ছক্কায় করেছিলেন ৩৬ রান। বল হাতে ৪ ওভারে ৩২ রানের বিনিময়ে তুলে নেন একটি উইকেট।
২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে মাত্র ৪টি-টোয়েন্টি খেলার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বমঞ্চে মাঠে নেমে যায় বাংলাদেশ। মোহাম্মদ আশরাফুল সেবার বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রথম ম্যাচেই ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিয়ে ক্রিস গেইল, সারওয়ান, ব্রাভোদের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে দেয় আশরাফুলের দল। সেই আসরে ভারতকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ধোনি। ফাইনালে পাকিস্তানকে ৫ রানে হারিয়ে বিশ্ব শিরোপা উঠেছিল ধোনির হাতে।
একটু প্রথমশ্রেণির এবং লিস্ট ‘এ’ ম্যাচের পরিসংখ্যানের দিকে তাকানো যাক। আশরাফুল ১৫৬টি প্রথমশ্রেণির ম্যাচ আর লিস্ট ‘এ’ তে খেলেছেন ২৬৫টি ম্যাচ। প্রথমশ্রেণিতে ২০টি সেঞ্চুরিতে আশরাফুলের ব্যাটিং গড় ২৮.৯৪, লিস্ট ‘এ’ তে ১০টি সেঞ্চুরিতে গড় ২৫.৫৫। প্রথমশ্রেণিতে আশরাফুলের রান ৭৯৩১, লিস্ট ‘এ’ তে ৫৮৫১। সবধরনের টি-টোয়েন্টিতে আশরাফুল ৬৯ টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলে করেছিলেন ১৩৪৬, ইনিংস সর্বোচ্চ অপরাজিত ১০৩ রান। আন্তর্জাতিক ওয়ানডেতে আশরাফুলের রান থমকে আছে ৩৪৬৮তে। সাদা পোশাকে থমকে গেছেন ২৭৩৭ রানে।
বিপিএলে ঢাকা গ্ল্যাডিয়েটর্সের জার্সিতে খেলে শিরোপা জেতার সুযোগ হয়েছিল আশরাফুলের। দেশের জমজমাট টি-টোয়েন্টির এই আসরে স্পট ফিক্সিং কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছিলেন। বিপিএলে স্পট ফিক্সিংয়ে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আশরাফুল প্রথমে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন আট বছরের জন্য। এর মধ্যে স্থগিত নিষেধাজ্ঞা ছিল তিন বছরের। আপিলের পর শাস্তিটা কমে হয় দুই বছরের স্থগিত নিষেধাজ্ঞাসহ পাঁচ বছর। শাস্তি কমানোর সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে পাল্টা আপিল করেছিল বিসিবি ও আইসিসি। বিপিএল স্পট ফিক্সিংয়ের কেঁচো খুঁড়তে বেরিয়ে আসা ‘সাপ’ নিয়ে উদাসীন ছিল বিসিবি। ক্ষমা চেয়েও পার না পাওয়ায় হারিয়ে গিয়েছিলেন আশরাফুল। ব্যাপারটা স্বাভাবিক ছিল, অস্বাভাবিক ছিল আশরাফুল আরও কয়েকজনের দিকে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ জানালেও সেটা সে সময় আমলে নেওয়া হয়নি। সাবেক এই দলপতি সে সময় বলেছিলেন, শুধু বিপিএল নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেও অনেকেই ফিক্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তবে, ব্যাপারটি আর আগ বাড়েনি।
২০০৭ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আশরাফুল খেলেছিলেন ৮৩ বলে ১২টি বাউন্ডারিতে ৮৭ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস। সেই ম্যাচে ১২৭ মিনিট ক্রিজে থাকা আশরাফুলের নতুন শট দেখে বিস্মিত হয়েছিল ক্রিকেট বিশ্ব। আশরাফুলের শটের নাম হয়েছিল ‘অ্যাশস্কুপ’। এই শট প্রোটিয়াদের এতোটাই নাকানিচুবানি দিচ্ছিল যে প্রতিপক্ষের দলপতি গ্রায়েম স্মিথ বারবার ফাইন লেগের জায়গাগুলোতে ফিল্ডার নড়াচড়া করাচ্ছিলেন। কিন্তু কোনো কাজেই আসেনি তাদের চেষ্টাগুলো। স্কুপ বা ব্যাটল সুইপ শটটার আবিষ্কারক ছিলেন আশরাফুল। এখন এই শটটিই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে অনেক ম্যাচেরই মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে। পাকিস্তান হয়তো আশরাফুলকে অপরাধীর তালিকায় রেখেছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে অ্যাশস্কুপ খেলতে গিয়ে উইকেট বিলিয়ে দিয়েছিলেন পাকিস্তানের সেট ব্যাটসম্যান মিসবাহ উল হক। ম্যাচটি হেরেছিল পাকিস্তান, নয়তো শিরোপাটি উঠতো তাদেরই হাতে।
আশরাফুলের প্রতিভা থাকলেও তার মধ্যে মিডিয়াপ্রীতির কারণে স্টারডম চলে এসেছিল। তার মধ্যে নিজের ভুলগুলো শোধরানোর চেষ্টা চোখে পড়েনি। আর বোর্ড অতি উৎসাহী হয়ে তার অপরাধের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও মাত্রাতিরিক্ত শাস্তি দিয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয় ভক্তদের কাছে।
এ কথা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই, বাংলাদেশের বদলে যাওয়া, ব্র্যান্ড দল হয়ে ওঠার পেছনে বড় একটা ভূমিকা ছিল আশরাফুলের। ২০০০ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেকে সবচেয়ে কম বয়সী হিসেবে সেঞ্চুরি, ২০০৫ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে মাটিতে নামানোর ম্যাচে সেঞ্চুরি, একই বছর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৫২ বলে ৯৪ রান, ২০০৯ সালে বুলাওয়াতে জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে ১০৩ বলে অপরাজিত ১০৩ রান, কিংবা বাংলাদেশের হয়ে টেস্টে প্রথম ১৫০ রান সবই আশরাফুলের হাত ধরে। বাংলাদেশের বেড়ে উঠার ইতিহাস স্মরণ করলে প্রথমেই চলে আসবে তার নাম। বাংলাদেশের অনেক স্মরণীয় জয়ের নায়ক হয়ে ভক্তদের মনে চিরস্থায়ী আসন পেয়েছেন অ্যাশ। একটা সময় প্রবাদই রটে গিয়েছিল ‘আশরাফুলের ব্যাট হাসলে বাংলাদেশ হাসে’। মানুষের এই অপরিমেয় ভালোবাসার প্রতিদান নিজের ক্যারিয়ারে প্রতিফলিত করতে পারেননি আশরাফুল। রূপকথার মতোই যিনি ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন, শেষটা করেছিলেন নামের সাথে বড্ড অবিচার করে।
সেই আশরাফুল আজ ক্রিকেট থেকে বহু দূরে গিয়ে একটি দীর্ঘশ্বাসের নাম। এক যুগের লম্বা আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাও তার রঙিন নয়। টেস্টে কিংবা একদিনের ক্রিকেটে তার ব্যাটিং গড় আহামরি তো নয়ই, মাঝারি মানেরও নয়। কিন্তু গড় দিয়ে তাকে বিচার করে ফেললে বোকামি ছাড়া কিছুই নয়। কোনো বিতর্ক তার জনপ্রিয়তাকে আটকাতে পারেনি। এমনকি ফর্মহীনতা তার জনপ্রিয়তায় বিন্দুমাত্র আঁচ ফেলতে পারেনি। নিজের দিনে তিনি যেন কোনো মহাকাব্যের মহানায়ক হয়ে ওঠতেন। কার্ডিফ, গায়ানা কিংবা জোহানেসবার্গের একেকটি ইনিংস তার একেকটি দৈত্য বধেরই গল্প।
২০০৭ এর পর থেকেই দলে সাকিব, তামিম আর মুশফিকদের মতো তরুণদের প্রাধান্য বাড়তে থাকে। আশরাফুলও নিজেকে হারিয়ে খুঁজছিলেন। ২০১০ থেকেই দলে অনিয়মিত হয়ে পড়েন আশরাফুল। ২০১২ সালে কোনো ওয়ানডে ম্যাচ খেলারই সুযোগ হয়নি। কিন্তু তার মধ্যে যে আরো কিছু দেবার মতো বাকি ছিল সেটা তিনি প্রমাণ করেন ২০১৩ এর শ্রীলঙ্কা সফরে। গল টেস্টে ৪১৭ বলের ১৯০ রানের চোখ ধাঁধানো ইনিংসটি খুব সহজেই তার টেস্ট ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংস হয়ে থাকবে। তবে, আশরাফুলকে বদলে দেওয়ার জন্য দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয় কোচ জেমি সিডন্সকে। যিনি জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার পরই বলেছিলেন, আশরাফুল খেললে বাংলাদেশ জেতে—এই ধারণা বদলে দিতে চান। তাতে আশরাফুলের উপকারের চেয়ে অপকারই হয় বেশি। আগের কোচ ডেভ হোয়াটমোর যেখানে আশরাফুলের টেকনিকে সমস্যা দেখেননি সেখানে ভয়াবহ সমস্যা দেখতে পান সিডন্স। টেকনিকে পরিবর্তন করতে গিয়ে যে কৌশল বেছে নিয়েছিলেন সিডন্স, সেটি কাজে আসেনি।
সেই জেমি সিডন্স বাংলাদেশে থাকতে চেয়েও পারেননি। ২০০৭ সালের অক্টোবরে দায়িত্ব নিয়ে ২০১১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছিলেন বাংলাদেশ দলের সঙ্গে। সিডন্স থাকতে চেয়েছিলেন এরপরও। কিন্তু তার সঙ্গে চুক্তি বাড়াতে রাজি হয়নি বিসিবি। ততদিনে হারিয়ে গেছেন সেই আগের আশরাফুল। জাতীয় দলে আশরাফুলের ফেরা নিয়ে মনের কোণে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে রেখেছেন তার ভক্তরা সেই ২০১৩ থেকে, আজও তা মিটিমিটি করে জ্বলছে। হয়তো আর ফেরা হবে না বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম মহাতারকা, বাংলাদেশি ক্রিকেটপ্রেমীদের প্রথম প্রেম মোহাম্মদ আশরাফুলের।
সারাবাংলা/এমআরপি